অলংকরণ: শৌভিক দেবনাথ।
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কথা হয়। কিন্তু তা থেকে যায় সেই বিশেষ চাহিদার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়েই। আর পাঁচ জনের সঙ্গে মিলেমিশে কী ভাবে বাঁচতে হবে, অন্যরা তাদের সঙ্গে কী ভাবে মিলবে— সে সব এখনও ততটাও আলোচনার মধ্যে ঢোকে না। কিন্তু কোনও শিশুকে বড় করে তোলার মধ্যে সবচেয়ে বড় টানাপড়েন হল সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে তাল রেখে বাঁচতে শেখানো।
এ বছরের অটিজিম সচেতনতা দিবসে সেই মূলধারার মধ্যে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের শিক্ষিত করে তোলার প্রসঙ্গ এসেছে। অর্থাৎ, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুটি যাতে সুযোগ পায় আর পাঁচ জনের মতো সাধারণ স্কুলে যেতে, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে লেখাপড়া, খেলার মাঝে বেড়ে উঠতে, সে বিষয়ে সমাজকে সচেতন হতে হবে।
তবে প্রশ্ন আছে কিছু। সাধারণ স্কুলে গেলে কি সত্যি সহজ হবে বেড়ে ওঠার পথ? এ বছর অটিজিম সচেতনতা দিবসের মূল ভাবনা হল ‘শিক্ষাক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিকরণ’। কিন্তু আর পাঁচ জন শিশু যেমন স্কুলে যায়, তা হলে কি তেমন স্কুলেই যাবে অটিজিমে আক্রান্ত শিশুরা? তাতে কি তাদের সত্যিই উপকার হবে? নাকি জটিলতাও রয়েছে? কী মনে করেন, এমন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের অভিভাবকরা?
একটি বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞানী অনন্যা রায় বললেন নিজের সন্তানের কথা। তাঁর ছেলে অর্কর বয়স এখন ১২। অটিস্টিক। প্রথমে বহু বছর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য আলাদা স্কুলেই পড়েছে সে। কয়েক বছর হল শহরের এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যাচ্ছে। অনন্যা জানান, প্রথমে অর্কর অসুবিধা হত। শিক্ষক থেকে সহপাঠী, অনেকেই ওর ভাব-ভঙ্গি বুঝতে সমস্যায় পড়তেন। হেনস্থাও হতে হয়েছে অর্ককে। কিন্তু এখন অনন্যার মনে হয় ভালই হয়েছে অর্ককে সাধারণ স্কুলে দিয়ে। বলেন, ‘‘অন্য শিশুরা কী ভাবে বড় হচ্ছে, তা তো দেখছে। তারাও অর্ককে দেখছে। সকলের মধ্যে কিছুটা বন্ধুত্বও হয়েছে।’’
তাই বলেই যে বন্ধুত্ব হওয়া সহজ, তা মনে করেন না অনন্যা। যেমন মনে করেন না আর এক অটিস্টিক শিশুর বাবা সিদ্ধার্থ আচার্য। জানান, আট বছরের মেয়ে সায়নীকে খেলার মাঠে নিয়ে গেলেও সমস্যায় পড়তে হয়। সকলের মতো করে চলতে পারে না সে। তা দেখে সায়নী নিজেই গুটিয়ে যায়। ফলে অনেকের মধ্যে সাধারণ স্কুলে সায়নীকে পাঠানোর কথা ভাবার সাহস পান না সিদ্ধার্থ। এখনও মেয়েকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের স্কুলেই নিয়ে যান। তবে সিদ্ধার্থর প্রশ্ন, ‘‘কেন সব স্কুলেই সব ধরনের শিশুকে পড়ানোর পরিকাঠামো থাকবে না? তা হলেই তো আর সমস্যা হয় না।’’
একই প্রশ্ন আর এক অভিভাবকের। নাম রোশনরা খাতুন। দশ বছরের পুত্রকে নিয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে থেকেছেন। ছেলে অটিস্টিক বলে অনেক স্কুল ভর্তি নেয়নি। রোশনরার প্রশ্ন, ‘‘আমার ছেলে সকলের সঙ্গে পড়লে কী হয়? কেন যে ভর্তি নিতে চায় না স্কুলগুলো! বিভিন্ন ধরনের ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় হলে তো সব শিশুরই ভাল হয়। তারাও তো চারপাশ সম্পর্কে আরও একটু জানবে।’’
সত্যিই ভাল হয় কি? প্রশ্ন তুলছেন সিদ্ধার্থ। তাঁর বক্তব্য, অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের অনেক কাজ হাতে ধরে ধীরে ধীরে শেখাতে হয়। সাধারণ স্কুলে যদি সেই পরিকাঠামো তৈরিও হয়, তাতে তাঁর কন্যা সায়নীর মতো শিশুরা সহজ ভাবে বেড়ে উঠতে পারবে কি? সিদ্ধার্থর প্রশ্ন, ‘‘যখন দেখবে যে ওকে একটা কাজ শেখাতে তিন মাস লাগছে, আর সেই কাজই ওর সহপাঠী জেনে আসছে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই, ওর তাতে আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি হবে না তো?’’ অনন্যা অবশ্য উল্টো কথাই বলছেন। নিজের ছেলেকে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করে দেখেছেন, আখেরে ভালই হয়েছে অর্কর। সিদ্ধার্থর চিন্তার জায়গাগুলি অনন্যারও পরিচিত। কিন্তু তিনি বলেন, ‘‘সবটাই শিক্ষকদের আচরণের উপর নির্ভর করে। যখন শিক্ষকরা সাহস দেন, তখন সাধারণ স্কুলে গিয়ে আসলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে।’’ আর এখানেই রোশনরার দাবি ফিরে আসে। তিনি মনে করান, শিক্ষকদের সাহস দেওয়ার ইচ্ছা থাকা চাই। পাশে দাঁড়ানোর মন থাকা দরকার। অনেক স্কুল এখনও অটিস্টিক শিশুদের ভর্তি নিতে চায় না। পরিকাঠামোর অভাবের কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরিকাঠামো তৈরি করলেই হয়। দাবি রোশনরার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy