কানে কম শুনছেন মনে হলে ফেলে না রেখে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। প্রতীকী ছবি।
বছর তিরিশেক আগের কথা। জনৈক আত্মীয়ার কানে শোনার সমস্যা ছিল, তাঁর বিয়ের সময়ে দেখেছিলাম বিষয়টিকে আড়াল করার যারপরনাই চেষ্টা। কোনও রকমে তা গোপন রেখে বিয়ে হয়ে যায় সুচাকুরে পাত্রের সঙ্গে। কিন্তু ‘কানে খাটো’ হওয়াকে গোপন রেখে বিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে আলোচনা চলতেই থেকেছে...
‘কানে কম শোনা’ এটা জানানোর মধ্যে কেন এত দ্বিধা? এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের মধ্যে যেমন সচেতনতার বিরাট অভাব, তেমনই অবহেলাও রয়েছে। চোখে ভাল না দেখলে চশমা নিতে কালবিলম্ব করি না, কিন্তু কানে কম শুনতে পাওয়ার কথাটা প্রকাশ্যে জানাতে বা হিয়ারিং এড পরতে কেমন যেন একটা সঙ্কোচ বোধ কবজা করে আমাদের। অথচ শ্রবণশক্তির সমস্যাকে ক্রমাগত অবহেলা করে গেলে তা থেকে কিন্তু অন্য রোগও দেখা দিতে পারে, যে বিষয়ে আমরা মোটেই অবহিত নই। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করলেন ইএনটি স্পেশ্যালিস্ট এন ভি কে মোহন।
‘‘কানের প্রতি আমাদের বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ চিরকালীন। দৃষ্টিহীনতার চেয়েও কিন্তু এই সমস্যা আজ আরও বেশি। একটা বয়সের পরে মানুষের চোখে যেমন ছানি পড়ে, তেমনই শ্রবণশক্তি কমবে। পাশাপাশি কিছু অভ্যেসও রয়েছে যা শ্রবণশক্তির ক্ষতি করে। যেমন কানে হেডফোন গুঁজে জোরে গান শোনা, কনসার্টে, নাইট ক্লাবে তীব্র স্বরে মিউজ়িক, ক্রমাগত হর্নের শব্দ... সেই সঙ্গে কানে কটন বাড তো বটেই, চুলের ক্লিপ, সেফটিপিন, কাঠি, চাবি দিয়েও অনেকে কান পরিষ্কার করেন। কিছু দিন আগেই আমার কাছে এক রোগী এসেছিলেন, কানে কটন বাড ঢুকিয়ে ভুলবশত তিনি অন্য কাজে গিয়েছিলেন, কানের পর্দায় ধাক্কা লাগায় পর্দায় দুটো ফুটো হয়ে যায়।অবশ্য শুধু শব্দের কারণে নয়, অটো ইমিউন ডিজ়িজ়ের কারণেও শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। অনেকেই জানেন না, শব্দ দূষণ শুধু শোনাকেই আঘাত করে না, তার থেকে মানসিক ক্লান্তি, দুর্ভাবনাও বাড়ে, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে, রক্তচাপ বাড়তে পারে, হার্টে সমস্যা হতে পারে,’’ সাবধান করলেন ডা. মোহন।
কত জোরে শব্দ ক্ষতিকারক?
দীর্ঘ দিন ধরে যদি কেউ ৮৫ ডেসিবেলের উপরে আওয়াজ শুনতে থাকেন, তা হলে শোনার ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাবে। এ বার ৮৫ ডেসিবেলের মাপকাঠি বোঝা যাবে কী ভাবে? ‘‘ফিসফিস করে আমরা যে কথা বলি, সেটা ৩০ ডেসিবেল, একটি ঘরে চার-পাঁচ ফুট দূরত্বে বসে দু’জনে যদি স্বাভাবিক স্বরে কথা বলেন, সেটা ৬০ ডেসিবেল। কলেজের ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়ায় যখন সকলে বসে কথা বলছে তখন সাউন্ড লেভেল পৌঁছয় ৭০-৭৫ ডেসিবেল। রাস্তাঘাটে খুব হর্নের আওয়াজ, চেঁচামেচি হতে থাকলে শব্দের তীব্রতা পৌঁছয় ৯০-৯৫ ডেসিবেলে। রান্নাঘরের মিক্সির শব্দও ১১০ডেসিবেল! ফোনে কথা বলা, ইয়ারপডে গান শোনা— ডিভাইসগুলো সর্বোচ্চ ভলিউমে শোনা হলে তীব্রতা পৌঁছবে ১০৫-১২০ ডেসিবেলে। এত জোরে টানা দশ মিনিট কিছু শুনলে শ্রবণশক্তির সমস্যা হতে পারে। জিমে বা ক্লাবেও যে মিউজ়িক চলে তা ১০০ ডেসিবেলে পৌঁছে যায়। সিনেমা হলের সাউন্ডও ১০০ ডেসিবেলের উপরে,’’ ব্যাখ্যা করলেন ডা. মোহন।
ছোটদের ক্ষেত্রে শুনতে অসুবিধে হচ্ছে কি না বোঝার উপায়
শিশু যখন জন্মায়, তখন তার অন্তর্কর্ণের গঠন একদম প্রাপ্তবয়স্কদের মতো। বাচ্চাদের ততগুলোই নার্ভসেল থাকে, যতগুলো প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় থাকবে। অথচ তার ব্রেনের পরিমাপ কিন্তু মাত্র ২৫ শতাংশ, অ্যাডাল্ট সাইজ়ের এক চতুর্থাংশ। নার্ভসেল যতক্ষণ না নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করছে ততক্ষণ আমরা বিভিন্ন স্কিল শিখি না। বাচ্চা যা শোনে, তা অনুকরণ করেই কথা বলতে শেখে। কিন্তু সে ভাল করে শুনতে না পেলে কথা বলবে কী করে? যে বাচ্চা কানে কম শুনছে, সেটা চিহ্নিত করে যত দেরিতে তার চিকিৎসা শুরু হবে তত দেরি করে সে কথা বলতে শিখবে। পশ্চিমি দেশে বাচ্চা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে ইউনির্ভাসাল নিউবর্ন হিয়ারিং স্ক্রিনিং করানো বাধ্যতামূলক, যে পরীক্ষাটিকে বলা হয় অটো অ্যাকস্টিক এমিশনস (ওএই)। ব্যথাহীন এই পরীক্ষা করতে এক মিনিটেরও কম সময় লাগে। তা হলে গোড়াতেই জেনে নেওয়া যায় বাচ্চা ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছে কি না এবং ছ’মাসের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া গেলে বাচ্চার বেড়ে ওঠা কোনও ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বধির বাচ্চাদের জন্য যে ককলিয়ার ইমপ্লান্টের কর্মসূচি রয়েছে, তারও বয়সের সীমা কিন্তু পাঁচ বছর।
এ ছাড়াও ছোটদের নানা কারণে কানে শোনার সমস্যা হতে পারে। বাচ্চাদের সর্দিকাশি লেগেই থাকে। গলায় যেমন টনসিল থাকে, তেমনই নাকের পিছনেও টনসিল থাকে, যাকে বলা হয় অ্যাডিনয়েড। অ্যাডিনয়েড যদি বড় হয়, ঘনঘন সর্দি, মুখ খুলে ঘুমোনো, নাক ডাকা, জ্বর... এ রকম সমস্যা হয়। তখন কানের পর্দার পিছনে জল জমতে পারে, ইনফেকশন হতে পারে। কানে ময়লা জমতে পারে। এ সব থেকেও শ্রবণশক্তির সমস্যা হয়।
কান ঠিক আছে কি না বোঝার উপায়
কানে তালা লেগে যাওয়ার কারণে যদি কখনও শুনতে সমস্যা হয়, তা হলে বাড়িতে হাম টেস্ট করে বোঝা সম্ভব কানে কোনও সমস্যা আছে কি না।মুখ বন্ধ করে উমমম করে শব্দ করতে হবে। খেয়াল করতে হবে, কোন কানে কম শুনছেন। যদি দেখা যায়, যে কানে সমস্যা রয়েছে বলে মনে হয় সে কানে স্বাভাবিক শুনছেন, তা হলে বুঝতে হবে সে রকম সমস্যা নেই। কিন্তু যদি দেখা যায় যে কানে তালা লেগে রয়েছে, সে কানে কম শুনছেন কিন্তু অন্য কানে স্বাভাবিক, তা হলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে। তখন দেরি না করে ডাক্তারের কাছে গিয়ে হিয়ারিং টেস্ট করতে হবে।
সমাধানের পথ
জোরে আওয়াজ শোনা এড়িয়ে চলতে হবে। এমনকি জোরে কথা বলাও ক্ষতিকর। কানের সুরক্ষার দিকটা নিজেকেই খেয়াল রাখতে হবে। খুব আওয়াজ হচ্ছে এমন জায়গায় গেলে বা যাঁরা কারখানায় শব্দের মধ্যে কাজ করছেন, তাঁরা ফোম ইয়ারপ্লাগ পরুন। নোংরা জলে স্নান করবেন না, তাতে কানে ইনফেকশন হতে পারে, কানের পর্দায় ফুটো হতে পারে। কানে কোনও কিছু দিয়ে খোঁচাখুঁচি করা কখনও উচিত নয়। কানে শুনতে সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট করতে হবে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রত্যেককে ইউনির্ভাসাল হিয়ারিং স্ক্রিনিং করানো উচিত। কখন বাবা-মায়েরা সচেতন হবেন যে, তাঁদের সন্তানের শ্রবণশক্তির সমস্যা হতে পারে? বাচ্চা যদি প্রিম্যাচিয়োর জন্মায়, বাচ্চার ওজন যদি দেড় কেজির কম হয়। জন্মের পরে প্রথম এক মাসের মধ্যে শিশুটির আইসিইউ-তে থাকার দরকার হয়েছে। বাচ্চা জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কাঁদেনি বা যদি কোনও ইনফেকশন হয়ে থাকে। মায়ের যদি থাইরয়েডের সমস্যা থাকে বা টর্চ সিনড্রোম অর্থাৎ রুবেলা, টক্সোপ্লাজ়মোসিস ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে, তা হলে সন্তানের শ্রবণশক্তির সমস্যা হতে পারে।
মাম্পস, মিজ়লস, টাইফয়েডের পরে কানে শোনার সমস্যা হতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে টেস্ট করিয়ে নেওয়া উচিত।
বয়সের সঙ্গে কানে কম শোনা স্বাভাবিক। কিন্তু বয়স্কদেরও হিয়ারিং এড পরতে অনেক সময়ে আপত্তি থাকে। তা থেকে কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বাড়ে। শুনতে সমস্যা হয় বলে তাঁরা সামাজিক মেলামেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকেন। তা থেকে ডিপ্রেশন হতে পারে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, এর ফলে ডিমেনশিয়া পর্যন্ত হতে পারে।
তাই কানে কম শুনছেন মনে হলে ফেলে না রেখে অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy