জীবন চলছে না আর সোজা পথে। ঘোরানো পথটাই এখন ‘নিউ নর্মাল’। দৈনন্দিন যাপনের সঙ্গে যখন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজ়ার... কিংবা বাড়ির বেডরুমটাই যখন অফিসের ওয়র্কস্টেশনে পরিণত হয়েছে গত তিন মাসে, তখন এই ‘নিউ নর্মাল’কে অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘আনলক ওয়ান’ পর্বে জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও যখন ‘স্বাভাবিক’ হওয়ার মুখে, তখন রোজকার বাজারে কিংবা কাজে বেরোলেই মুখোমুখি হতে হচ্ছে নতুন নিয়মকানুনের। প্রায় ফাঁকা বাস কিংবা শপিং মল মনে করিয়ে দিচ্ছে, আগের মতো নেই আর চারপাশটা। এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কতটা কঠিন? মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাই বা কী?
চার দেওয়ালের অন্দরে
যাঁদের নিতান্ত উপায় নেই, তাঁদের বেরোতেই হচ্ছে। আর যাঁরা চার দেওয়ালের মধ্যে বসেই অফিসের কাজ কিংবা সন্তানের অনলাইন ক্লাস সামলাচ্ছেন, তাঁদের চাপ খানিকটা হলেও বেশি। কারণ এই নতুন ধরনের স্বাভাবিকতায় বাড়ির ছোট-বড় কেউই অভ্যস্ত নয়। ফলে কাজ ভাগ করে নেওয়া, নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে কাজে বা ক্লাসে মন দিতেও বেগ পেতে হচ্ছে। মডার্ন হাই স্কুলের ডিরেক্টর শিক্ষাবিদ দেবী করের কথায়, ‘‘যারা শিখছে, শুধু সেই ছাত্রছাত্রীরাই নয়, পর্দার ও পারের শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও শেখানোর এই নতুন পদ্ধতি শিখতে হচ্ছে রীতিমতো। লকডাউন এবং তার পরবর্তী সময়টা যেহেতু দীর্ঘ, তাই এতটা সময় পড়াশোনার অভ্যেসে বিরতি দিলে মুশকিল। আগে শিক্ষক কিংবা অভিভাবকরাই বাচ্চাদের বলতেন, কম্পিউটার, ফোন, ল্যাপটপ নিয়ে বেশি সময় না কাটাতে। এখন অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে সেটাই করতে হচ্ছে। তাই এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধান বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। টেকনোলজির দিকে বেশি মনোযোগ না দিয়ে আমরা যেন শেখা এবং শেখানোয় গুরুত্ব দিই।’’ ক্লাসের পরিবেশ অনলাইন টিচিংয়ে কতদূর তৈরি করা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দিহান তিনি। তবে ক্লাসে পড়ানোর পাশাপাশি গল্পচ্ছলে স্টুডেন্টদের সঙ্গে মতের আদানপ্রদানও জরুরি, সেটা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। অনেক ডাক্তার এবং মনোবিদ আবার খুদে পড়ুয়াদের অনলাইন ক্লাস করার পরিপন্থী। এ প্রসঙ্গে দেবী কর বললেন, ‘‘শিশুদের গান, ছড়ার মাধ্যমে শেখাতে হবে। খুব বেশিক্ষণ একটানা ওদের ধৈর্য ধরে বসিয়ে রাখা কঠিন। ওদের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি থাকার কষ্টটা যে আরও বেশি, সেটা বুঝতে হবে।’’
নিজেদের ওয়র্ক ফ্রম হোম আর সন্তানের ক্লাস, প্রজেক্টের রোজরুটিনে নিত্যদিন যুঝছেন ছোটদের বাবা-মায়েরাও। অনেকেই বাড়িতে সেট-আপ করে নিয়েছেন। যাঁদের বাইরে বেরোতে হচ্ছে, তাঁদের ঢাল প্রোটেক্টিভ শিল্ড, মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি। ফ্যাশন ডিজ়াইনার অভিষেক দত্ত বললেন, ‘‘মাস্ক আর গ্লাভস ধীরে ধীরে নিউ নর্মাল ফ্যাশনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। দিনের বেলায় সানগ্লাস আর রাতে পাওয়ারলেস নাইটগ্লাসের ব্যবহারও বাড়বে। লেদার শু-এর পরিবর্তে ওয়াশেবল কাপড়ের জুতো ব্যবহার করা এ সময়ে জরুরি।’’
পেশার প্রয়োজনে ‘টাচ অ্যান্ড ফিল’
হাসপাতাল, রেস্তরাঁ, সালঁর মতো জায়গাই যাঁদের পেশাক্ষেত্র, তাঁদের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। কারণ এই সব ক’টি ক্ষেত্রেই কাজের সূত্রে সরাসরি অন্যের সংস্পর্শে আসতে হয়। লকডাউন ও তার পরবর্তী সময়েও চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিষেবা অবিচ্ছিন্ন থেকেছে। ‘আনলক ওয়ান’ পর্বে অনলাইন কনসাল্টেশনও শুরু করেছেন প্রাইভেট প্র্যাকটিশনাররা। ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিন এক্সপার্ট ডা. অরিন্দম কর যেমন টেলি কনসাল্টেশনে পেশেন্টদের অ্যাডমিশন, অনলাইনে রিপোর্ট দেখে গাইডেন্স দেওয়া শুরু করেছেন। তবে চোখ, ইএনটি, ডেন্টিস্ট্রির মতো ক্ষেত্রে কিংবা যেখানে ‘টাচ অ্যান্ড ফিল’-এর মাধ্যমে রোগীকে নিরীক্ষণ করা জরুরি, সে সব ক্ষেত্রে অনলাইন কনসাল্টেশন কার্যকর না-ও হতে পারে। ‘‘২০১৪ সালে পূর্ব ভারতে প্রথম ইআইসিইউ-এর ধারণা ইন্ট্রোডিউস করেছিলাম। তবে তার জন্য উন্নত মানের পরিকাঠামো দরকার হয়। এই প্যানডেমিকের সময়ে টেলি কনসাল্টেশনে যতটা পারছি সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি,’’ বললেন ডা. কর।
অনলাইন ডেলিভারি নিয়ে আগে প্রায় মাথাই ঘামাতে হত না যে বড় রেস্তরাঁ চেনগুলিতে, তাঁরাও এখন টেকঅ্যাওয়ে আর অনলাইন অর্ডারে আলাদা করে মন দিয়েছেন। সিক্স বালিগঞ্জ প্লেসের অন্যতম ডিরেক্টর শেফ সুশান্ত সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘যেহেতু রেস্তরাঁ খুলে গিয়েছে, তার স্যানিটাইজ়েশন, মেনটেন্যান্স সবই করতে হচ্ছে। সেই তুলনায় ফুটফল আগের চেয়ে অনেকটাই কম। বরং টেকঅ্যাওয়ের হার বেড়ে গিয়েছে। আমরাও সার্বিক চিন্তা করে কিছু ইকনমিক প্যাকেজ, ডেলিভারিতে ডিসকাউন্ট চালু করেছি।’’ সুইগি, জ়োম্যাটোর মতো ডেলিভারি অ্যাপে কিচেনের প্রত্যেক কর্মীর তাপমাত্রা ও শারীরিক অবস্থার নিয়মিত আপডেট দিতে হচ্ছে রেস্তরাঁগুলিকে।
দীর্ঘ দিন বাড়ির বাইরে পা না-রাখা ফ্যাশনিস্তাদের অনেকেই ‘আনলক ওয়ান’ শুরু হতেই পৌঁছে গিয়েছেন সালঁয়। খানিকটা ঝুঁকি ও মনে দ্বিধা নিয়েই সেখানে পরিষেবা দিয়ে চলেছেন বিউটিশিয়ানরা। জুন টমকিন্স সালঁর অন্যতম কর্ণধার ও জুনের কন্যা প্রিসিলা কর্নার জানালেন, তাঁদের কর্মীরা এমন কোনও সার্ভিস এই মুহূর্তে দিচ্ছেন না, যেখানে মাস্ক খোলার প্রয়োজন হয়। বিউটি অ্যান্ড ওয়েলনেস সেক্টর স্কিল কাউন্সিলের সব গাইডলাইন মেনেই তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। ‘‘আমাদের কাছে এটা চ্যালেঞ্জ হলেও সব ধরনের নিরাপত্তাবিধি মেনেই কাজ শুরু করেছি। একসঙ্গে তিন-চার জনের বেশি কাস্টমারকে ঢুকতে না দেওয়া, ক্যাশের বদলে শুধু কার্ডে পেমেন্ট, মাস্ক খুলতে হয় এমন সার্ভিস (যেমন আপার লিপ থ্রেডিং) না দেওয়া... এই সব মেনে চলছি,’’ বললেন তিনি।
নিউ নর্মালের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে অনভ্যস্ত জীবন। তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দেওয়াই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy