মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে কোনও কারণে রক্তক্ষরণ ঘটলে অক্সিজেন সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। এই কারণে মস্তিষ্কের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে যে ধরনের শারীরিক অবনতি দ্রুত শুরু হয়, সেটাই হল স্ট্রোক। দেহের রক্তের মাত্র দুই শতাংশ মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। কিন্তু মস্তিষ্কের কোষ অত্যন্ত সংবেদনশীল, সেই কারণে অক্সিজেন বা শর্করা সরবরাহে সমস্যা হলে দ্রুত এই কোষগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কের ওই কোষগুলো শরীরের যে-যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করত, ওই সব অংশ তাদের ক্রিয়াশীলতা হারিয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে।
মস্তিষ্কে আঞ্চলিক ভাবে রক্তচলাচল বন্ধ হলে যে স্ট্রোক হয় তাকে ইসকেমিক (Ischemic) স্ট্রোক এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে হওয়া স্ট্রোককে হেমারেজিক (Hemorrhagic) স্ট্রোক বলে। বিশিষ্ট নিউরোলজিস্ট এবং স্ট্রোক-বিশেষজ্ঞ ডা. জয়ন্ত রায় বললেন, “বর্তমানে স্ট্রোকের ঘটনা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে। আগে ষাট বা তারও বেশি বয়সে এই রোগ থেকে সাবধান হতে হত। এখন বয়স চল্লিশ পেরোলেই স্ট্রোকের আশঙ্কা তৈরি হয়। বর্তমানে বয়সের দিক থেকে আর কোনও নিম্নসীমা বা ঊর্ধ্বসীমা নেই।”
তা হলে ভয়ের কারণ কোনগুলো?
সেরিব্রাল অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর দু’ধরনের।
প্রথমত, পরিবর্তনযোগ্য বা মডিফায়েবল— এর মধ্যে প্রথমেই পড়ছে উচ্চ রক্তচাপ, তার পর একে একে আসছে বেশিমাত্রার কোলেস্টেরল, ডায়াবিটিস, অতিরিক্ত ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান, ওবেসিটি বা খুব বেশি ওজন, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব। আর অপরিবর্তনীয় বা নন-মডিফায়েবল কারণগুলোর মধ্যে পড়ছে প্রধানত বয়স এবং পারিবারিক ইতিহাস বা জেনেটিক কারণ। এখন পরিবর্তনযোগ্য কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অনেকাংশে এই রোগের আশঙ্কা কমিয়ে আনা যায়। কারণ চিকিৎসক জয়ন্ত রায় জানালেন, স্ট্রোকের ক্ষেত্রে আশি ভাগই কিন্তু পরিবর্তনযোগ্য কারণগুলোর ফলে হয়ে থাকে। সুতরাং জীবনযাত্রা বদলের মাধ্যমে স্ট্রোকের আশঙ্কা কমিয়ে আনা যায় অনেকটাই।
অভিভাবকদের গাইডলাইন
• টিভি বা মোবাইলের প্রলোভন দেখিয়ে না খাওয়ানোই ভাল
• যদি শক্ত খাবার খেতে অসুবিধে হয়, তবে টক দই, আনাজপাতি বা আপেল সিদ্ধ করে দিতে পারেন
• জাঙ্ক ফুড, মিষ্টিজাতীয় খাবারের পরিমাণের দিকে নজর রাখবেন। তবে মাঝেমাঝে ওদের ট্রিট দেবেন, যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হয়
• বিভিন্ন ধরনের খাবারের সঙ্গে ওদের পরিচয় করান
• টেবলে এমন একটি পদ রাখবেন, যেটা খেতে শিশুটি স্বচ্ছন্দবোধ করে
• কোনও একটি খাবারের পরিমাণ বেশি হলে, অন্য পদ কমিয়ে দিন
কেমন করে বোঝা যাবে কারও স্ট্রোক হয়েছে কি না?
চিকিৎসক জয়ন্ত রায় বুঝিয়ে দিলেন, “এটা বোঝার জন্য চিকিৎসা জগতে একটি সুন্দর ছ’অক্ষরের অ্যাক্রোনিম আছে—BEFAST, এখানে বি ফর ব্যালান্স, ই ফর আই, এফ ফর ফেস, এ ফর আর্মস, এস ফর স্পিচ এবং টি ফর টাইম। দেখতে হবে, কোনও রোগীর হাঁটতে গেলে ব্যালান্স বা ভারসাম্য চলে যাচ্ছে কি না, হঠাৎ একটা চোখের দৃষ্টি চলে যাচ্ছে কি না, মুখের একটা দিক বেঁকে যাচ্ছে কি না, একটা হাতের জোর চলে যাচ্ছে কি না, কথা বলার সময় জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে কি না। যদি এগুলোর মধ্যে কোনও এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা যায়, তা হলে একদম সময় নষ্ট না করে রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। যাতে চিকিৎসকদের হাত থেকে গোল্ডেন টাইম বেরিয়ে না যায়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে অনেক ক্ষতি আটকানো সম্ভব হয়।”
স্ট্রোকের পর প্যারালিসিস
আমাদের মস্তিষ্কে অনেক নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র আছে। যেমন মোটর সেন্টার, স্পিচ সেন্টার, ভিশন সেন্টার ইত্যাদি। সেগুলোর মধ্যে স্ট্রোকের ফলে কোন অংশ কতখানি আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার উপরে নির্ভর করে কোন কোন অঙ্গের ক্রিয়াশীলতা কতটা নষ্ট হবে। ছোটখাটো স্ট্রোকের ক্ষেত্রে সহজেই রিকভারি সম্ভব। কিন্তু বড় স্ট্রোকের ক্ষেত্রে হয়তো প্যারালিসিস সারানো সম্ভব হয় না। তবে স্ট্রোকজনিত আংশিক পক্ষাঘাত সারিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসার জন্য ঠিক ফিজ়িয়োথেরাপি এবং রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের বিশেষ ভূমিকা থাকে।
খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার
আমাদের বাঙালি খাদ্যাভ্যাস খুব ক্ষতিকর কিছু নয়। কিন্তু অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক খাবার খাওয়ার প্রবণতা শরীরের ক্ষতি করে। ডা. জয়ন্ত রায় বললেন, “খাবারের বিষয়ে মূলত যা মনে রাখতে হবে, তা হল টাটকা ফল, আনাজপাতি এবং মাছ। এগুলোই শরীরকে অনেকটা সুস্থ রাখে। খুব স্বাস্থ্যকর ডায়েট ছাড়া চলবে না, এমন কিন্তু নয়। সে রকম মেনে চলা সকলের পক্ষে সম্ভবও নয়। বাঙালির খাবারে সর্ষের তেল থাকে। সেটা কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবে গ্রহণযোগ্য। এতে মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা কোলেস্টেরলের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়।”
আপৎকালে মনে রাখতে হবে
শেষে কয়েকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা ধরিয়ে দিলেন ডা. জয়ন্ত রায়। ‘BEFAST’ নিয়ম অনুযায়ী কারও স্ট্রোক হয়েছে, এমন সন্দেহ হলে—
• মুখে সরবিট্রেট বা এই জাতীয় কোনও রকম ওষুধ দেবেন না। জল বা কোনও কিছুই নয়।
• সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হবে। বাড়িতে ডাক্তার ডাকার মতো ঝুঁকিও নেওয়ার দরকার নেই। তাঁর আসতে দেরি হলে অবস্থার অবনতি ঘটবে।
• রোগীর যদি ডায়াবিটিস থাকে এবং বাড়িতে সুগার মাপার মেশিন থাকে, তা হলে ব্লাডসুগার চেক করে নিতে পারেন। অনেক সময়ে হাইপোগ্লাইসিমিয়া বা সুগার ফল করে যাওয়ার লক্ষণ কিন্তু হুবহু স্ট্রোকের মতোই হয়। সুগার লেভেল খুব নীচে থাকলে চিনির জল ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে যদি রোগীর জ্ঞান থাকে, তার পর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বাকি চিকিৎসা। কিন্তু সুগার লেভেলে সমস্যা না থাকলে মুখে কোনও কিছুই দেওয়া যাবে না।
• অনেকে বলেন, স্ট্রোক হয়েছে, রোগীকে বসিয়ে রাখুন, শুতে দেবেন না, তা হলেই আবার স্ট্রোক হবে— এ কথা একেবারেই মিথ, এর কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। বরং রোগীকে ধীরে ধীরে যে কোনও দিকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রাখাই নিরাপদ। পাশ ফিরিয়ে শোয়ালে মুখে জমা লালা গলায় গিয়ে আটকাতে পারে না, পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
• বাড়িতে রক্তচাপ মেপে নিতে পারেন, তবে অতিরিক্ত কিছু পেলেও প্রেশারের ওষুধ খেতে যাবেন না। যত দ্রুত সম্ভব, অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে হাসপাতালে পৌঁছন।
মনে রাখবেন, এই ধরনের অ্যাটাকে সতর্ক থাকা ও তৎপরতা খুব জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy