ফ টফট, ড্যাংড্যাং, হিঁহিঁহিঁ, টংটম। দুম-ধপাস। টোঁয়াইং— এমন সব যান্ত্রিক হুটোপাটির শব্দই ভেসে আসছে এখন ছোটদের ঘর থেকে। ২০২০-র এপ্রিলে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, প্রায় ১৫০ কোটি শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। স্কুল বসেছে অনলাইন ক্লাসে। স্ক্রিনের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরিতে স্যর, ম্যাম, বন্ধুরা। সেখানে স্কেল দিয়ে তরোয়াল যুদ্ধ নেই, টিফিনে কুমিরডাঙা বা ছুটির পরে বাস্কেটবল নেই, বন্ধুদের জন্মদিনে নেমন্তন্নও নেই।
কিংবা মুঠোফোন ডেস্কটপের অন্দরের অশরীরী ব্রহ্মাণ্ডটিতে এই সব কিছুই আছে! এক সঙ্গে খেলা, পিকনিক, পোষ্য প্রতিপালন— বাচ্চারা পুরো শৈশবটাই যাপন করছে ভার্চুয়াল পৃথিবীর ছায়াবাস্তবে। অর্থাৎ ই-গেমের দুনিয়ায়। সেখানে রোবলক্স প্ল্যাটফর্মে অ্যাডপ্ট মি কিংবা অন্য গেম যেমন, মাইনক্রাফট, অ্যামং আস, গ্যারেনা ফ্রি ফায়ার, মাই সিমস, পি কে এক্সডি-তে ওরা শহর বানাচ্ছে, আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়ছে, ষড়যন্ত্র ধরছে। মাঠে ময়দানে উঠোনে ঘেমেনেয়ে ছুটে বেড়ালেও কি আর এই হলিউডি অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার বা সাই ফাইয়ের মতো থ্রিল মিলবে? তাই গত দশকেই ই-গেম ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠেছিল। অতিমারির ঘরবন্দি দশায় তা আরও রমরমে। পড়াশোনার জন্য বাচ্চাদের হাতে হাতে ট্যাব, মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ। সেখানেই ক্লাসের ফাঁকফোকরে খুলে যাচ্ছে অনলাইন গেমের বিরাট জানালা। মাল্টিপ্লেয়ার ইউজ়ার প্ল্যাটফর্মের সুবাদে এখন বন্ধুরা আলাদা বাড়িতে বসেও এক সঙ্গেই গেম খেলছে। স্কুলপড়ুয়ারা যতই গেমপ্যাডে সেঁটে ‘মাম্মা ফাইভ মিনিটস মোর’ বলছে, অভিভাবকদের কপালের ভাঁজ বাড়ছে। বাচ্চাদের গেম নিয়ে ভালবাসা আসক্তিতে বদলে যাচ্ছে না তো? গেমিংয়ের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, এক জায়গায় বসে খেলার শারীরিক প্রভাব, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন তাঁরা। তায় এখনও মোমো বা নীল তিমি চ্যালেঞ্জের মতো মারণগেমগুলির স্মৃতি দগদগে। তেমনই কোনও দুর্বৃত্ত যদি বাচ্চাদের আন্তর্জালের চোরাগলিতে ভুলিয়ে নিয়ে যায়? বাচ্চার গেমিং নেশার সম্ভাব্য ফল, আকর্ষণকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, কী ভাবে বাঁচাবেন আন্তর্জালের মায়াজাল থেকে— দিশা দেখালেন বিশেষজ্ঞরা।
অল্টার-অভ্যেস গড়ে তুলুন
গঠনমূলক গেমগুলি বুদ্ধিমত্তা, সৃষ্টিশীলতাকে শাণিত করে। গেমিংয়ে তুখড় হলে ভবিষ্যতে এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত উজ্জ্বল কেরিয়ারও পাওয়া যায়। তবে লক্ষ রাখতে হবে বাচ্চা যেন খেলতে খেলতে জীবনের অন্য দিকগুলি বা পরিবারকে অবহেলা না করে। ডিভাইসগুলি এখন অপরিহার্য, ফলে সেটা তার হাত থেকে কেড়ে নেওয়া যাবে না। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয় রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘ওইটুকু যন্ত্রই শপিং মল, ক্লাব, সিনেমাহল, লাইব্রেরি, রেস্তরাঁ। ফোন ব্যবহার কোরো না মানে বলা বন্ধুর বাড়ি যাবে না, রাস্তায় গিয়ে কাটলেট খাবে না, গান শুনবে না, স্কুলে-লাইব্রেরি যাবে না! সে হয় না। অনলাইন দুনিয়াকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে।’’
মোবাইল বা কম্পিউটারে ঠায় বসে থাকার প্রবণতা কমাতে গেলে বাচ্চাকে মজা করার কিছু বিকল্প উপায় খুঁজে দিতে হবে। ডা. রামের পরামর্শ, ‘‘অসুবিধেগুলো বাচ্চাকে বোঝান। চোখের ক্ষতি হবে জানলে অধিকাংশ বাচ্চাই ভয় পায়। ওদের বলুন শারীরিক কসরতের অভাবে ওজন বাড়লে ভালমন্দ খেতে পারবে না। খাবার টেবিলেও মোবাইলে ঝুঁকে থাকলে অন্যেরা যে তার সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেটাও ওদের বুঝিয়ে বলুন।
‘‘সম্মিলিত ভাবে সকলের জন্য নিয়ম করুন যে, সপ্তাহে তিন-চার দিন কিছু নির্দিষ্ট সময় ‘কেউই ফোন ব্যবহার করব না’। ডিনারের সময়, রবিবার একসঙ্গে খেতে বসে কেউ ফোন ঘাঁটব না। নিয়ম ভাঙলে পাঁচ-দশ টাকা জরিমানা থাকুক। সেই নজরদারির দায়িত্ব ওকেই দিন। ই-গেমের বদলে সেই সময়টায় অন্য কী কী ভাবে আনন্দ করা যায়, দেখিয়ে দিন। একসঙ্গে বই পড়া, গান শোনা, বাড়ির কাজে সাহায্য করা, যোগব্যায়াম, লুডো খেলা, বা নিছক বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করা। পারিবারিক জীবনেই টুকরো টুকরো মজা খুঁজে পেয়ে গেলে গেমের নকল-বাস্তবের ঘোর কেটে যাবে। ‘‘যা-ই করুক, উৎসাহ দিন। বাচ্চার অতিরিক্ত গেমিংয়ের জন্য বাবা-মায়েরা খারাপ আছেন, সমস্যায় পড়েছেন— এ ভাবে বলবেন না, ভাববেনও না। অতিমারির দুঃখ-হতাশা ওর উপরে উগড়ে দেবেন না। ধৈর্য ধরে বোঝান।’’
যদি গেমিং ডিজ়র্ডার হয়?
অতিমারির আগে থেকেই শিশুমননে গেমিংয়ের প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে। চিকিৎসকদের ধারণা, এর থেকে ভবিষ্যতে ‘ডিজ়র্ডার’ হতে পারে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবির মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘পরিস্থিতি সে দিকে যাচ্ছে কি না লক্ষ রাখুন। অনলাইনে খেলার সময় উত্তরোত্তর বাড়লে, অন্য আগ্রহ চাপা পড়লে সতর্ক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে ও নিজে চাইলেও গেমিংয়ের মোহ থেকে বেরোতে পারবে না, স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হবে। মোবাইল কেড়ে নিলে, ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলে ও বিরক্ত হবে, মেজাজ খারাপ হবে, উৎকণ্ঠায় বা অবসাদে ভুগবে।’’
এখন বাইরে গিয়ে খেলা বা অন্য শখ পূরণ করার সুযোগ পাচ্ছে না বেচারারা। সেটাই এই সমস্যার কারণ, আবার চিকিৎসার পথে অন্তরায়ও। ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, ওদের ‘গ্যাজেট স্কিল’ বড়দের চেয়েও বেশি। কাজেই ‘অনলাইনে পড়ছি’ বলে মা-বাবার চোখে ধুলো দিয়ে গেম খেলতেই পারে। শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে পঠনপাঠনের সময়টা বুঝে নিন, পারফরম্যান্সের দিকে নজর রাখুন। ফাঁকি দিচ্ছে কি না ধরতে পারবেন। গেমের নেশায় সন্তান আচ্ছন্ন মনে হলে অন্য কোনও শখে মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত করুন। সকলে মিলে সিনেমা দেখুন, ইউটিউব দেখে রান্না করুন। গেমের বদলে হোমটাস্ক করতেই হবে— এ ভাবে চাপিয়ে দেবেন না। ওই সময়টা একসঙ্গে গান-বাজনা করুন। তার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবস্থা করুন। ওর সঙ্গে আলোচনা করেই গেমের সময়টা নির্দিষ্ট দু’-এক ঘণ্টার মধ্যে বেঁধে দিন। ও ভাববে, ‘‘আমার কথার গুরুত্ব আছে।’’ বলুন, অনলাইনের খুঁটিনাটি আপনাকে দেখিয়ে দিতে। এ ভাবেই নরমে-গরমে নেশার কবল থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। তাতেও কাজ না হলে বা মানসিক সমস্যা হচ্ছে মনে হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।
গেমার মানেই উগ্র নয়
অনেকের ধারণা, গেমের জগতে রেষারেষি করলে বাচ্চার চরিত্রেও আগ্রাসন ফুটে উঠতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘কোন মাধ্যমে খেলছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কী খেলছে। ডিজিটাল বিপ্লবের আগে মহাভারত রামায়ণ দেখেও বাচ্চারা মারামারি করেছে, আহতও হয়েছে। কার্টুন থেকে ভায়োলেন্স শিখেছে। অভিভাবকেরা খেয়াল রাখুন যে খেলায় বেশি মারামারি, পরস্পরের প্রতি আক্রোশ রয়েছে, সে দিকে ওর ঝোঁক আছে কি না। এমন গেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন যেখান থেকে ও খেলার মধ্য দিয়ে গল্প বলা শিখবে। বৌদ্ধিক ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি, স্মৃতি, সামাজিকতা, সহানুভূতি ইত্যাদি সুকোমল বৃত্তিগুলি রপ্ত করবে। বিনোদন এবং কাজ এই দুটোর মধ্যে সুস্থ ভারসাম্য আনতে, সংযম ও সামঞ্জস্য রাখতে শেখান। ও-ই দায়িত্ব নিক, নিজের কাজগুলো শেষ করুক, তার পর কিছু ক্ষণের জন্য খেলুক। গেমে অভিভাবকও অংশ নিন। কেমন গেম খেলছে, ওর কোনটা পছন্দ— বুঝতে পারবেন। অন্য ধরনের কোনও গেমে একসঙ্গে অংশ নিলে ওর খেলার ভাল লাগার ভাষাটা গঠনমূলক ভাবে বদলানোও যাবে।’’
অর্থাৎ অবসরের খানিকটা সময় সন্তান অনলাইনে গেম খেলুক, হুল্লোড় করুক, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড় হয়ে উঠুক। কিন্তু ওই গেমগুলো যেন শিশুকে নিয়ে কোনও ভাবেই ‘খেলতে’ না পারে, তার জন্য ছায়াসঙ্গী হয়ে ওকে রক্ষা করুন আপনিই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy