নিজস্ব চিত্র।
"খোদ জেলা প্রশাসনিক ভবনেই মাস্কের বালাই নেই তো সারা জেলায় থাকবে কী করে?" এমনটাই বলছেন অনেকে। এর মধ্যে আবার কিছু মানুষ জোট বেঁধেছেন মাস্কের বিরুদ্ধে। তাঁদের দাবি, "মাস্ক পরবেন না। করোনা হল রাজনৈতিক চক্রান্ত! মিডিয়া সৃষ্ট!" এই ধরনের কিছু। এই মানুষগুলি ভ্যাকসিনেরও বিরোধিতায় সরব।
হাজার হাজার মানুষ। সিংহ ভাগের মুখে মাস্ক নেই। প্রার্থী তাদের নিয়ে এগিয়ে আসছে রাস্তা দিয়ে।
শহর থেকে গ্রাম, গলি থেকে রাজপথ ভোটের আগে প্রতিদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এমন প্রচার মিছিলের সাক্ষী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এঁদের দেখে কে বলবে, দেশে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা গত ৪ এপ্রিল এক লাখের গন্ডি পেরিয়ে হয়েছে ১০৩৭৯৪। পশ্চিমবঙ্গে সেই সংখ্যাটা ওই দিন ছিল ১৯৫৭। ভোটের উত্তাপে কর্মী সমর্থকদের জন-প্লাবনে সবাই কেমন ভুলে গিয়েছেন সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ কত দ্রুত সংক্রমিত করছে মানুষকে।
এই তো কয়েক দিন আগেই নমিনেশন জমা দিতে যাওয়া এক প্রার্থীর দলের কিছু সমর্থক এসে আবদার করে বললেন, "আমরা কত লোক নিয়ে এসেছি দেখলেন তো! দেখাতে হবে কিন্তু আমাদের ভিড় ওদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।"
জনপ্লাবনে ভাসতে থাকা মানুষের মাথা গুনে জন সমর্থনের হিসাব কষছে রাজনৈতিক দলগুলো। কি ভীষন দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করে চলেছেন আগামীর জনপ্রতিনিধিরা। এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে তারা অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার চেষ্টা করছে বলে দায় সারছে। ছবিটা প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই এক। যেমন বিজেপির কৃষ্ণনগর উত্তরের মিডিয়া কনভেনর সন্দীপ মজুমদারের সাফাই, "আমরা সভার আগে মাস্ক পরার কথা বলি তো। দলের প্রতীক আঁকা মাস্ক বিলি করি কর্মীদের মধ্যে। কিন্তু প্রতি মিটিং মিছিলে এত জন জোয়ার হয় যে, কে কে নিয়ম মানছে না, সেটা দেখা সম্ভব হয় না।" তেমনই আবার তৃণমূল যুব কংগ্রেসের কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি জয়ন্ত সাহার কথায়, "এই করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল বলে মনে হয়। আমরা স্বাস্থ্যবিধির কথা মুখে বললেও মানুষ আবেগে ও বিজেপিকে আটকাতে আমাদের মিটিং মিছিলে দলে দলে হাঁটছে। মানুষের সেই আবেগ আটকাব কী করে?"
অবশ্য এটা ঠিকই, মানুষ এই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছে বলেই ভিড় হচ্ছে রাজনৈতিক সভা সমাবেশে। মানুষ চায় বলেই প্রচারে প্রার্থীর মুখে মাস্ক থাকে না, হাতে হাত মেলানো চলে নির্দ্ধিধায়। মানুষ চায় বলেই কারও কিছু করার নেই। সাধারণ মানুষ আজ বড় বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সে কিছুই মানতে চাইছে না। সেলের বাজার থেকে বিভিন্ন উৎসব কোথাও ভিড়ের খামতি নেই। এখন কোথাও মাস্কেরও বালাই নেই। কেউ যদি মাস্কের পক্ষে বলতে যায়, উল্টে সেই বিদ্রুপের শিকার হয়। কেউ বলেন," করোনা মানে সাধারণ ভাইরাল ফিভার, অহেতুক ভয় দেখানো হচ্ছ।" কেউ বা বলেন, "করোনা ব্যপারটাই মিডিয়ার তৈরি।" আসলে এই মানুষগুলি নিয়ম না মানার অজুহাত খোঁজেন। আর নিয়ম না মানা মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যান নিয়ম মানতে চাওয়া মানুষগুলো।
টিকা আসার আগে মানুষের মনে যাও বা খানিক নিয়ম মানার প্রবণতা ছিল, যেটুকু ভয় ছিল, এখন তা উধাও। মাঝে সংক্রমণ কমতে থাকায় আর করোনার টিকা এসে যাওয়ার পরে বেপরোয়া ভাবটা বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তি, পুলিশ অনেকেই মাস্ক পরেন না। প্রশ্ন করলে কারও যুক্তি, "ভ্যাকসিন নিয়েছি তো। " কেউ বা বলেন, "তা হলে কি ভ্যাকসিন কাজ করছে না?"
ভ্যাকসিন নিলে যে করোনা হবে না এ কথা তো একবারও বলেননি বিশেষজ্ঞরা। কৃষ্ণনগরের শক্তিনগর জেলা হসপিটালের চিকিৎসক কৌশিক ভট্টাচার্য বলেন," ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও কেউ করোনা আক্রান্ত হতেই পারেন। তবে ভ্যাকসিন নিলে তার শরীরে সংক্রমণের মাত্রা কম হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। " তিনি আরও বলেন," ভ্যাকসিন নিলেও মাস্ক পরা, বার বার হাত ধোয়া আবশ্যক যত দিন না হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়।"
এর পাশাপাশি, "করোনা মোটেই অবহেলা করার মতো কোনও রোগ নয়, কিছু ক্ষেত্রে তা প্রাণঘাতী" বলেও বার বার সতর্ক করেছেন তিনি। তিনি বলেন, "আমরা এখনও সতর্ক না হলে, স্বাস্থ্যবিধি সঠিক ভাবে না মানলে দ্বিতীয় সংক্রমণে ঢেউ আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রবল ভাবে আছড়ে পড়তে পারে।" কিন্তু কে শোনে কার কথা?
"খোদ জেলা প্রশাসনিক ভবনেই মাস্কের বালাই নেই তো সারা জেলায় থাকবে কি করে?" এমনটাই বলছেন অনেকে। এর মধ্যে আবার কিছু মানুষ জোট বেঁধেছেন মাস্কের বিরুদ্ধে। তাঁদের দাবি, "মাস্ক পরবেন না। করোনা হল রাজনৈতিক চক্রান্ত! মিডিয়া সৃষ্ট!" এই ধরনের কিছু। এই মানুষগুলি ভ্যাকসিনেরও বিরোধিতায় সরব।
কারও আবার যুক্তি, "মিটিং-মিছিলে করোনা হয় না, করোনা কি শুধু উৎসবে?" তাঁদের কাছে প্রশ্ন,, " মিটিং-মিছিলে ভিড় কারা করেন?" তারাও তো সেই উৎসবে মাতা মানুষগুলোই। সচেতনতা তো সব জায়গায় দরকার। সেটা মিটিং-মিছিলই হোক বা ধর্মীয় সামাজিক অনুষ্ঠান। মানুষ বেপরোয়া। তাঁরা নিয়মই মানতে চান না বলেই পাল্টা অজুহাত খুঁজে ফেরেন।
পেশায় স্কুল শিক্ষক তথা সাহিত্যিক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "গোটা একটা শিক্ষাবর্ষ হারিয়ে গেল করোনা আবহে। অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয় যারা তাদের সংখ্যা মোট ছাত্রছাত্রীর তুলনায় নগন্য। এর মধ্যে আবার সংক্রমণের নতুন ঢেউ। তার মানে কবে স্কুল স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে তা আরও অনিশ্চিত হয়ে গেল। কিছুদিন নিয়ম মেনে সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে হয়তো সর্বস্তরে স্কুল খোলা সম্ভব হত।" আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, " স্কুল জীবন স্বাভাবিক করার কথা তো ভাবতেও দেখি না নিয়ম না মানা উৎসব, রাজনীতি প্রিয় মানুষদের।"
ভোটের উৎসবে একদিকে বেশির ভাগ মানুষ যেমন করোনা ভুলে মেতেছেন 'খেলা হবে' স্লোগানে, তেমনই উল্টো দিকে প্রতিদিন দ্রুত হারে সংক্রমণ বৃদ্ধির মতোই মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজের এসোসিয়েট প্রফেসর চিকিৎসক সৌগত বর্মন বলেন, "মিটিং-মিছিল, জমায়েতের এই ভিড় আগামীতে আমাদের জন্য খারাপ দিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখনই আমাদের সতর্ক হওয়ার ভীষণ প্রয়োজন।" তিনি আর বলেন, "কিছু মানুষ দেখছি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় মাস্ক পরবেন না, ভ্যাকসিন নেবেন না ধরনের পোস্ট করে চলেছেন। এই ধরনের ভিত্তিহীন, নেগেটিভ প্রচারে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন।"
বর্তমান পরিস্থিতিতে মাস্ক ও ভ্যাকসিন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলেই মত তাঁর। কারণ প্রসঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, মাস্ক ছাড়া ঘুরলে, মাস্ক পরে ঘোরার তুলনায় সংক্রমণ অনেক দ্রুত ছড়াতে পারে সবার মধ্যে। আর সংক্রমণ যত দ্রুত ছড়াবে ভাইরাসের তত বেশি মিউটেশন ঘটে নতুন নতুন স্ট্রেন তৈরি হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে। ফলে, নতুন নতুন স্ট্রেনের মধ্যে দিয়ে পরিবেশে ভাইরাসটির সক্রিয় থাকার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
অতএব, সাধু সাবধান! ভোট শেষ হওয়ার পরে আমরা এমন জায়গায় যেন না পৌঁছোই যে ফের লকডাউনে বাধ্য হয় রাজ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy