অনেক সময়ে গন্তব্যকে গরিমান্বিত করতে গিয়ে পথটির নৈতিকতার প্রসঙ্গ থেকে সরে আসা হয়। ফাইল চিত্র
ভুয়ো টিকা-কাণ্ড নিয়ে তোলপাড় চলছে কলকাতায়। পরতে পরতে বেরিয়ে আসছে সেই টিকার শিবিরের আয়োজকের বিষয়ে নানা তথ্য। কখনও জানা যাচ্ছে, বহু প্রতারণার ঘটনায় জড়িয়েছিলেন তিনি। শুধু মিমি চক্রবর্তীর মতো খ্যাতনামীকে নয়, নিজের বান্ধবীকেও সেখানে টিকা দেওয়ান সেই ব্যক্তি। সামনে এসেছে সে কথাও। এ সবের মধ্যেই উঠছে সমাজ-চিন্তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন।
এ ঘটনায় দেবাঞ্জন দেব নামক সেই ভুয়ো আইএএস কর্তার নীল বাতির গাড়ি আর ‘সেবামূলক কাজ’-এর নিন্দাই শুধু আসছে, এমন নয়। বারবার উঠছে পরিবারের কথাও। বাবা-মা-বোনের পরিচয় চলে আসছে নানা প্রসঙ্গে। যে কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতারণা-কাণ্ডের পরেই এমন ঘটে। ঘটেছিল ভুয়ো চিকিৎসকের ঘটনা কিংবা সারদা-কাণ্ডের পরেও।
কেউ প্রতারকের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। কারও আবার মনে হয়, অভিভাবকেরাই দায়ী। আর এক অংশ খানিকটা নরম কণ্ঠে কথা বলে। ভেবে দেখতে বলে, অভিভাবকের দায় যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই কি তাঁদের মানসিক পরিস্থিতির কথাও ভাবা জরুরি নয়? এ ধরনের বহু চিন্তায় বিভক্ত সমাজ। নানা কথাই মনে হতে পারে এমন ক্ষেত্রে। তবে অভিভাবকেরা পরিস্থিতির দায় পুরোপুরি এড়াতে পারেন না। মত এ শহরের পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের। বলেন, ‘‘ছোটবেলায় অনেক কিছুই শেখাতে ইচ্ছা করে সন্তানদের। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার পিছনে থাকে নিজেদের কিছু সুপ্ত ইচ্ছা। এবং না পাওয়া।’’ সে সব সন্তানের উপরে চাপিয়ে দিলেই ঘটে বড় সমস্যার সূত্রপাত। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘যে সব আচরণ মানুষকে একে-অপরের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে, সেই ধরনের আচরণকে আলাদা করে প্রশংসা না করে শুধুমাত্র প্রতিপত্তি, সাফল্যকেই গরিমান্বিত করতে দেখি আমরা। কিন্তু সে সবের মূল্যও যদি ছোটদের বোঝানো যায়, তা হলে বড় হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা সার্বিক মানবিকতার পাঠ থাকে।’’
বাবা-মায়ের আচরণই তবে এক ব্যক্তিকে প্রতারক তৈরি করে তোলার পিছনে দায়ী? তা দিয়েই হবে এমন সব ঘটনার ব্যাখ্যা? মানতে রাজি নন মনোবিদ। পরিস্থিতির সরলীকরণ এভাবে ঘটানো যায় না। অনুত্তমার স্পষ্ট বার্তা, ‘‘কোনও অপরাধকে মানসিক অসুস্থতা বা অভিভাবকত্বে ত্রুটির মতো ভাবনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া ঠিক নয়। তাতে প্রতারকের অপরাধের ভার কমে না।’’ বহু বাবা-মা নিজেদের সন্তানকে নির্দিষ্ট সাফল্যের একটি পেশায় দেখতে চাইতে পারেন। কিন্তু গন্তব্যের পাশাপাশি, কোন পথ সে নিল বা নিল না, তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে গন্তব্যকে গরিমান্বিত করতে গিয়ে পথটির নৈতিকতার প্রসঙ্গ থেকে সরে আসা হয়। মনে করাচ্ছেন অনুত্তমা।
সন্তান পালনের ক্ষেত্রে প্রশংসা এবং উৎসাহ দেওয়ার মধ্যে ফারাক থাকে। বক্তব্য পায়েলের। বলেন, ‘‘বহু বাবা-মাকে দেখা যায় সন্তান যা আদতে করেই ওঠেনি, তাও অন্যদের কাছে বলছেন। শিশুর সামনেই। তাতে শিশুটি বাকিদের কাছে প্রশংসা পাচ্ছে। সেইটাই ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যেতে পারে কোনও ক্ষেত্রে।’’ অনেকে হয়তো ভাবেন এতে আরও ভাল করার উৎসাহ পাবে সন্তান। তা না হয়ে উল্টোটাও হতে পারে। নিজের না পারার জায়গাগুলি এভাবে ঢাকার চেষ্টা করে বহু সন্তান। অনুত্তমা মনে করান, সন্তান পরবর্তীকালে যখন কোনও সাফল্যের ফসল ঘরে তুলছে, তখন অনেক সময়ে সেই প্রক্রিয়াটি কেমন, কোনও অনৈতিক কার্যকলাপ চলছে কি না, তা নিয়ে যেন দেখেও না দেখার অবস্থান নিয়ে ফেলা হয়। ‘‘অভিভাবক হিসাবে আমাদের আর একটু সচেতন হতে হবে’’, বলেন মনোবিদ।
যে কোনও কাজে সাফল্য পাওয়ার পদ্ধতি যথেষ্ট কঠিন। তাতে দায়িত্বও থাকে অনেক। পরিবারের বাকিরা চাইলে বোঝার চেষ্টা করতেই পারেন, গাড়ির নীল বাতি কষ্টে অর্জিত কি না। নিজের জনেরা বিপথে গেলে, তা টের পাওয়া অসম্ভব নয়। বোঝার ইচ্ছাটা যেন সুবিধামতো বাদ না পড়ে যায়। মনে করালেন দুই বিশেষজ্ঞ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy