Advertisement
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪
অনলাইন স্কুলিংয়ের এই ছোটবেলাটা বেশ আলাদা। লেখাপড়া, পরীক্ষা, বন্ধুসঙ্গ-সহ স্কুলজীবনের খোলনলচেই বদলে গিয়েছে। কী ভাবে পাশে থাকবেন অভিভাবক?
Corona

অনলাইন স্কুলবেলা

অনলাইন স্কুলিংয়ের এই ছোটবেলাটা বেশ আলাদা। লেখাপড়া, পরীক্ষা, বন্ধুসঙ্গ-সহ স্কুলজীবনের খোলনলচেই বদলে গিয়েছে। কী ভাবে পাশে থাকবেন অভিভাবক?

চিরশ্রী মজুমদার 
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২১ ০৫:৫৩
Share: Save:

নব্য প্রজন্মের শৈশবটা রাতারাতি পাল্টে গিয়েছে। করোনাসুর যে স্কুলটাকেই ছোঁ মেরে তুলে স্মার্টফোন আর কম্পিউটার স্ক্রিনে পুরে দিয়েছে। তাতে কি সেই স্কুলবেলার মজা একেবারে হারিয়ে গেল? নাকি ডিজিটাল স্কুলে পঠনপাঠনের ধরন, পরীক্ষা পদ্ধতি পাল্টে যাওয়ার মতো তারা শুধুই ভোল বদলাল? স্কুল তো শুধু লেখাপড়ার পথেই এগিয়ে দেয় না, ব্যক্তিত্বের স্ফুরণে সাহায্য করে, মানসিক বিকাশ ও সামাজিকতার শিক্ষায়ও সহায় হয়। অনলাইন ক্লাসরুমে সেগুলো ঠিকমতো হচ্ছে তো? ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক এই নয়া রীতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। নতুন পদ্ধতির ইশকুল আক্ষরিক অর্থেই ই-স্কুল, যার মুশকিলও আনকোরা। আশ্বাসের কথা, সেই মুশকিল পেরিয়ে বাচ্চাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎই দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা।

‘স্কুলে কবে যাব?’ বনাম ‘বেঁচে গিয়েছি’

বেশির ভাগ বাচ্চা বন্দিদশায় হাঁপিয়ে উঠেছে। বন্ধুদের তো বটেই, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ক্লাসরুম সব কিছুই ভীষণ মিস করছে। লাগাতার প্রশ্ন ওদের, ‘কবে স্কুল যাব?’

উল্টো পিঠও আছে। পদ্ধতিগত কারণে ও স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে, পাঁচ-ছ’ঘণ্টার স্কুলের মতো টানা অনলাইন ক্লাস করাতে চায় না অনেক প্রতিষ্ঠানই। কম সময় ক্লাস করিয়ে বাড়ির জন্য অনেক ‘অ্যাক্টিভিটি’ দেওয়া হয়। অনেক বাচ্চার কাছে এ যেন অনন্ত গ্রীষ্মাবকাশ বা পুজোর ছুটি। কাকভোরে উঠে ঘড়ি ধরে স্কুলে ছোটা নেই। বেশিক্ষণ ঘুম, নাগালে রিমোট ও ইন্টারনেট, অঢেল আয়েশ। ফোন-কম্পিউটারে পড়াশোনায় অনেকেই সন্তুষ্ট। তাদের একান্ত ইচ্ছে, স্কুল তালাবন্ধই থাকুুক।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘প্রত্যেকটা বাচ্চা আলাদা, তাদের ভাবনাচিন্তাও তাই মেলে না। যেটাকে উচিত বা অনুচিত বলে মনে করছেন, তাকেই আঁকড়ে থাকবেন না। সন্তানের ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোলে সমাধান মিলবে।’’ বাচ্চাদের স্কুলে যেতে না পারার দুঃখ ভোলানোর উপায় নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। অবসরে ওকে নানা কাজে বা পারিবারিক বিনোদনের মাধ্যমে ‘এনগেজড’ রাখা, খেলা-ব্যায়ামের সময় বাড়ানো, বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিয়ো কল, জ়ুম মিটিংয়ের ব্যবস্থায় ফল মিলছে। স্কুল থেকেও সহায়তা মিলছে। ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করে কথা বলা, অডিয়ো-ভিডিয়ো শেয়ার করে বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। কিন্তু যারা স্কুলে যেতে চায় না? ডা. রাম বললেন, ‘‘বাস্তব কোনও ঘটনায় তাদের স্কুলে ফেরার নামে জ্বর আসছে। বেশির ভাগই স্কুলে বুলিড বা অপমানিত হয়েছে। কিংবা পড়াশোনা পারে না। এরা অনেকেই অনলাইনে আড়ালে-আবডালে থাকা, শিক্ষকদের মুখোমুখি না হওয়ার সুবিধে উপভোগ করছে। মানসিক বা পারিবারিক কারণে, সংক্রমণ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণেও স্কুলবিমুখ হতে পারে। মূল কারণ খুঁজে বার করলেই সমস্যার সমাধান সহজ হবে। যাদের সকালে ওঠার অভ্যেস চলে গিয়েছে, তাদের বন্ধুবান্ধবের উদাহরণ দেখিয়ে, সকালে ওঠার উপকারিতা বোঝাতে হবে।’’

সার্বিক বিকাশের বিকল্প উপায়

পঠনপ্রক্রিয়া, মূল্যায়ন পদ্ধতি, বন্ধুতা— সব কিছুরই অনলাইন সংস্করণ চলছে। ফলে, বিভিন্ন পরিস্থিতির উদয় হচ্ছে। যেমন, স্যর অঙ্ক কষানোর সময়ে তাঁর বাড়িতে কেউ শাঁখ বাজিয়ে দিচ্ছেন, শুনে গিগি ফ্যাক করে হাসলে অভিভাবক ঘটনা বুঝে বিরক্ত হচ্ছেন। স্কুলে-বাড়িতে এমন মিলমিশ হয়ে যাচ্ছে দেখে অনেক প্রতিষ্ঠানই নানা নির্দেশিকা এনেছে। ছাত্র ও শিক্ষক উভয়পক্ষই ক্লাসের জন্য আলাদা ঘর, অন্ততপক্ষে নির্জন কোণ বেছে পড়াশোনার পরিবেশ তৈরিতে সচেষ্ট। অভিভাবকেরাও বুঝেছেন, স্কুলের এক্তিয়ারে অযথা ঢুকলে আখেরে বাচ্চারই ক্ষতি। জানাজানি হলে বন্ধুবৃত্তে বা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে সন্তানের মানহানি হবে। শিক্ষাবিদ তথা মডার্ন হাইস্কুলের ডিরেক্টর দেবী করের মতে, অনলাইনেও বাচ্চাদের মধ্যে ‘বন্ডিং’ অটুট। নিজেদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করছে। গুগল ক্লাসরুম বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেই ব্রেকআউট রুমে ছোট ছোট ক্লাসরুমে আলোচনা চলছে। থেমে নেই কিছুই, শুধু স্কুলজীবনটা রূপ বদলেছে। বন্ধুত্বের গতিপ্রকৃতিও বদলের পরামর্শ দিচ্ছেন ডা. রাম। ‘‘অতিমারির সময়ে যাদের পরিবারে অঘটন ঘটেছে, সেই বন্ধুদের ফোন করতে, তাদের সঙ্গে থাকতে উৎসাহ দিন। সহমর্মিতা, সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে শিখবে।’’

অতএব, কিছুই খোয়া যাচ্ছে না

শিক্ষাবিদরা অনলাইন স্কুলপর্বের উপকারই দেখতে পাচ্ছেন। পরিবারের সঙ্গে কাটানোর সময় মিলছে। স্কুলে যাতায়াত, তার প্রস্তুতির সময় বাঁচছে। শৃঙ্খলাপরায়ণ হলে এই সময়টুকু অনেক কাজে লাগানো যায়। ডিজিটাল কেরামতি তো জানা ছিলই, সঙ্গে টাইম ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা বাড়ছে। টেনিস ক্লাস হচ্ছে না, বদলে দূর মাদ্রিদের কোনও প্রতিষ্ঠানে স্প্যানিশ বা মেক্সিকোর দিদিমণির কাছ থেকে সালসা শিখছে। স্থান-কাল-পাত্রভেদ মুছে বিশ্বায়িত পৃথিবীর সুবিধে লাভও আন্তর্জাল শিক্ষাপদ্ধতিরই অবদান। দেবী কর আশাবাদী, এই ব্যবস্থা সাময়িক। অসুখের প্রকোপ কমলে, টিকাকরণ সম্পূর্ণ হলে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খুলবে আগের মতো।

কিন্তু অনলাইন স্কুলিংয়ের মূল অন্তরায় অন্যত্র। তা যে ডিজিটাল বেড়ার মধ্যে আটকে দিয়েছে শিক্ষা ও শৈশবের আনন্দকে। প্রযুক্তির আশীর্বাদ থেকে যারা বঞ্চিত, যার পাড়ায় নেট-সংযোগ ক্ষীণ, বাবা-মার রিচার্জের সামর্থ্য নেই, বহু সংস্থা ও শিক্ষকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও অকালে ফুরিয়ে যাচ্ছে তাদের স্কুলবেলা। দেবী করের আক্ষেপ, এই সুযোগে বাড়ছে স্কুলছুট, শিশুশ্রমিক। বাড়ছে বাল্যবিবাহ। অথচ বেশির ভাগ দেশই অতিমারির স্রোত বাঁচিয়ে স্কুল খুলে রাখার উপায় বার করে ফেলেছে, ফেল করে গিয়েছে এই দুর্ভাগা দেশই।

এখন প্রার্থনা একটাই, বেঞ্চ সরানোর ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে, চক-ডাস্টারের ধুলো উড়িয়ে স্কুল ফিরে আসুক ক্লাসরুমেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Education Corona COVID-19 Online Classes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy