প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহিত
মার্চ মাসে মা হয়েছেন প্রেরণা। সকলে বলেছিল সন্তানের হাসি দেখলেই মনে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার পাওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রেরণার তেমন মনে হয় না। তার মনে হয় কখন ছেলে ঘুমোবে আর দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়া যাবে! মা হওয়ার পর কি অবসাদে ভুগছেন প্রেরণা। এমন প্রশ্ন তাঁর মনে উঁকি দিয়েছিল। তখন এই নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, গর্ভবতী অবস্থায়ও অবসাদে ভুগেছেন তিনি। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলা হয় প্রিনেটাল ডিপ্রেশন।
সন্তান হওয়ার পর অবসাদ বা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু প্রিনেটাল নিয়ে তেমন হইচই হয় না। তাই অনেকের কাছেই এটা অজানা। সেই ভাবনা থেকে প্রেরণার মনে হয়েছিল, নিজের কথা বাকিদেরকে জানানো প্রয়োজন। যদি এই নিয়ে কথোপকথন শুরু করা যায় তাহলে হয়তো তার মতো অনেক মায়েদের সুবিধা হবে। এই ভাবনা থেকেই ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিয়ো তৈরি করেন প্রেরণা।
প্রেরণা জানালেন, তিনি যে প্রিনেটাল ডিপ্রেশনে ভুগছেন, তা নিজেও বুঝতে পারেননি। কিন্তু তাঁর কথায় কথায় রাগ হতো। শরীরের বিভিন্ন হর্মোনের ক্ষরণ হওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে দেরি হচ্ছিল। অতিমারির উদ্বেগ এবং লকডাউনের বন্দি জীবন আরও বা়ড়িয়েছিল এই অবসাদ। তাঁর মুখ ফুলে কালো হয়ে যায়। ছত্রাকের সংক্রমণে চোখের তলায় কালো ছোপ পড়ে যায়। শরীর এবং চেহারার এত বদল মেনে নিতে পারেননি প্রেরণা। একেক সময়ে তাঁর আয়নায় নিজেকে দেখতে ইচ্ছে করত না, শৌচালয়ে গিয়ে বিনা কারণে কেঁদে ফেলতেন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে রসিকতা করে বলতেন, ‘সবার পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেসন হয়, আমার বোধহয় আগেই হল।’ কিন্তু পরে জানলেন, এই পরিস্থিতি আরও অনেকেরই রয়েছে। তিনি একা নন।
‘‘সকলে আমাকে বলেছিল, খুব আচার খেতে ইচ্ছে করবে। কেউ কিন্তু বলে দেয়নি, আমার স্বভাব খিটখিটে হয়ে যাবে। আমাদের সমাজে মায়েরা বোধহয় এ বিষয়ে কথা বলতে অপরাধবোধে ভোগে। তাই সত্যিটি কেউ বলে না। এতে হবু মায়ের কখনওই বুঝতে পারেন না। গর্ভবতী অবস্থায় ঠিক কী আশা করা যায়? এই কারণেই আমি ভিডিয়োটি বানাই,’’ বললেন প্রেরণা।
প্রেরণা মনে করেন, কথা বলে মন হাল্কা করলেও অনেকটা উপকার পাওয়া সম্ভব। কিন্তু নিকট আত্মীয় বা স্বামীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা না বলে যদি অন্য মায়েদের বা বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা যায়, তা হলে একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া সম্ভব।
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সাফ জানিয়ে দিলেন, পেশাদার মনোবিদ বা স্ত্রীরোগ চিকিৎক ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে এ বিষয়ে কথা না বলাই ভাল। কারণ, বাকিরা যে পরামর্শ দেবেন, সেটা মনের মতো না-ও হতে পারে। ‘‘আমাদের সমাজে একটা মেয়ে মা হয়ে গেলেই, মাকে সব সময়ে সেকেন্ড বেঞ্চে পাঠিয়ে দিই আমরা। সব আলোচনাই বাচ্চাকে ঘিরে চলতে থাকে। কথায় কথায় জিজ্ঞেস করি, বাচ্চা নড়ছে তো। মা যে অবসাদগ্রস্ত হয়ে নড়তে পারছেন না, তা নিয়ে কারও কোনও খেয়াল নেই,’’ বললেন অনুত্তমা।
তিনি জানালেন বহু গর্ভবতী মহিলাই প্রিনেটাল ডিপ্রেশন নিয়ে তাঁর কাছে আসেন। অনেক হয়তো বুঝতে পারেন না, কোনটা অবসাদের লক্ষণ। তাই কিছু বিষয়ে চোখে পড়লে যে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, জানালেন অনুত্তমা।
১। ঠিক মতো ঘুম না হওয়া
২। খাওয়ার অনিচ্ছে তীব্র আকার নেওয়া
৩। একটুতেই বিরক্তি বা রেগে যাওয়া
৪। হঠাৎ মেয়ে থেকে মা হওয়ায় ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে। তাই নিয়ে আত্মসংশয় তৈরি হওয়া
৫। মা ছাড়াও তার অনেকগুলি পরিচয় রয়েছে। সব একসঙ্গে সামলাতে পারব কিনা, তাই নিয়ে চরম উদ্বেগ তৈরি হওয়া।
৬। যদি অবসাদের কোনও ইতিহাস থাকে বা প্রেগন্যান্সি নিয়ে কোনও রকম শারীরিক জটিলতা থাকে, সে ক্ষেত্রেও প্রিনেটাল ডিপ্রেশন আরও তীব্র আকার নিতে পারে।
কেন প্রিনেটাল ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা কম
‘‘বাবা-মায়ের গুরুত্ব সমান হলেও মেয়েদের জীবনে মাতৃত্ব যতটা বদল আনে, ছেলেদের ক্ষেত্রে ততটা হয়তো আনে না। একজন মা হওয়ার জন্য কতটা ভিতর থেকে প্রস্তুত ছিলেন এবং কতটা সমাজের চাপে মাতৃত্বের ভূমিকায় নামলেন, সেটাও একটু তলিয়ে দেখা দরকার। মাতৃত্ব নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব থাকলে গর্ভবতী অবস্থায় তার মধ্যে নানা ধরনের আবেগের পরিবর্তন চলতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যিনি মা হতে চেয়েছিলেন, তাঁরও শরীরে এমন কিছু বদল ঘটছে যে, সে নিজেকে অসুন্দর ভাবতে শুরু করে। কিন্তু সমাজে মাতৃত্বকে এমন সিংহাসনে বসিয়ে রাখা হয় যে, সে নিজের কাছেই এমন কথা উচ্চারণ করতে ভয় পায়,’’ বললেন অনুত্তমা।
অনুত্তমা জানালেন, প্রিনেটাল ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে অপরাধবোধ জড়িত। অনেক সময়ে সেই অপরাধবোধ হবু মায়েদের মনে জোর করে ঢুকিয়েও দেওয়া হয়। ‘‘কোনও ভাবেই নিজেকে দোষারোপ করা উচিত নয়। কারণ, পরে গিয়ে এই আবেগগুলিই আরও ভয়ানক রূপ ধারণ করতে পারে,’’ বললেন তিনি।
অতিমারি এবং হবু মায়েদের অবসাদ
করোনাকালে মা হওয়ার উদ্বেগ অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছে। প্রেরণা জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাড়িবন্দি অবস্থা তার অবসাদের পিছনে একটা বড় কারণ ছিল। গর্ভবতী অবস্থায় যদি কোভিড ধরা পড়ে এই ভয়ে তাড়িয়ে বে়ড়ায় হবু মায়েদের। তাই প্রিনেটাল অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগ অনেক বাড়ছে।
মা হওয়ার সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ১৫ দিন আগে কোভিড পরীক্ষা করাতে হয়। কারণ কোভিড থাকাকালীন অ্যানাস্থেশিয়া করার বিধি-নিষেধ রয়েছে চিকিৎসামহলে। তাই হবু মায়েরা এই সব বিষয়ে নিয়েও সারাক্ষণ বাড়তি চাপে থাকছেন। সেই কারণেই এই গর্ভবতীদের মধ্যে অবসাদ বেড়েছে করোনাকালে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy