যুদ্ধ বারবার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে বদলে দিয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পর, রাজা-রানিদের জীবনযাত্রার প্রতি ক্ষোভ থেকে হুপ পেটিকোট-এর (অনেকটা ঘের দেওয়া ফুলে থাকা স্কার্ট বা গাউন, যাতে অনেকখানি কাপড় লাগে) প্রচলন কমে যায়। শুরু হয় কম ঘেরের ‘সিম্পল’ পোশাকের চল। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহিলারা আরও বেশি করে বাইরের চাকরির জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। স্কার্টের বদলে ট্রাউজ়ার্স পরার চল বাড়ে। এই কোভিড-১৯ এর সঙ্গেও তো বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধই চলছে মানুষের। অতিমারির দিনগুলি প্রাত্যহিক জীবনাভ্যাসে বহুল পরিবর্তন এনেছে। তারই সঙ্গে বদল এনেছে পরিধানে, সাজসজ্জা নিয়ে চিন্তাভাবনায়। আগের মতো যে পোশাকটা মনে ধরল, কিনে আনতে পারছি না। বিয়েবাড়ি, অনুষ্ঠান কমে গিয়েছে। তাই জমকালো পোশাক সংগ্রহ করার প্রবণতাও কমেছে। তা হলে এই সময়ে ঠিক কী পরবেন, কোন পোশাক কিনবেন, এখন ফ্যাশন ট্রেন্ডই বা কী— আলোচনা করলেন ফ্যাশন ডিজ়াইনাররা।
ওয়ার্ড্রোব রিসাইক্ল করুন
ফ্যাশন ডিজ়াইনার পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই অনিশ্চয়তা কত দিন চলবে বলা যাচ্ছে না। তাই নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি। শখের বশে অনেক টাকা খরচ করে নতুন কিছু না কেনাটাই ভাল। বরং নিজেদের ওয়ার্ড্রোবটা বুদ্ধি করে ব্যবহার করুন। দেখে নিন, আপনার কাছে সুতির আরামদায়ক পোশাকের কী কী অপশন আছে। যেমন টিউনিক, লং ড্রেস, বড় শার্ট, কুর্তি, লেগিংস, সলিড রঙের টপস, পালাজ়ো। এগুলো মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরুন।’’ যদি আলমারিতে পুরনো বডি হাগিং টি থাকে, সেটা ইন করে পালাজ়ো পরুন। কোমরে একটা বড় বেল্ট দিয়ে অ্যাকসেসরাইজ় করুন। বড় টি শার্টের সঙ্গে লেগিংস, ব্যাগি টি-র সঙ্গে টর্ন ডেনিম, শার্ট-ড্রেসের সঙ্গে — নতুন কম্বিনেশনে পরলে আলাদা পোশাকই তৈরি হয়ে যাবে।
ডিজ়াইনার সৌমিত্র মণ্ডল বলছেন, ‘‘লকডাউনে অনেকেই বাড়ির ওয়ার্ড্রোব গুছিয়েছেন। তখন দেখেছেন, খুব প্রিয় কোনও পোশাক হয়তো কাবার্ডের কোণে পড়ে আছে। এমন অনেক পোশাক বার হয়েছে, যেটায় হয়তো এক বছর হাতই দেওয়া হয়নি। এই পোশাকগুলিই অন্য কিছুর সঙ্গে টিম-আপ করে পরলে আলাদা স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি হয়ে যাবে।’’
সাসটেনেবল ফ্যাশন
এই প্রসঙ্গেই সৌমিত্র বললেন, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, দুনিয়া জুড়ে ‘সাসটেনেবল ফ্যাশন’ নিয়ে কাজ চলছে। অর্থাৎ পোশাকের আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা চলছে, তার ভ্যালু যাতে ‘জ়িরো ওয়েস্ট’-এ নামিয়ে আনা যায়, সে দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। তাই কোন পোশাক কত বার ব্যবহার করতে পারছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ডিজ়াইনাররা এমন পোশাক তৈরিতে জোর দিচ্ছেন, যেগুলি বার বার ধুলেও রং উজ্জ্বল থাকবে। পারমিতার কথায়, ‘‘এখন পোশাক পরলেই সেটা ধোয়ার প্রয়োজন হচ্ছে। প্রতেক দিনই ড্রাই ক্লিনিংয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এমন ফ্যাব্রিক বাছতে হবে যেগুলি হ্যান্ড-ওয়াশ বা মেশিন-ওয়াশে সমস্যা হবে না। প্রিন্টেড ডিজ়াইন, এমব্রয়ডারি থাকলে জলে, সাবানে সেগুলি খারাপ হয়ে যেতে পারে। সেরা বাজি কটন, হ্যান্ডলুম। ধোয়া ও শুকিয়ে নেওয়া সহজ।’’
বিশ্ব জুড়ে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড গার্মেন্টস’-এর বাজার তৈরি হয়েছে। পুরনো পোশাক থেকে নতুন পোশাক তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। পুরনো পলিয়েস্টার কাপড় থেকেই নতুন পলিয়েস্টার মেটিরিয়াল, পুরনো ডেনিম নষ্ট করে নতুন ডেনিমের সুতো তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে। সেকেন্ড হ্যান্ড গার্মেন্টস শুনে ভ্রু-তে ভাঁজ ফেলবেন না। ‘‘শর্মিলা ঠাকুরের বিয়ের শরারা-ই তো নিজের বিয়েতে পরেছিলেন করিনা কপূর খান,’’ মনে করিয়ে দিলেন সৌমিত্র। ঠাকুমা-দিদিমারাও কত মূল্যবান পোশাকই তো আমাদের জন্য রেখে যান। এই অবসরে, সেগুলোকে পলিশ ও রি-ডিজ়াইনিং করে নতুন করিয়ে নিন। ওয়ার্ড্রোবের আভিজাত্য বাড়বে।
মাস্ক-ই এখন অ্যাকসেসরি
• পরিধানের ধারণাটাই বদলে দিয়েছে করোনা। ‘‘সামগ্রিক পোশাকটাই এখন থ্রি পিস হয়ে গিয়েছে। শুধু টপ আর বটম-ওয়্যার নয়। তার সঙ্গে মাস্ক-ও মাস্ট,’’ বললেন সৌমিত্র। চিকিৎসকেরা মাস্কের যে বৈশিষ্ট্যগুলির কথা বলছেন, সেগুলি মাথায় রেখেই মাস্কের ‘লুক’-এ নজর দেওয়া হচ্ছে। অনেক পোশাক ব্র্যান্ডই ‘এসেনশিয়াল পাউচ’ রেখেছে। যার মধ্যে ওয়াশেবল মেটিরিয়ালের জামাকাপড় ছাড়াও রয়েছে মেডিকেটেড মাস্ক। আবার বিপণিগুলিতে কোনও পোশাক কিনতে গেলে তার সঙ্গে ম্যাচিং মাস্ক দেখিয়ে দিচ্ছেন কর্মীরা। তবে শুধু দেখনদারিতে মজে সে মাস্ক না কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ। এমব্রয়ডারি করা মাস্কে নকশা করার সময়ে যে ছিদ্রগুলি তৈরি হয়, সেগুলি বন্ধ করা হয়েছে কি না, মাস্কটি বৈজ্ঞানিক বিধি পুরোপুরি মেনে তৈরি হল কি না, সেগুলি ভাল করে দেখে নিয়ে তবেই মাস্ক বাছাই করা উচিত।
এসেনশিয়াল ওয়্যার
সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসবে পরার মতো অকেশন-ওয়্যারের চাহিদা অনেকটা কমেছে। বরং বিক্রি বেড়েছে এসেনশিয়াল ওয়্যারের। অর্থাৎ কটন ও নিটেড মেটিরিয়ালের তৈরি জামাকাপড়ের। বাড়িতে পরার কুর্তা-পাজামা, পালাজ়ো সেট বা স্কার্টস যথেষ্ট পরিমাণে মজুত করছেন অনেকেই। পাশাপাশি ওয়ার্ড্রোব বেসিকসের কেনাকাটা চলছে। অর্থাৎ চেকস বা স্ট্রাইপড টপস, হোয়াইট শার্ট, ক্লাসিক ডেনিম, সামার জ্যাকেট, লং কোট ড্রেস, ফর্মাল ওয়্যার, টাই অ্যান্ড ডাই কুর্তি কেনার ঝোঁক বেশি। ওয়াটারপ্রুফ মেটিরিয়ালের ব্যাগ, জুতো, ঘড়ি এবং অ্যাকসেসরিজ়ের কদর প্রচণ্ড বেড়েছে। ব্যাগি প্যান্টসের ক্ষেত্রে শক্তপোক্ত বড় পকেট থাকছে। যেখানে ছোট সাবান, গ্লাভস, স্যানিটাইজ়ার এঁটে যেতে পারে।
ট্রেন্ড এখন
• রঙিন কম্ফি ফ্যাশন: এই সময়ে নিজের মনটা ভাল রাখা ভীষণ জরুরি। তাই আরামদায়ক আর রঙিন পোশাক পরার পরামর্শ দিলেন ডিজ়াইনার কবিতা ভারতী। নিউট্রাল শেডের টপের সঙ্গে খুব রংচঙে বটমওয়্যার পরুন বা উল্টোটা। কনট্রাস্ট পেয়ারিং সব সময় চোখ টানে। যতই অসুখ থাক, উৎসবের সময়ও তো এগিয়ে এল। তাই কোথাও একটু সেই জাঁকজমকের ছোঁয়া রাখুন। হয়তো একটু জুয়েলারি দিয়ে সাজানো বেল্ট পরলেন কিংবা একটা সুন্দর আর্মলেট বা অ্যাঙ্কলেট। শরীরের এমন কোনও অংশে অ্যাকসেসরিজ় পরুন, যেখানে আপনি বেশি হাত দেন না। বাড়ি ফিরে, অ্যাকসেসরিজ় আলাদা সরিয়ে রাখুন কয়েক দিন। তার পর তুলে রাখবেন। কয়েক দিন তাতে হাত দেবেন না। ভাইরাসের ভয়ে সাজ কমাবেন কেন?
• কাফতান: করোনা-আবহে ফ্যাশনে নতুন করে ফিরেছে কাফতান। আদতে পশ্চিম এশিয়ার এই পরিধানের সুবিধে হল, এটি শরীরের অনেকটাই ঢেকে রাখে। করোনাকে এড়িয়ে চলতে ঠিক এমন পোশাকই তো আমরা পরতে চাইছি। গরম দেশের জন্য এই পোশাক খুব আরামদায়ক। আবার ঢিলেঢালা ফিটিং হলেও বেশ স্টাইলিশ দেখতে। শুধু বাড়িতেই নয়, বাইরেও এই পোশাক পরা যায়। সোনম কপূর তাঁর বিয়ের রিসেপশনে আবু জানি সন্দীপ খোসলা-র ডিজ়াইনে চিকনকারি কাজের আইভরি রঙের কাফতান পরে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। অন্য অনেক সময়েই মাসাবা গুপ্ত বা সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের ডিজ়াইনার কাফতানে দেখা গিয়েছে তাঁকে। কাজেই কাফতান পরে বাইরে বেরোলেও যথেষ্ট নজর কাড়বেন। শর্ট কাফতান টপের সঙ্গে লেগিংস পরলেও বেশ দেখাবে।
• স্কার্ফ: বান্দানা আর স্কার্ফ দুয়েরই কদর বেড়েছে। এখন ক্যাজ়ুয়াল পোশাকই বেশি পরছেন মানুষ। তাই তার সঙ্গে স্কার্ফ নানা কায়দায় ড্রেপ করে লুক স্মার্ট রাখার চেষ্টা করছেন। মাথার চুল বেঁধে তার উপর স্কার্ফ বা বান্দানা জড়িয়ে রাখলে স্টাইল ও সুরক্ষা দুটিই হবে। তবে মাস্কের বদলি হিসেবে স্কার্ফ ব্যবহার করবেন না।
ডিজ়াইনাররা একমত যে, ফ্যাশন এখন রেসপন্সিবল ও মিনিমাল। মানে পরিচ্ছদ আপনাকে ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেবে, অপচয় কমাবে ও পরিবেশ দূষণ করবে না। তার সঙ্গেই থাকবে সূক্ষ্ম ফ্যাশনবোধ। খুব বেশি সাজের সময় এখন নয়। তবে করোনার সময়টা পার হয়ে গেলেই বিরাট প্লাবন আসতে চলেছে ফ্যাশন-বিশ্বে। তখন নতুন নতুন ট্রেন্ড আসবে, পরিধানের আড়ম্বরের দিকেও বেশি নজর দেওয়া হবে মনে করছেন ডিজ়াইনাররা। যত দিন না সেই সুসময় আসছে, তত দিন নিরাপদে সাজুন।
মডেল: সৌরসেনী মৈত্র, ত্বরিতা চট্টোপাধ্যায়, রিয়া বণিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy