—প্রতীকী চিত্র।
একষট্টি বছরের অশোকের (নাম পরিবর্তিত) কয়েক মাস ধরে কোমরে ব্যথা হচ্ছে। হাত-পাও ঝিনঝিন করে অকারণে। সারাক্ষণ কেমন একটা ক্লান্তি ভাব। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান দেখিয়ে কয়েক বার রক্তপরীক্ষা করিয়ে দেখেছেন হিমোগ্লোবিন-এর মাত্রাটা বেশ কমেছে। আয়রন ট্যাবলেটও খাচ্ছেন, কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। ব্যথার ওষুধ খেয়েও কোমরের ব্যথা সারছে না। শেষে তিনি গেলেন এক অর্থোপেডিকের কাছে। তিনিও সাধারণ কিছু রক্তপরীক্ষার সঙ্গে এলএফটি, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন-ও করতে দিলেন। রিপোর্টে দেখা গেল ক্রিয়েটিনিন-এর মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী এবং এলএফটি-তে টোটাল প্রোটিনে গ্লোবিউলিনের মাত্রাটা বেশি। ওই অর্থোপেডিক অশোককে রেফার করে দিলেন তাঁর পরিচিত এক হেমাটো-অঙ্কোলজিস্টের কাছে। সব রিপোর্ট দেখে তিনি অশোককে বললেন, তিনি সন্দেহ করছেন অশোক হয়তো মাল্টিপল মায়েলোমা-য় ভুগছেন। যদিও নিশ্চিত হতে আরও কিছু পরীক্ষা তিনি দিলেন অশোককে।
ব্লাড ক্যানসার বিভিন্ন ধরনের হয়। তারই একটি হল মাল্টিপল মায়েলোমা। মানুষের রক্তে প্লাজ়মা কোষ যখন অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বেড়ে চলে তখন এই রোগ দেখা দেয়। এর ফলে শরীরের একাধিক অঙ্গ প্রভাবিত হয়। সেই সূত্রেই মায়েলোমা অসুখটির সঙ্গে ‘মাল্টিপল’ কথাটি যোগ করা হয়েছে বলে জানালেন হেমাটো-অঙ্কোলজিস্ট সৌম্য মুখোপাধ্যায়। রোগটি কী ভাবে বা কেন হয়, সেই বিষয়ে এখনও ঠিক ভাবে কিছু জানা না গেলেও তাঁর মতে, এই ক্ষেত্রে জিনগত পরিবর্তনের (জেনেটিক মিউটেশন) একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। মাল্টিপল মায়েলোমা বয়সকালীন রোগ, ষাট বা পঁয়ষট্টি বছরের উপরে মহিলা বা পুরুষ, যে কারও হতে পারে। তবে, অল্পবয়সে যে এই রোগ হয় না তা নয়, যদিও তা খুবই বিরল।
লক্ষণ
মাল্টিপল মায়েলোমা-য় দু’তিনটে লক্ষণ সাধারণত দেখা যায়। এক, ক্লান্তি ভাব, রক্তাল্পতা, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমতে থাকা। চিকিৎসক মুখোপাধ্যায় এ ক্ষেত্রে সতর্ক করলেন যে, অনেক সময়েই রক্তাল্পতার কারণে সাধারণ মানুষ কুলেখাড়ার রস বা ‘ওভার দ্য কাউন্টার’ আয়রন ট্যাবলেট কিনে খান। কিন্তু সব অ্যানিমিয়া যে রক্তে আয়রনের মাত্রা কমের কারণে হয় না, এই বিষয়টিও মাথায় রাখা প্রয়োজন। বিশেষত, মায়েলোমা-র মতো অসুখের ক্ষেত্রে যেখানে রক্তাল্পতাই অন্যতম লক্ষণ। দুই, কোমরে, শিরদাঁড়ার আশপাশে এমনকি পাঁজরের দিকেও ব্যথা হয়, হাত পা ঝিনঝিন করা (নিউরোপ্যাথি)।
এই সূত্রে চিকিৎসক মুখোপাধ্যায় বললেন, “মায়েলোমার রোগীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘প্যাথোলজিক্যাল ফ্র্যাকচার’ হয়। সাধারণত খুব বড় কোনও আঘাত বা দুর্ঘটনার ফলে মানুষের হাড় ভেঙে যায়। কিন্তু মায়েলোমার ক্ষেত্রে সাধারণ চাপেই রোগীর শরীরের হাড় ভাঙতে পারে। তিন, বার বার সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়া। চার, ক্রিয়েটিনিন-এর মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী হতে দেখা যায়। প্রসঙ্গত, কিডনির মধ্য দিয়ে যে প্রোটিনগুলি আমাদের শরীর থেকে ছেঁকে বার হয়, সেগুলি এ ক্ষেত্রে সরাসরি কিডনিতে নেতিবাচক ভাবে প্রভাব ফেলে। তার ফলেই বাড়ে ক্রিয়েটিনিন-এর মাত্রা। তাই মায়েলোমাতে যে দু’টি অঙ্গ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়— হাড় এবং কিডনি।” কিন্তু সচেতনতার অভাবে মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা করান না বলে, রোগীদের অনেকেরই হাড় তো বটেই কিডনিও খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানালেন চিকিৎসক মুখোপাধ্যায়। এই লক্ষণগুলির পাশাপাশি কারও কারও ক্ষেত্রে অযথা ব্লিডিং বা থ্রম্বোসিস-ও হয়ে থাকে।
রোগ নির্ণয়
এই রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রথমেই কিছু রক্তপরীক্ষা এবং বোন ম্যারো টেস্ট করা হয়। এই পরীক্ষায় যদি প্লাজ়মা কোষ দশ শতাংশের বেশি থাকে অথবা টিসু বায়পসি করে যদি প্লাজ়মা কোষের ক্লাস্টার পাওয়া যায়, তা হলে প্রাথমিক ভাবে ধরে নেওয়া হয় রোগীর মাল্টিপল মায়েলোমা হয়েছে। এর পরে সিআরএবি বা ক্র্যাব ক্রাইটিরিয়ার কোনও একটিও পজ়িটিভ হলে নিশ্চিত ভাবে ধরে নেওয়া হয় ওই ব্যক্তির মাল্টিপল মায়েলোমা-র বিষয়টি। প্রসঙ্গত, ক্র্যাব ক্রাইটিরিয়া-য় প্রত্যেকটি বর্ণের একটি অর্থ রয়েছে। যেমন, সি হল ক্যালসিয়াম। মায়েলোমার রোগী হাইপারক্যালসেমিয়ায় ভোগেন, অর্থাৎ শরীরে ক্যালসিয়াম বেশি থাকে। আর হল রেনাল, অর্থাৎ ক্রিয়েটিনিন বেশি। এ হল অ্যানিমিয়া। এবং বি হল বোন বা হাড়ের রোগ। এ ক্ষেত্রে হাড়ে লাইটিক লিশন বা ছিদ্র হওয়ার ফলে হাড়গুলি ক্ষয়ে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সামান্য চাপেও তা ভেঙে যায়। এটাই হল ‘প্যাথলজিক্যাল ফ্র্যাকচার’।
এর সঙ্গে কিছু রুটিন রক্তপরীক্ষাও থাকে। চিকিৎসক মুখোপাধ্যায় বললেন, “মাল্টিপল মায়েলোমা-র ক্ষেত্রে লিভার ফাংশন টেস্ট-এর (এলএফটি) বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই পরীক্ষায় একটি অংশে টোটাল প্রোটিন মাপা হয়। এই টোটাল প্রোটিন-এর একটি অংশ হল অ্যালবুমিন, অন্যটি গ্লোবিউলিন। সাধারণ ক্ষেত্রে অ্যালবুমিন থাকে বেশি এবং গ্লোবিউলিন কম। মায়েলোমায় যেহেতু প্লাজ়মা কোষ এক ধরনের গ্লোবিউলিন নিংসরণ করে, তাই এলএফটি-তে টোটাল প্রোটিনে অ্যালবুমিন গ্লোবিউলিন-এর হার পাল্টে যায়। ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই বিষয়টি যদি মাথায় রাখা যায়, তা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগে থেকে মাল্টিপল মায়েলোমা নির্ণয় করতে সুবিধে হয়। এ ছাড়াও, প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমিউনো-ফিক্সেশন ইলেকট্রোফোরেসিস, প্রোটিন ইলেকট্রোফোরেসিস, সিরাম ফ্রি লাইট চেন রেশিয়ো-র মতো মায়েলোমা স্পেসিফিক পরীক্ষাও করা হয়ে থাকে।
তবে শুধু পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করলেই চলে না। চিকিৎসক মুখোপাধ্যায়ের মতে, তাঁদের জানতে হয় রোগ কী মাত্রায় রয়েছে। বুক বা কোলন-এ ক্যানসারের মতো সলিড ক্যানসারের ক্ষেত্রে যেখানে রোগের মাত্রা প্রাইমারি বা টার্মিনাল হিসাবে ধরা হয়, সেখানে লিউকেমিয়া বা মায়েলোমা-র মতো লিকুইড ক্যানসারের ক্ষেত্রে তা স্ট্যান্ডার্ড, হাই রিস্ক বা আলট্রা হাই রিস্ক হিসাবে মাপা হয়।
চিকিৎসা
চিকিৎসক মুখোপাধ্যায় জানালেন, যে মায়েলোমা চিকিৎসা শুরুর আগে তাঁদের দেখে নিতে হয় রোগী বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের যোগ্য না অযোগ্য (ট্রান্সপ্লাট এলিজিবল না নন-এলিজিবল)। এ ক্ষেত্রে বয়স এবং শারীরিক অবস্থার বিষয়গুলি বেশি প্রাধান্য পায়। যদি রোগী প্রতিস্থাপনের যোগ্য হন, তা হলে সেই মতো ওষুধপত্র প্রয়োগ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রটিয়োজ়োম ইনহিবিটর, ইমিউনো মডুলেটর, স্টেরয়েড-এর মতো তিন-চার ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। কিডনির ক্ষতি আটকাতে যেমন কাজে আসে স্টেরয়েড। ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি দিয়ে তিন-চার মাস পরে চিকিৎসকরা পুনরায় রক্তপরীক্ষা করে দেখে নেন, রোগী কী পরিস্থিতিতে রয়েছে। যদি দেখা যায় রোগটি অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে (কমপ্লিট রেমিশন বা স্ট্রিনজেন্ট কমপ্লিট রেমিশন অথবা ভেরি গুড পার্শিয়াল রেমিশন), তখন রোগীকে বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘অটলোগাস বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন। এ ক্ষেত্রে রোগীকে ‘গ্রোথ ফ্যাক্টর’ নামে একটি ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। এতে রক্তে শ্বেত কণিকা বাড়ে এবং তখন স্টেম সেলগুলি বোন ম্যারো থেকে রক্তে চলে আসে। এ বার বিশেষ মেশিন দিয়ে ওই স্টেম সেলগুলিকে সংগ্রহ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও এক নির্দিষ্ট মাত্রায় ওই সেলগুলি সংগ্রহ
করতে হয়।
এর পরে রোগীর শরীরের খারাপ কোষগুলিকে মেরে ফেলতে তাঁকে একটি হাই ডোজ়ের কেমোথেরাপি দেওয়া হয় বলে জানালেন চিকিৎসক মুখোপাধ্যায়। তার পর আগে সংগ্রহ করে রাখা স্টেম সেলগুলি রোগীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমেই। এ ক্ষেত্রে স্টেম সেলগুলি তাদের স্থান খুঁজে নিয়ে নিজেদের কাজ করতে শুরু করে। এর কিছু দিন পরে পুনরায় দেখা হয়, রোগী কেমন রয়েছেন। কিন্তু যখন এই প্রতিস্থাপন সম্ভব হয় না, তাঁদের জন্য প্রায় এক বছর পর্যন্ত কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। তার পরে চিকিৎসকেরা ‘মেন্টেনেন্স’ প্রক্রিয়া শুরু করেন। এই প্রক্রিয়ায় রোগীকে সারা জীবন লো ডোজ়ের কেমোথেরাপি নিয়ে যেতে হয়, যাতে মায়েলোমা ফিরে না আসে। কারণ চিকিৎসক মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, মায়েলোমা এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। বরং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটিকে আটকে রাখা সম্ভব। প্রসঙ্গত, এ ক্ষেত্রে উনি আরও বললেন যে, স্ট্যাটিসটিক্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গিয়েছে যে, যারা প্রতিস্থাপন করান না তাঁদের তুলনায় যাঁরা করান, তাঁরা আরও দুই থেকে তিন বছর বেশি বাঁচেন।
সুস্থ হলেও
ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে কিন্তু কিছু ওষুধ সারা জীবন খেয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া করতে হয় রুটিন চেকআপ এবং শারীরিক পরীক্ষা। যে হেতু মায়েলোমা রোগীরা অধিকাংশই সংক্রমণে মারা যান, তাই মায়েলোমার রোগীদের প্রতিস্থাপনের পরে নিয়মিত টিকাকরণ (নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি) করতে হয় হেমাটোলজিস্ট-এর পরামর্শ মতো। এ ছাড়া, তাঁরা যে ওষুধ খান তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার ফলে হার্পিস-এর মতো ভাইরাল সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এর জন্য অ্যান্টি ভাইরাল ট্যাবলেট খেতে হতে পারে তাঁদের।
মডেল: ভারতী লাহা; ছবি: অয়ন নন্দী; মেকআপ: চয়ন রায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy