বর্ষা নামলেও কলকাতার বাজারে দেখা পাওয়া যাচ্ছে না এমন রুপোলি, চকচকে ইলিশের। ফাইল চিত্র।
বর্ষা এলেই বাঙালির ইলিশ পার্বণ শুরু হয়ে যায়। ভাপা, পাতুরি কিংবা গোবিন্দভোগ চালের গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির সঙ্গে ডিমওয়ালা ইলিশ ভাজা— আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ইলিশের গন্ধে ম ম করে গোটা বাড়ি! তবে এ বছর খানিক মনখারাপ শহরবাসীর। আষাঢ় প্রায় শেষ হতে চলল, অথচ মাছের বাজারে দেখা নেই ইলিশের। মাঝেমাঝে দু’-এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে বটে। তবে সেই বৃষ্টির জেরে এখনও পর্যন্ত জালে ধরা দেয়নি রুপোলি ফসল।
বাংলাদেশ থেকে পদ্মার টাটকা ইলিশ অনেক দিন ধরেই আসছে না (যদিও ক্যানিংয়ের ইলিশ মাঝেমাঝে পদ্মার বলে চালিয়ে দেওয়া হয়)। প্রতিবেশী দেশ থেকে মূলত বরফচাপা হিমায়িত ইলিশই মাঝেমাঝে এ রাজ্যে ঢোকে। কিন্তু তাতে তেমন স্বাদ নেই। ভাজার সময়ও গন্ধে মন-প্রাণ ভরে যায় না। অথচ এখনও পর্যন্ত শহরের প্রায় প্রত্যেকটি বাজারেই বরফের ধোঁয়া ওঠা ওই স্টোরের ইলিশই রয়েছে। চকচকে রাংতার মতো মসৃণ টাটকা ইলিশের অপেক্ষায় ক্রেতা থেকে বিক্রেতা সকলেই।
মনের মতো ইলিশ না হয় এখনও বাজারে আসেনি। কিন্তু বাদলা দিনে ইলিশের বদলে কী উঠছে বাঙালির পাতে? দুধের স্বাদ কোন ঘোলে মেটাচ্ছে বাঙালি? উত্তর কলকাতার মানিকতলা বাজার ঘুরে জানা গেল, ইলিশের অনুপস্থিতিতে পমফ্রেটের একটা চাহিদা তৈরি হয়েছে। কিছু দিন আগেই জামাইষষ্ঠী গিয়েছে। চড়া দামে বরফ দেওয়া ইলিশ কিনেছেন হাতেগোনা কয়েকজন। অধিকাংশেই পমফ্রেট, পার্শে আর গলদা চিংড়ির উপর ভরসা রেখে ছিলেন। বৃষ্টি শুরু হয়েছে কয়েক দিন হল। তার আগে হাঁসফাঁস করা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কলকাতা। ফলে হাঁপিয়ে ওঠা গরমে চিংড়ি খাওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। বাজারে সেই সময় তাই চিংড়ি কম উঠছিল। তবে পমফ্রেট, কাটাপোনা, রুই, কাতলা আর পার্শে বেশ ঢালাও বিক্রি হয়েছে। এখনও হচ্ছে।
কিন্তু দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনই ইলিশের স্বাদও কি আর পমফ্রেট, পার্শে দিতে পারে? প্রশ্ন হল, কবে নাগাদ টাটকা ইলিশের স্বাদ পাবে বাঙালি? মানিকতলা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির জয়েন্ট সেক্রেটারি বাবলু দাস বলেন, ‘‘আমরাও বুঝতে পারছি না কবে মরসুমি ইলিশের গাড়ি ঢুকবে। এই বাজারের কোনও দোকানেই ইলিশ নেই। যা আছে সব আগের স্টোর করা ইলিশ। সেগুলির দামও আগুন। ১০০০-১২০০ টাকা কেজি। পড়েই আছে। এ বার ওই ইলিশ যে একেবারে কেউ কিনছেন না, তা নয়। তবে চাহিদা কম। ডিমওয়ালা ইলিশ নেই তো।’’
ইলিশ নেই বলে মাছের বাজার যে ধূ ধূ করছে এমন নয়। সকাল-সন্ধ্যা যথেষ্ট ভিড় আছে। বর্ষার বাজারে কোন মাছের চাহিদা বেশি তবে? বাবলু জানান, অনেকেই পমফ্রেট কিনছেন। পমফ্রেট বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৮০০ টাকা কেজি দরে। তবে টাটকা ইলিশ চলে এলে পমফ্রেটের দাম কিছুটা কমবে। তখন ৬০০-৭০০ টাকায় বিক্রি হবে। শুক্রবার সকালে মানিকতলা বাজারে গিয়ে খানিকটা আশার আলো দেখা গেল। কিছু ইলিশ ঢুকেছে। প্রতিটি ইলিশ সুন্দর করে প্লাস্টিকের মোড়কে জড়ানো। এই বিষয়টি নতুন। ১৪০০ থেকে ১৬০০ টাকা দাম পড়বে কেজি প্রতি। মাছ ব্যবসায়ীদের দাবি, এই মাছ বাংলাদেশের। তাই দামও একটু চড়া। তবে স্বাদ নিয়ে নাকি কোনও কথা হবে না। একেবারে লা জবাব!
মানিকতলা বাজারে গুটিকয়েক ইলিশ-প্রবেশ করলেও ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজার কিন্তু ইলিশের অপেক্ষায় দিন গুনছে। অন্যান্য বছরে এ সময় কয়েক ঝুড়ি ইলিশ চলে আসেই। এ বছর ইলিশের খরা আছে বলেই মনে করছেন মৎস্য বিক্রেতা শম্ভু দাস। তাঁর কথায় ‘‘আমি শুধু ইলিশ বিক্রি করি না। রুই, কাতলা, পোনা সবই থাকে আমার কাছে। তবে ইলিশ উঠলে বেশ ভাল বিক্রি হয়। এখনও তো বর্ষা তেমন ঝেঁপে নামেনি। সেই কারণে হয়তো ইলিশ আসতে দেরি হচ্ছে। আর ১০-১২ দিন অপেক্ষা করলে চলে আসবে।’’ শম্ভুর দোকানের পাশেই গা ঘেঁষে বসেন মাছ ব্যবসায়ী সনৎ চৌধুরী। তিনিও একই কথা জানালেন। যত দিন না ভাল করে ইলিশ উঠছে ব্যবসাতেও বাড়তি লাভ হচ্ছে না। বরফ দেওয়া ইলিশ আছে বটে। তবে সেগুলির স্বাদ নিয়ে সংশয় আছে। এই ফাঁকে পমফ্রেট আর রুই, কাতলা দেদার বিক্রি হচ্ছে। পমফ্রেট বিকোচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। আবার কম দামেরও পমফ্রেট আছে। তবে মাছের ওজনের উপর দাম নির্ভর করছে। অনেকেই কিনছেন। তবে যাওয়ার আগে এক বার করে ইলিশ কবে আসবে, সেই খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন। ওই বাজারেই ভাল ইলিশ পাওয়া যায় বিকাশ সাউয়ের কাছে। কিন্তু কোথায় ইলিশ! তাই ইলিশের মরসুমে বোয়াল, গুরজালি, ট্যাংরা রাখছেন দোকানে। সঙ্গে কিছু খোকা ইলিশ। কাঁটার ভয়ে আবার খোকা ইলিশও তেমন কেউ কিনছেন না। তবে এখনও সময় পেরিয়ে যায়নি। ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার থেকে কয়েক দিনের মধ্যেই ইলিশের আমদানি হবে। তেমনটাই জানালেন বিকাশ।
ইলিশের সঙ্গে বাঙালির লুকোচুরির একই চিত্র লেক মার্কেট এবং উল্টোডাঙা বাজারেও। লেক মার্কেটেও ইলিশের আকাল। কবে আসবে ঠিক নেই। তবে প্রচুর পরিমাণে পমফ্রেট বিক্রি হচ্ছে। এক একটি পমফ্রেটের ওজন ২৫০-৩০০ গ্রাম। দামও ৭০০-৮০০ টাকা কেজি। অন্য অনেক মাছও রয়েছে। তবে ইলিশ না পেয়ে বেশি করে পমফ্রেট কিনেই বাড়ি ফিরছেন অনেকে। পমফ্রেটের এমন চাহিদা অবশ্য উল্টোডাঙা বাজারে নেই। সেখানেও ইলিশ ডুমুরের ফুল। যা আছে সব হিমঘরের ইলিশ। ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রামের ইলিশের দাম প্রায় ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা। তবে স্বাদ ভাল হবে কি না, ভেবে অনেকেই সেই ইলিশ খুব একটা কিনছেন না। অনুষ্ঠানবাড়ির জন্য লোকে পমফ্রেট নয়, বরং চিংড়ি, পাবদা, ভেটকি বেশি করে কিনছেন। শুধু শহর কলকাতা নয়, মফস্সলের ইলিশের বাজারও মন্দা। সীমান্তের একদম পাশে হলেও বাংলাদেশের ইলিশ কিন্তু এখনও বনগাঁর বাজারে আসেনি। হিমায়িত ইলিশই বিক্রি হচ্ছে ১০০০-১২০০ টাকায়। বারাসাতের বাজারেও টাটকা ইলিশ নেই। যা আছে সব আগের ইলিশ। বরফ জমিয়ে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। তবে মফসস্লে ইলিশের বদলে পমফ্রেট কিংবা পার্শের রমরমা নেই। সারা বছরের মতোই রুই, কাতলা, ট্যাংরা, ভেটকি, ভোলা, শোল, তেলাপিয়া বেশি বিক্রি হচ্ছে।
কলকাতা শহরে বাঙালি খানার রেস্তরাঁর অভাব নেই। ইলিশ নিয়ে বাজারে বাজারে হাহাকারের আবহেও রেস্তরাঁগুলির মেনুতে কিন্তু জ্বলজ্বল করছে ইলিশ পাতুরি, সর্ষে ইলিশ, দই ইলিশ, ইলিশ ভাপা। বাজারে না পেয়ে তাই রেস্তরাঁতেই ইলিশের স্বাদ নিতে ভিড় জমাচ্ছেন খাদ্যরসিকেরা। কিন্তু রেস্তরাঁর হেঁশেলে কোথা থেকে আসছে ইলিশ? বাঙালি খাবারের ঠিকানা ‘সপ্তপদী’র কর্ণধার রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, ‘‘বাংলাদেশ এবং কোলাঘাট, সারা বছরই এই দু’ জায়গা থেকে আমাদের রেস্তরাঁয় ইলিশ আসে। বর্ষায় যে ইলিশ আমরা কিনেছি তা পদ্মার। বাজারে ইলিশ নেই বলে যে চড়া দামে কিনেছি, তেমনও নয়। আসলে আমরা তো একসঙ্গে কয়েক টন ইলিশ কিনি। ফলে ইলিশ পেতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না আমাদের। তবে যে ইলিশ পাচ্ছি সেগুলি যে একেবারে টাটকা, তা নয়। হিমঘরের ইলিশও কিছু আছে। আর একদম জল থেকে তোলা ইলিশের স্বাদও তেমন ভাল হয় না। বরং কিছু দিন বরফের সংস্পর্শে থাকলে ইলিশ খেতে বেশি ভাল লাগে।’’ কলকাতার আরও এক বাঙালি রেস্তরাঁ ‘আহেলি’র মেনুতেও দারুণ সব ইলিশের পদ রয়েছে। রেস্তরাঁ সূত্রে খবর, আপাতত সব হিমঘরের ইলিশই ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তার মানেই এই নয় যে, সেগুলি বছর খানেক ধরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইচ্ছে করেই বরফে রাখা হচ্ছে যাতে আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়।
আগের বছরগুলিতে বর্ষার শুরুতেই মফস্সল থেকে মহানগর, সর্বত্র দাপিয়ে ব্যাটিং করেছিলে ইলিশ। ইলিশের জোগানের ঠেলায় বাজারে ব্রাত্য হয়ে পড়েছিল রুই, কাতলা, পমফ্রেট। বাঙালি শুধু ইলিশেই মজে ছিল। মাছ বিক্রেতারাও তেমনই বলছিলেন। কলকাতার প্রায় সব পাইকারি বাজারে ইলিশ ছাড়া অন্য মাছের জোগান কিছুটা হলেও কমে গিয়েছিল। তাই এ বার এখনও পর্যন্ত ইলিশ না পেয়ে ব্যবসায় খানিক উৎসাহ হারিয়েছেন তাঁরাও। মাছ ব্যবসায়ীদের অনেকেরই প্রশ্ন, ইলিশের বিকল্প কি পমফ্রেট, পার্শে, কাতলা হতে পারে? বেশ বোঝা যাচ্ছে, টাটকা, নধর, প্রমাণ মাপের ইলিশ যত ক্ষণ না বাজারে আসছে, ক্রেতা এবং বিক্রেতা কেউ-ই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy