আগের মতো ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে টাকা তোলার চিত্রটি এখন প্রায় বিরল। আজকের প্রজন্ম এটিএম কার্ড ব্যবহারেই অভ্যস্ত। তেমনই পকেটে বেশি টাকা নিয়ে ঘোরার দিনও গিয়েছে ক্রেডিট কার্ডের সুবাদে। বিদ্যুতের বিল জমা করা থেকে শুরু করে সন্তানের স্কুলের ফি, এমনকি মল-এ কেনাকাটা— যাবতীয় লেনদেনের ক্ষেত্রে ভরসা এখন প্লাস্টিক মানি। কিন্তু অনেক সময়ে কার্ড ব্যবহারের কিছু প্রাথমিক শর্ত অনেকে ভুলে যান, যা বাড়ায় জালিয়াতির সম্ভাবনা।
কী ভাবে জালিয়াতি করা হয়?
প্রথমত, এটিএম-এ কার্ড ঢোকানোর জায়গায় ‘ডুপ্লিকেট কার্ড রিডার’ লাগিয়ে রাখা হয়। এর সাহায্যে পিন নম্বর সহ যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নেওয়া যায়। কেনাকাটা বা অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে পয়েন্ট অব সেল (পিওএস) মেশিনে কার্ড সোয়াইপ করার সময়েও একই ভাবে তথ্য হাতানোর চেষ্টা করতে পারে প্রতারকেরা। দ্বিতীয়ত, জালিয়াতি করা সম্ভব নকল পিনপ্যাড ব্যবহার করেও। এ ক্ষেত্রে নকল পিনপ্যাডটি লাগানো থাকে এটিএম মেশিনের যেখানে পিন নম্বর বা টাকার অঙ্ক লেখার বোতাম থাকে। তা ছাড়া, মেশিনে ছোট ক্যামেরা লাগিয়েও পিন নম্বর দেখে ফেলা যায়। এ ছাড়া, এখন আবার ই-মেল বা মেসেজ পাঠিয়ে ব্যাঙ্কের তথ্য জেনে নিচ্ছে ফ্রডরা। অনেকে ফোন করেও সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের নাম বলে ফাঁদে ফেলেন গ্রাহকদের। এমনকি নেটমাধ্যমে ব্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে আসলের মতো দেখতে ব্যাঙ্কের নকল ওয়েবসাইট তৈরি করেও গ্রাহকদের আইডি, পাসওয়ার্ড হাতানোর চেষ্টা করে।
কার্ড ব্যবহারের নিয়ম
প্রাথমিক শর্তগুলি সাধারণত আমাদের অনেকের জানা থাকলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা সব সময় মাথায় রাখা প্রয়োজন।
- যে ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ড সেই ব্যাঙ্কের এটিএম থেকেই সব সময় চেষ্টা করুন টাকা তুলতে। যদি অন্য কোথাও থেকে টাকা তুলতে হয়, সে ক্ষেত্রে দেখে নিন, সেখানে নিরাপত্তরক্ষী রয়েছেন কি না। যদি কার্ড নিয়ে সমস্যা হয়, তাঁকে বলতে পারবেন।
- কিয়স্কে একটিই এটিএম মেশিন থাকলে, টাকা তোলার সময়ে সেখানে দ্বিতীয় কাউকে ঢুকতে দেবেন না। কিন্তু একাধিক এটিএম মেশিন থাকলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন, পিন টাইপের সময় অন্য হাত দিয়ে কি-বোর্ডটা ঢেকে রাখুন।
- মেশিনে পিন দেওয়ার সময়ে দেখুন পিন-প্যাডের উপরের দিকে কোনও ছোট ক্যামেরা লাগানো আছে কি না। দেখে নিন মেশিনে কার্ড ঢোকানোর জায়গায় ডুপ্লিকেট কার্ড রিডার লাগানো নেই তো? সন্দেহ হলেই সতর্ক হতে হবে। পিন টাইপ করার সময়ে আঙুলের বদলে পেনের মাথা বা অন্য কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে।
- যত তাড়াই থাকুক না কেন, মেশিনে কাজ শেষ হলেই বেরিয়ে যাবেন না। পর্দায় ‘ওয়েলকাম’ মেসেজ ভেসে উঠতে দিন। কার্ড ঢোকানোর জায়গায় ফের আলো জ্বলা-নেভা করছে কি না, দেখে নিন। বেরোনোর সময় ‘ক্যান্সেল’ বোতামটি টিপে বেরোন।
- টাকা লেনদেনের যাবতীয় তথ্য পেতে অ্যাকাউন্টের সঙ্গে মোবাইল নম্বর বা ই-মেল যুক্ত করুন। দিনে বা সপ্তাহে অন্তত এক বার মোবাইলে মেসেজ বা ই-মেল চেক করুন। নজর রাখুন কোথাও কোনও অবৈধ লেনদেন হয়েছে কি না। হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং পুলিশে জানান।
- পরিচিত ওয়েবসাইট, অ্যাপ বা দোকান ছাড়া ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করা ঠিক নয়। কার্ড ব্যবহার বা নেটব্যাঙ্কিং-এর সময়ে শুধুমাত্র সুরক্ষাচিহ্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে টাকা পাঠান। লক্ষ রাখুন সাইটটি ‘https://’ দিয়ে শুরু হচ্ছে কি না। এখানে ‘s’ মানে secure বা সুরক্ষিত। যে কোনও অ্যাপ ব্যবহারের আগে সেটা কতখানি সুরক্ষিত সেটা যাচাই করে নিন। এখন প্রায় সব ব্যাঙ্কেরই নিজস্ব অ্যাপ রয়েছে। যেমন এসবিআই-এর ইয়োনো বা এইচডিএফসি-র পেজ়্যাপ। এই অ্যাপগুলি ব্যবহার করার সময়ে জালিয়াতি হলে, আরবিআই-এর গাইডলাইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক আপনার টাকা ফেরত দিতে বাধ্য, এমনটাই জানাচ্ছেন সাইবার বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়। দেড় থেকে দু’মাস অন্তর পিন পাল্টান।
তবে এখন ‘আধার এন্যাবেলড পেমেন্ট সার্ভিস’-এ (এইপিএস) প্রচুর জালিয়াতির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কী ভাবে টাকা চোট হয়? বিভাসের মতে, আধারের ক্ষেত্রে যেহেতু পাসওয়ার্ড হল মানুষের আঙুলের ছাপ (বায়োমেট্রিক), সম্ভবত দুষ্কৃতীরা সেগুলি রেজিস্ট্রি অফিস বা যে সব জায়গায় বায়োমেট্রিক দিতে হয়েছে, সেখান থেকে সংগ্রহ করছে। তার পর তারা জেল ব্যবহার করে আঙুলের ছাপ দিয়ে অ্যাপের মাধ্যমে অ্যাকাউন্টটি অ্যাক্টিভেট করে টাকা তুলে নিচ্ছে। কার্ড বা ব্যক্তিগত প্রোফাইলের ক্ষেত্রে মানুষের কাছে সুযোগ থাকে পাসওয়ার্ড বা পিন পাল্টানোর। সমস্যা হল, বায়োমেট্রিকের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। ফলে, যাঁদেরই এইপিএস-এর সুবিধে রয়েছে, তাঁদের যে কোনও সময়ে দুষ্কৃতীদের খপ্পরে পড়ার প্রবল সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কী করণীয়? বিভাসের মতে, এ ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক লক কাজে আসতে পারে। এর জন্য সাহায্য নিতে হবে আধার ওয়েবসাইট বা এমআধার মোবাইল অ্যাপের। https://uidai.gov.in/en/ সাইটে গিয়ে Aadhar Services-এর মধ্য়ে Lock/Unlock Biometrics-এ ক্লিক করুন। এর পর https://myaadhaar.uidai.gov.in/ সাইটে লগইন করার সময় ঠিক আধার নম্বর এবং মোবাইলে আসা ওটিপি দিয়ে ঢুকুন। তার পর Services-এর মধ্যে Lock/Unlock Biometrics অপশনে গিয়ে নির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক্স লক করতে পারবেন। এমআধার অ্যাপের মাধ্যমে লক করতে চাইলে, অ্যাপ খোলার পরে পর্দার উপরের মেনু থেকে বায়োমেট্রিক সেটিংস-এ গিয়ে ‘এন্যাবেল বায়োমেট্রিক লক’-এ টিক দিলে ফোনে ওটিপি আসবে। সেটা দিলে তথ্য লক করার জন্য সম্মতি চাওয়া হবে। সম্মতি দিলে তথ্য বন্ধ থাকবে ফের যতক্ষণ না সেই ব্যক্তি আনলক করছেন। দুই ক্ষেত্রেই বায়োমেট্রিক তথ্য প্রয়োজনে লক বা আনলক করা যাবে। ফলে যখন কেউ আর্থিক লেনদেন করছেন না, তখন তাঁকে বায়োমেট্রিক লক করে রাখারই পরামর্শ দিচ্ছেন বিভাস। এর পরেও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বেরিয়ে যায় এইপিএস বা ইউপিআই-এর মাধ্যমে, অথচ সেখানে গ্রাহকের কোনও দোষ নেই, সে ক্ষেত্রে তিনি ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া-য় অভিযোগ করতে পারেন। প্রয়োজনে কনজ়িউমার ফোরাম বা সাইবার অ্যাডজুডিকেশনেও যাওয়া যায়। সর্বোপরি সচেতনতা ও সতর্কতাই জালিয়াতি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)