অন্যদের সঙ্গে তুলনায় না গিয়ে নিজের সন্তানের কোথায় অসুবিধে হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে। ফাইল চিত্র।
একটা মুঠোফোনের দৌলতে সন্তানের স্কুল বিষয়ে খবর রাখা এখন অভিভাবকদের কাছে অনেক সহজ। ক্লাসে কী পড়ানো হচ্ছে, কবে ছুটি, পরীক্ষার সময়... সবই করতলগত। কিন্তু সেখানেই কি থেমে থাকছে আলোচনা? স্কুল বিষয়ে এই ক্রমাগত চর্চা সন্তানের পক্ষে হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে না তো?
পড়াতে বসে তুলনা নয়
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, “প্রত্যেক বাচ্চার শেখার ধরন ও সময় আলাদা। কেউ আগে শিখছে, কেউ হয়তো স্লো লার্নার। পরে সকলেই সব শিখে যাবে। কিন্তু স্কুলের বাইরে বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তুলনামূলক আলোচনায় অভিভাবকরা দিশাহীন হয়ে পড়ছেন। অনেকেরই মনে হতে থাকে, তাঁর সন্তান হয়তো পিছিয়ে পড়ছে। বাকিরা তো ঠিক পারছে। এর থেকে একটা অদৃশ্য মাইলস্টোন তাঁরা নিজেরাই তৈরি করে ফেলেন। আর সেই মাইলস্টোন স্পর্শ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন সন্তানের উপরে। এর ফল মারাত্মক। হয়তো যে অভিভাবক যত্ন ও ভালবাসার সঙ্গে পড়াতেন, তিনি ধৈর্য হারিয়ে সন্তানকে মারধর করে ফেলছেন। কারণ তাঁরও মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে, যা প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর আচরণে।” এতে সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়। অন্য দিকে পড়াশোনার প্রতিও সন্তানের অনীহা দেখা দিতে পারে।
অন্যদের সঙ্গে তুলনায় না গিয়ে নিজের সন্তানের কোথায় অসুবিধে হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে। যত্ন নিয়ে পড়ালে সন্তান হয়তো দু’দিন বাদে শিখবে, কিন্তু শিখবে। আর জোর করে পড়ালে সে পড়াশোনা-বিমুখ হয়ে পড়তে পারে।
সন্তানের দায়িত্ববোধ তৈরি করা জরুরি
স্কুলের গ্রুপ থেকেই যেহেতু অভিভাবকরা স্কুলের যাবতীয় রুটিন জেনে যাচ্ছেন, তাই সন্তানের উপরে তাঁরা আর নির্ভরশীল নন। ফলে দেখা যাচ্ছে, অনেক ছাত্রছাত্রীই নিজের রুটিন বা স্কুলের নোটিস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। পায়েলের কথায়, “অতিমারির পরে অবস্থা আরও সঙ্গীন। অনেকেই পুরো নোটিসটা ঠিক মতো লিখতেও পারছে না। ওদের দায়িত্ববোধও তৈরি হচ্ছে না। ওরা ধরেই নিচ্ছে যে, কোনও গ্রুপ বা অ্যাপ থেকে মা-বাবা নোটিস বা খবরটা পেয়ে যাবে।” তার বদলে সন্তানকেই দায়িত্ব দিন নোটিসটা লিখে আনার। এতে ওর দায়িত্ববোধ বাড়বে, ক্লাস ও পড়াশোনা সম্পর্কেও সিরিয়াস হবে।
স্কুলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হতে দিন
বেশির ভাগ বাড়িতেই মা-বাবার ফোন নিয়ে হয়তো ঘাঁটাঘাঁটি করে বাড়ির খুদেটি। ফলে একটা বয়সের পরে তারা যখন পড়তে শিখছে, তারা কিন্তু মা বা বাবার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজও পড়তে থাকছে। “অভিভাবকের অবর্তমানে তাঁর ফোন নিয়ে স্কুল-গ্রুপে চোখ রাখতে পারে ওরাও। হয়তো সেই গ্রুপে স্কুল বা কোনও শিক্ষককে নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে, তা কিন্তু নজরে আসছে আপনার সন্তানেরও। ফলে স্কুল ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে ওদের যে শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা, সেটা হচ্ছে না।” যে শিক্ষককে হয়তো ছাত্র বা ছাত্রীটির ভাল লাগে, তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য পড়ে তার মনে আঁকা শিক্ষকের ভাবমূর্তিতে আঁচড় পড়তে পারে। এখানেই কিন্তু শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ভিত নড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ভীষণ সচেতন হতে হবে অভিভাবককে। অনেক সময়ে দেখা যায়, সন্তান তার নিজের ইচ্ছেমতো বন্ধুও নির্বাচন করতে পারছে না। এক জন অভিভাবক অন্য যে সব অভিভাবকের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ, তাঁদের সন্তানদের গণ্ডির মধ্যেই নিজের সন্তানকে বেঁধে রাখতে চাইছেন। স্কুলে অভিভাবকদের গ্রুপ অনুযায়ী সন্তানরা মিশতে বাধ্য হচ্ছে। আর মনের বন্ধুটি পড়ে থাকছে ক্লাসরুমের একপাশে। এতেও ওদের স্বাভাবিক চিন্তার বিকাশ বাধা পাচ্ছে।
বাড়ছে পিয়ার প্রেশার
গ্রুপের আলোচনা তো সব সময়ে স্কুলের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বাচ্চার জন্মদিন উদ্যাপন, ছুটি কাটানোর গন্তব্য... সব আলোচনাই ক্রমশ বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে পিয়ার প্রেশার। “হয়তো কোনও অভিভাবক বড় রেস্তরাঁয় সন্তানের জন্মদিন উদ্যাপন করছেন, তাই দেখে অন্য অভিভাবকও আর-একটি রেস্তরাঁ বুক করে ফেললেন তাঁর একরত্তির জন্য। কেউ হয়তো বিদেশে ঘুরতে গিয়ে ছবি পোস্ট করেছেন, তা দেখেও অন্যদের মনে ইচ্ছে জাগতে পারে। এ ভাবে নিজেদের অজান্তেই কিন্তু একটা চক্রব্যূহে ঢুকে পড়ছেন সকলে। অহেতুক পিয়ার প্রেশার বাড়ছে। যেটা দেখছেন, ইচ্ছে করছে, কিন্তু করতে পারছেন না, তার জন্য অবসাদ দেখা দিচ্ছে। পারিবারিক অশান্তি, সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ... একে একে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।”
মনে রাখতে হবে, স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করিয়েছেন পড়াশোনার জন্য। সেখান থেকে মনোযোগ সরে যাচ্ছে স্কুলের বাইরের আলোচনায়। সেখানে অজান্তেই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা তৈরি হচ্ছে, যা সন্তান ও অভিভাবক কারও জন্যই ঠিক নয়। এতে মূল লক্ষ্য থেকে ক্রমশ সরে আসছেন অভিভাবকরা।
তাই পায়েলের পরামর্শ, এই ধরনের গ্রুপগুলোয় থাকলেও শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যে নজর রাখুন। সন্তান ও স্কুলের মাঝে অভিভাবক যেন ঢুকে না পড়েন, সে বিষয়ে সতর্ক হন। স্কুলের বিষয়ে সব দায়িত্ব সন্তানের উপরেই দিন। প্রয়োজনে ওকে সাহায্য করুন। এতে বাইরের জগতে চলার পক্ষে, নিজের দায়িত্ব নিতে উপযুক্ত হয়ে উঠবে ও। অভিভাবক হিসেবে সেটাই তো সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy