চোখ পিটপিট করা, মুখভঙ্গি করা, গলা দিয়ে অদ্ভুত আওয়াজ করা—এগুলো যে রোগের পর্যায়ে গণ্য হতে পারে, তা সম্পর্কে অনেকের সচেতনতা থাকে না। উল্টে স্কুলে বা বন্ধুদের দলে, এই আচরণগুলির কারণে হেনস্থার মুখেও পড়তে পারে আপনার সন্তান। অথচ সে যে ইচ্ছাকৃত ভাবে এগুলি করছে, তা নয়। রানি মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘হিচকি’ ছবির দৌলতে টুরেটস সিনড্রোম শব্দবন্ধনী কিছুটা হলেও চেনা হয়েছে। তবে এখনও এই রোগের উপসর্গ বা চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণার অভাব রয়েছে।
টুরেটস সিনড্রোম কী?
এটি বায়োলজিক্যাল জেনেটিক ডিজ়অর্ডার। এর প্রধান সম্ভাব্য কারণ, পরিবর্তিত সেন্ট্রাল নিউরোট্রান্সমিশন। ১৮৮৫ সালে ফরাসি নিউরোফিজ়িশিয়ান জর্জ গিলস দ্য লা টুরেট প্রথম এই রোগটি বর্ণনা করেন। সাধারণত ছয়-আট বছরের শিশুদের মধ্যে রোগের লক্ষণগুলি ফুটে উঠতে শুরু করে। আঠেরো বছরের কমবয়সিদের সাধারণত এই সমস্যা হয়। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে যেতে পারে সমস্যাটি। ছেলেবেলায় এই রোগ হলে, প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তা ফিরে আসতে পারে। তবে তা বিরল। এই রোগের প্রধান উপসর্গ মুদ্রাদোষ বা টিকস। কিন্তু টিকস থাকা মানেই সেটা টুরেটস সিনড্রোম নয়।
উপসর্গ
টুরেটস সিনড্রোমে মূলত দু’ধরনের টিকস দেখা যায়। মোটর টিকস এবং ভোকাল টিকস। চোখ পিটপিট করা, বারবার জিভ বার করা, বারবার ভ্রু উঁচু করা, মাথা-ঘাড় বা কাঁধ ঝাঁকানো, আঙুল মটকানো, হাত মুঠো করা বা লাথি মারা, নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করা—এগুলি মোটর টিকস বলে গণ্য হয়।
গলা খাঁকারি দেওয়া, গলা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ করা, বারবার ঢেকুর তোলা, শিস দেওয়া ভোকাল টিকসের পর্যায়ে আসে। বাড়াবাড়ি হলে রোগী নিজের মনে গালিগালাজও করতে পারেন। টিকসের তীব্রতা সময়বিশেষে কমতে বা বাড়তে পারে।
কখন টিকস, কখন টুরেটস?
কনসালট্যান্ট নিউরোলজিস্ট এবং মুভমেন্ট ডিজ়অর্ডার স্পেশ্যালিস্ট ডা. ভাস্কর ঘোষের মতে, ‘‘টুরেটস সিনড্রোম মানেই রোগীর টিকস থাকবে। কিন্তু টিকস আছে মানেই টুরেটস নয়। চারটি বিষয়ের উপরে টুরেটস সিনড্রোমের ডায়গনোসিস নির্ভর করে।’’ প্রথমত, ব্যক্তির বয়স আঠেরোর নীচে হবে। দ্বিতীয়ত, একাধিক মোটর এবং ভোকাল টিকসের উপসর্গ থাকবে। তৃতীয়ত, টিকস প্রথম দেখা দেওয়ার পরে এক বছর অবধি সেগুলি থাকবে। চতুর্থত, রোগীর টিকসের কারণ কোনও ওষুধ বা অন্য কোনও নার্ভের অসুখ নয় (যেমন হান্টিংটন’স ডিজ়িজ, পোস্ট ভাইরাল এনসেফ্যালাইটিস)। এই চারটি শর্ত পূরণ করলে রোগীর টুরেটস সিনড্রোম আছে বলে গণ্য হবে। টিকস দেখা দেওয়ার এক বছরের মধ্যে সেরে গেলে বা পরবর্তীকালে রোগীর কোনও উপসর্গ দেখা না দিলে, তা টুরেটস বলে গণ্য হয় না।
রোগী কেন টিকস করেন?
ডা. ঘোষের মতে, ‘‘টিকস করার ‘ইনার আর্জ’ তৈরি হয়। ওই আচরণটি করলে রোগী যেন মানসিক স্বস্তি অনুভব করেন। তবে অন্যান্য মুভমেন্ট ডিজ়অর্ডারের সঙ্গে টিকসের বড় ফারাক রয়েছে। যদি রোগীকে টিকস করতে নিষেধ করা হয়, তবে কিছুক্ষণ তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তিনি।’’ দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ বাড়লে টিকসের প্রবণতা বাড়বে। তাপমাত্রার পরিবর্তন হলে, উত্তেজিত করা হলে টিকস বাড়ে। ঘুমের মধ্যেও রোগী টিকস করতে পারেন।
চিকিৎসা
এই রোগের ডায়গনোসিস হয় মূলত রোগের ইতিহাস শুনে এবং রোগীকে দেখে। রক্ত পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান বা এমআরআই করে এই রোগের প্রমাণ পাওয়া যায় না। রোগী বা তাঁর পরিবারের কারও কাছ থেকে কেস হিস্ট্রি জানা হয়। টিকস করার ভিডিয়ো রেকর্ড করে চিকিৎসককে দেখানো হয়। কারণ যখন রোগী চেম্বারে আসছেন, ওই মুহূর্তে তাঁর উপসর্গগুলি না-ও থাকতে পারে।
তবে টিকসের কারণ টুরেটস সিনড্রোম না কি অন্য কোনও রোগ, তা যাচাই করার জন্য কিছু রক্ত পরীক্ষা বা মাথার স্ক্যান করার প্রয়োজন পড়তে পারে।
ডা. ঘোষের মতে, ‘‘যে শিশুদের টিকসের সমস্যা থাকে, তাদের সাধারণত অন্যান্য নিউরো-বিহেভিয়ারাল ডিজ়অর্ডারও দেখা যায়। যেমন, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ়অর্ডার বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভ ডিজ়অর্ডার।’’
যত কম ওষুধ প্রয়োগ করে শিশুদের ভাল রাখা যায়, সেই চেষ্টা করা হয়। যদি কোনও শিশু টিকস সামলেও দৈনন্দিন কাজ সুষ্ঠু ভাবে করতে পারে, তবে তাদের ক্ষেত্রে ওষুধ দেওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু এর কারণে দৈনন্দিন কাজকর্ম, পড়াশোনা ব্যাহত হলে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়।
এই রোগের চিকিৎসায় কাউন্সেলিংয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রফেশনাল কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। বাড়িতে বাবা-মা, অন্য আত্মীয়রা, স্কুলে শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব সকলের এই ধরনের রোগীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদের সমস্যা অনুধাবন করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy