Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
NRI Nostalgia

বাংলা ভাষা, জীবনধারা আমার প্রেমের পথে বাধা হয়ে গেল

হয় আমাদের নববর্ষ। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে এক বাঙালি মহিলা নিজে হাতে রান্না করেন। ওঁর তৈরি চমচম আর গলদা চিংড়িতেই আমার বা আমাদের নববর্ষ কাটে।

আমি 'প্রবাসী বাঙালি'। শুধু বাঙালি নই।

আমি 'প্রবাসী বাঙালি'। শুধু বাঙালি নই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২১ ১৫:২০
Share: Save:

আজ ১৪২৮। কলকাতা আর বাবা-মাকে ছেড়ে আবার আমার একলা বৈশাখ। বছর ২০ হল।

তবুও বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন ( বাংলা ?)অফিসারের কাছে শুনি ' ইউ ক্যান লিভ ইয়োর কান্ট্রি...' ভেতরটায় মুচড়ে ওঠে। কী যেন সব ছেড়ে যায়। আমার কাজের শহরে ফিরতে হয়।

বিমানে আসার সময় একটা পরিবারকে লক্ষ করছিলাম। বাংলাদেশি পরিবার। অল্প বয়সের একটি মেয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করছে, নববর্ষ কী।( মেয়েটি ইংরিজিতে জানতে চাইছে।) বাবা-মা বুঝিয়ে চলেছেন নববর্ষ কী। মেয়ে বুঝছে না। মেয়ে বলছে স্কুলে আমি এটা আমার সব বন্ধুকে বলতে চাই। আফ্রিকার বন্ধু। ইন্দোনেশিয়ার বন্ধু। সে বলছে, "এক কথায় বল, পয়লা বৈশাখ কী?"। শুনলাম, মেয়ের মা খুব সুন্দর করে উত্তর দিলেন। বললেন যে দিন সমস্ত অশুভ, কালো মুছে গিয়ে সূর্য ওঠে। আলো আসে। সে দিনই নববর্ষ।

আমিও নতুন করে শিখলাম! মনে হল পৃথিবীর সব উৎসবের তো এটাই মন্ত্র। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার। জাতি, বর্ণ, দেশ... আসলে বাঁধন কোথাও নেই। মানুষ নিজের তৈরি কাঁটাতারে আটকে আছে। সেই কাঁটাতারে বিদ্বেষ, ভেদ, দেশ ভাগ হয়েছে। মনকে কি ভাগ করা যায়?

ভাবলাম, সোফিয়ার মা যদি ওই ভাবে ওকে বুঝিয়ে দিত! তা হলে কি ও বাঙালি বলে ওর প্রেমিককে ছেড়ে চলে যেত?
নববর্ষে সকলে ছোটবেলার কথা লেখে। ধুতি পাঞ্জাবি, শাড়ি, কষা মাংস, লুচি, মিষ্টির বাক্স... নামগুলো পর পর আসে। আর আমি কিনা সোফিয়াকে নিয়ে পড়লাম! আসলে সত্যি আমি বাঙালি, নয়তো এ সময় পুরনো প্রেম নিয়ে স্মৃতিমেদুর হলাম কেন। আমার তো পিছনের সব কিছু ফেলে এগিয়ে ভাবার কথা!

সোফিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বের লম্বা সময় কাটিয়েছি। ওকে আমার দেশ দেখাতে নিয়ে এসেছিলাম এই রকমই এক নববর্ষে। ও নিউ ইয়র্কে থাকত। কাজের সূত্রে আলাপ। সোফিয়া এসেছিল আমার দেশে। শাড়ি পরে নববর্ষের দিন কী সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে! আমার মাকে খুশি করার জন্যই ও শাড়ি পরেছিল। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে ও বুঝেছিল, এই বাঙালি সংসারে ও থাকতে পারবে না। আমায় বলেছিল, "এই যে যৌথ পরিবার, এই ভাবনাটা আমরা জানি না। আর শিখতেও পারব না।" কত মানুষ তো ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে দাম্পত্য কাটাচ্ছে, আমরা পারিনি। বাংলা ভাষা, জীবনধারা আমার প্রেমের পথে দাঁড়িয়ে গেল।

কষ্ট নেই। আমার মতো কলকাতায় গিয়ে রাস্তার খাবার খাওয়া, লুচি ছোলার ডালের বাঙালির জন্য হয়তো বাঙালি মেয়েই দেখা দেবে।
থাক সে কথা।

আমি 'প্রবাসী বাঙালি'। শুধু বাঙালি নই। ভাল না লাগলেও শুনতে হয়। সারাক্ষণ কলকাতার বন্ধুরা লেখে 'এই তোদের নববর্ষ হয়?' আমরা যেন বাঙালির থেকে একটু আলাদা। যেন অন্য কিছু।

হয় আমাদের নববর্ষ। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে এক বাঙালি মহিলা নিজে হাতে রান্না করেন। ওঁর তৈরি চমচম আর গলদা চিংড়িতেই আমার বা আমাদের নববর্ষ কাটে। তবে এ বার নববর্ষ কাজের দিনে। আমেরিকার বাঙালিরা কাজ ফেলে কিছু করে না। তাই আমাদের পয়লা বৈশাখ এখনও হয়নি। শনিবার আমাদের পয়লা বৈশাখ। শনিবার পাঞ্জাবি আর শাড়ির পয়লা বৈশাখ। বাঙালি রান্না আর গান বাজনার পয়লা বৈশাখ। কাঁটাতার কিছু বদলাতে পারে না। প্রবাসী বাঙালি বলেও কিছু হয় না। এই তকমাও অনেক প্রবাসের বাঙালিকে তার পয়লা বৈশাখকে 'একলা বৈশাখ' করে দেয়। ভোগবাদের জমানায় হয়তো ভাষা সংস্কৃতি এক হয়েও এই বিভাজন। আজও আমেরিকা থেকে এসছে বললে কলকাতার বাঙালি অন্য ভাবে তাকায় আমার দিকে।

বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গে বাংলায় লেখা হরফ পথে পথে দেখা যায় না। বা কলকাতার মতো প্রভাত ফেরি নিউ ইয়র্কে হয়তো হয় না। রকমফের আছে। তবুও সবাই বাঙালি। রাজনীতি যতোই হিন্দু আর মুসলিমকে আলাদা করে ফায়দা লুটুক। হিন্দুও বাঙালি, মুসলিমও তাই।

এই ভেদ ভোলার নয়। তবে বাঙালি নিজেকে নিয়ে একটু নিয়ে একটু গর্ব করতে পারে না? বাঙালির কিছু হয় না। বাঙালি মানে কাঁকড়ার জাত। বাঙালি অন্য বাঙালির ভাল চায় না। যেমন রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ। সব ভাল ছিল।

এখন কিছু নেই। হাত গুনলে শুধু অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়...

এই নতুন বছরে সেই একঘেয়ে ধারনা ভুলে নিজেদের বাঙালি জাতি হিসেবে ভালবাসতে পারি না? সেই যেমন বাংলাদেশের মা তার মেয়েকে বলেছিল আলোর কথা। সব উৎসবের আলোর সুরের কথা। বিশ্বের মানুষের এক হওয়ার কথা।

সেখানে বাঙালি শব্দটা না হয় কম উচ্চারণ করা হল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy