মা হওয়ার আগে যেমন নারীকে একটি দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সন্তান জন্মের পরে সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও সমৃদ্ধ হয়। পোস্টপার্টাম পিরিয়ডে অর্থাৎ সন্তান জন্মানোর পরে, মাতৃত্বের প্রথম ধাপ স্তন্যপান করানো বা ব্রেস্টফিডিং। সদ্যোজাতের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য ব্রেস্টমিল্কের বিকল্প হয় না। পাশাপাশি মা ও সন্তানের আত্মিক যোগ গড়ে ওঠে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তার ‘প্রাইম কেয়ারগিভার’ যে মা-ই, সেই বোধ শিশুর মধ্যে তৈরি হয় ব্রেস্টফিডিংয়ের মাধ্যমে।
গত এক সপ্তাহ অর্থাৎ (১-৭ অগস্ট) পালিত হল ‘ওয়র্ল্ড ব্রেস্টফিডিং উইক’। এ বছর এই উইকের থিম ছিল, ‘সুস্থ গ্রহের জন্য ব্রেস্টফিডিং নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা’। হু (ওয়র্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন) এবং ইউনিসেফ (ইউনাইটেড নেশনস চিলড্রেনস ফান্ড) একযোগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে, মহিলারা যেন দক্ষ ব্রেস্টফিডিং কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য পায়, তা সুনিশ্চিত করার।
সাধারণত শিশুর ছ’মাস বয়স অবধি শুধুমাত্র ব্রেস্টফিডিংয়ের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু চাকুরিরতা মায়েদের পক্ষে তা অনেক সময়ে সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে অন্তত তিন মাস যেন এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং করানো যায়, সে দিকে নজর দিতে বলছেন চিকিৎসকেরা।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ব্রেস্টফিডিংয়ের ক্ষেত্রে কী কী সমস্যা সাধারণত মহিলাদের হয়ে থাকে:
• কলোস্ট্রাম: নতুন মায়ের স্তন থেকে প্রথম তিন-পাঁচ দিন ক্ষরিত হয় কলোস্ট্রাম, যা দেখতে দুধের মতো নয়। কিন্তু শিশুর পুষ্টি ও অনাক্রম্যতা বাড়ানোর জন্য এটি এতটাই উপকারী যে একে বলা হয় ‘গোল্ড মিল্ক’। ডা. চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘অনেক মা-ই দুশ্চিন্তা করতে শুরু করেন, যে তাঁর ব্রেস্টমিল্ক ঠিকমতো নিঃসৃত হচ্ছে না। তাই প্রথমেই কলোস্ট্রামের বিষয়টি তাঁদের বুঝিয়ে দিতে হবে।’’
• স্তনবৃন্ত নিয়ে সমস্যা: অনেক মহিলার নিপল বা স্তনবৃন্ত ফ্ল্যাট হয়। কারও নিপল আকারে বড় হওয়ায় শিশু ঠিকমতো ‘সাক’ করতে পারে না। আবার কারও বা নিপল ইনভার্টেড হয়। তাদের ক্ষেত্রে নিপল শিল্ড ব্যবহার করা হয়, যাতে শিশু ঠিকমতো মায়ের বুকের দুধ খেতে পারে। প্রতিটি হাসপাতালেই এখন ল্যাকটেশনাল বিশেষজ্ঞ নার্স থাকেন, যিনি মায়েদের এই বিষয়ে গাইড করে দেন। আরও একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে মনে রাখা খুব জরুরি। ব্রেস্টফিড করানোর সময়ে শিশুর নাক যেন ব্রেস্টে চেপে না যায়। সে ক্ষেত্রে তাদের অ্যাসফিক্সিয়া বা শ্বাসরোধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মায়ের স্তনবৃন্ত ও শিশুর নাক থাকবে এক লেভেলে। তাই সতর্ক থাকার জন্য মায়েদের ওই সময়ে মোবাইলে ব্যস্ত না থাকাই বাঞ্ছনীয়, মত চিকিৎসকদের। খাওয়ানোর পরে শিশুর যাতে ঢেকুর ওঠে, সেটা দেখাও ভীষণ জরুরি।
• কর্মরতা মায়েদের জন্য: ডা. চট্টোপাধ্যায় জানালেন, মেটারনিটি পিরিয়ড থেকে ফিরে সদ্য কাজে যোগ দেওয়া মায়েদের তিন-চার ঘণ্টা অন্তর এক্সপ্রেস করে ব্রেস্টমিল্ক ফেলে দিতে হবে। কারণ বাড়ি ফিরে তাঁরা যখন আবার শিশুকে খাওয়াবেন, তখন মিল্কের সাপ্লাই থাকা জরুরি। মিল্ক সাপ্রেস করার ওষুধ দেওয়া হলে মিল্কের পরিমাণ অনেক কমে যায়।
• হাইজিন রক্ষা: ব্রেস্টফিড করানোর আগে ও পরে মায়েদের ব্রেস্ট ও নিপল ভাল করে পরিষ্কার রাখতে হবে। শিশুর শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর নয়, এমন ক্রিম বা ময়শ্চারাইজ়ার লাগালে ক্র্যাকড নিপলের সমস্যাও কম হয়।
• ওজন কমানো: ব্রেস্টফিড করানোর বড় উপকারিতা, এতে মায়েদের ওজন অনেকটা কমতে পারে। শিশুর ব্রেস্টফিডিংয়ের সময়ে একটি ব্রেস্ট থেকে প্রায় ৫০০ ক্যালরি বার্ন হয়।
• ক্যানসার প্রতিরোধে: ব্রেস্টফিড করালে ব্রেস্ট ক্যানসার ও ওভারিয়ান ক্যানসারের ঝুঁকি কম।
শারীরবৃত্তীয় সমস্যা ছাড়াও প্রসব-পরবর্তী সময়ে মানসিক চাপ বাড়তে থাকে মায়েদের। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অভিরুচি চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘অনেক সময়ে কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ খাওয়ার জন্য বা কোনও অসুস্থতার জন্য মা হয়তো সন্তানকে স্তন্যপান করাতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে মনে হয়, তাঁরা পূর্ণ মা হয়ে উঠতে পারলেন না। বিষয়টিকে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবে দেখা উচিত।’’
মডেলিং, গ্ল্যামার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের ‘বডি ইমেজ’ নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত একটি প্রশ্ন। তবে ব্রেস্টফিডিংয়ের উপকারিতা সম্পর্কে প্রত্যেকের অবহিত হওয়া জরুরি। ডা. চট্টোপাধ্যায়ের মতে, তখন মহিলাদের এক্সপ্রেস মিল্ক খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
সাধারণত সংক্রমিত মাকে (হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত) ব্রেস্টফিড করাতে বারণ করা হয়। এপিলেপ্সির ওষুধ খান যাঁরা বা অন্য কোনও মুড ডিজ়অর্ডারের, তাঁদের ক্ষেত্রেও ব্রেস্টফিড করানো ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই ধরনের সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
ব্রেস্টমিল্ক থেকে শিশুর যদি অ্যালার্জি হয় বা ল্যাকটোজ় ইনটলারেন্স হতে থাকে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
প্রসব-পরবর্তী সময়ে ডায়েট
যে সব মহিলা ব্রেস্ট ফিড করান, তাঁদের ডায়েট কিন্তু একজন প্রেগন্যান্ট মহিলার ডায়েটের মতো হবে না। ডায়াটিশিয়ান কোয়েল পাল চৌধুরীর মতে, ‘‘যদি কোনও মা এই সময়ে নিরামিষাশী হন, তাঁর জ়িঙ্ক ও আয়রনের সরবরাহের জন্য ড্রাই ফ্রুটস, ড্রাই বিনস, বাদাম ও ডেয়ারি প্রডাক্ট খাওয়া খুব জরুরি।’’ আবার এই পিরিয়ডে যাঁরা ভিগান, তাঁদের জন্য ভিটামিন বি-১২ সাপ্লিমেন্ট নেওয়া জরুরি, যাতে শিশুর শরীরে এই ভিটামিনের ঘাটতি না হয়।
যে মায়েদের খাবারে আলাদা করে বাছবিচার নেই, তাঁদের ডায়েটে হাই প্রোটিন, ওমেগা থ্রি, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, জ়িঙ্ক ও ম্যাগনেসিয়ামের ব্যালান্স ঠিক রাখতে হবে। পাশাপাশি প্রসেসড ফুড, কফি, চা, অ্যালকোহল, চকলেট, বেশি মশলা দেওয়া খাবার না খাওয়াই ভাল।
শিশুর ঠিক বয়স পর্যন্ত স্তন্যপান করানো যেমন জরুরি, তেমনই কখন তাকে সিরিয়াল জাতীয় খাবারে অভ্যস্ত করতে হবে, সেটা নিশ্চিত করা মায়ের দায়িত্ব। কারণ দু’-তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ব্রেস্টফিড করলে তাদের ব্রেস্টমিল্কের উপরে নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। ডা. অভিরুচির মতে, ‘‘সে ক্ষেত্রে মা ও শিশু দু’জনেরই সমস্যা হয়। বিশেষত, দ্বিতীয় সন্তান এলে দুই সন্তানের মধ্যে ঈর্ষা বাড়তে থাকে।’’ তবে দু’বছর পর্যন্ত ব্রেস্টফিড করালে শিশুর বাড়তি উপকার হয় না, উপরন্তু মায়ের শরীরে ক্যালশিয়ামের মাত্রা কমতে থাকে।
স্তন্যপান করানোর মধ্য দিয়ে শিশুর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা গড়ে তোলার দায়িত্ব তাই মায়েদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy