ছবি: জয়দীপ দাস।
ছোটদের শারীরিক সমস্যা নিয়ে আমরা যতটা চিন্তিত, মানসিক সমস্যা নিয়ে ততটা নই। ওদেরও যে মানসিক রোগ হতে পারে, সেটা মানতেই আমাদের কোথাও আটকায়। কিন্তু শিশুদের মানসিক সমস্যার হার গোটা পৃথিবীতে ক্রমশ বাড়ছে। তাই বাবা-মায়েদেরও সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের গতিপ্রকৃতি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম জানালেন, একদম শিশু থেকে টিনএজার, সকলেরই মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে। সদ্যোজাত থেকে পাঁচ, পাঁচ থেকে বারো এবং টিনএজ— বয়সের অনুপাতে এই তিন ভাগে ভাগ করা হয় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে।
জন্ম থেকে পাঁচ
এই বয়সের শিশুদের মধ্যে মানসিক সমস্যা কমই দেখা যায়। তবে একেবারে বিরল নয়। কিন্তু এত ছোট শিশুর মানসিক সমস্যা বোঝা কি সম্ভব? বিশেষত শিশুর বয়স যদি তিন বছরেরও কম হয়? মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর আচরণ দেখে বুঝতে হবে তার মানসিক স্বাস্থ্য। ‘‘একটা শিশু তার স্বাভাবিক আচরণের বাইরে গিয়ে কিছু করলে বুঝতে হবে তার কোথাও সমস্যা হচ্ছে। যে শিশুটি বিছানায় প্রস্রাব করা বন্ধ করে দিয়েছিল, সে ফের তা করতে শুরু করেছে বা ঘুমের মধ্যে ভয় পাচ্ছে, বাড়িতে সারাক্ষণ মায়ের পিছনে ঘুরছে। এই রকম কিছু লক্ষণ দেখে বোঝা যেতে পারে শিশুটির কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে,’’ ব্যাখ্যা করলেন জয়রঞ্জন রাম। মানসিক সমস্যার নেপথ্যে জেনেটিক কারণ থাকতে পারে। তা ছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে— বাবা-মাকে কাছে না পাওয়ার জন্য শিশুর মধ্যে অ্যাংজ়াইটি দেখা দিতে পারে। এটাকে বলা হয় সেপারেশন অ্যাংজ়াইটি। যে শিশু বাড়িতে নির্যাতিত হয়, ঠিক মতো খেতে পায় না, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়— তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
তবে এই বয়সে সাধারণত ডেভেলপমেন্টজনিত (হাঁটা, কথা বলা) সমস্যাতেই বেশি ভোগে শিশুরা। এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার)-র সমস্যাও এই বয়সের শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন।
পাঁচ থেকে বারো
সমীক্ষা বলছে অতিমারির পর থেকে এই বয়সের শিশুদের মানসিক সমস্যা আগের চেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। ক্লিনিক্ল্যাল সাইকোলজিস্ট দেবারতি আচার্য জানালেন, এই বয়সের বাচ্চাদের মধ্যে ওসিডি, ডিপ্রেশন, প্যানিক অ্যাটাক, বাইপোলার ডিজ়অর্ডারের সমস্যা দেখা দিতে পারে নানা কারণে। স্কুলে হয়তো হেনস্থার শিকার হচ্ছে, বাড়ির পরিবেশ সুস্থ নয়, মা-বাবার মধ্যে সমস্যা, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ইত্যাদি। তবে মানসিক সমস্যার পিছনে সব সময়ে যে সুনির্দিষ্ট কারণ থাকবে, এমনটা না-ও হতে পারে। বাড়ি, স্কুলে কোথাও কোনও সমস্যা নেই, তা-ও বাচ্চার মনখারাপ, এমনটাও হতে পারে।
মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে এই বয়সের বাচ্চাদের মধ্যে দু’ধরনের আচরণগত বদল লক্ষ করা যায় বলে জানালেন জয়রঞ্জন রাম। এক, ইন্টার্নালাইজ়িং ডিজ়অর্ডার। দুই, এক্সটার্নালাইজ়িং ডিজ়অর্ডার। প্রথম ক্ষেত্রে বাচ্চারা নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেয়। পছন্দের খাবারে অরুচি, ভাললাগার কাজগুলোও সে করতে চায় না। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে খিটখিটে মেজাজ, খারাপ আচরণ, ভাঙচুর করার ঘটনা দেখা যায়।
বারো থেকে বয়ঃসন্ধি
টিনএজ খুব স্পর্শকাতর একটা পর্যায়। এই সময়ে শারীরিক ও মানসিক দু’দিক দিয়েই বদল আসে। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজের পরিচয় নিয়ে খুব সচেতন হয়। অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে, কী বলছে এটা তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে কোনও বিচ্যুতি ঘটলে ওদের মনে আঘাত লাগে। এ ছাড়া পাঁচ-বারো বছর বয়সে যে যে কারণে ছোটদের মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হতে পারে, সেই কারণগুলো বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। লক্ষণগুলোও মোটামুটি একই রকমের। এই সময়ে যেহেতু পড়াশোনার চাপ বাড়ে, তাই মানসিক রোগে ভুগলে সেখানে একটা ছাপ পড়ে। এ ছাড়া নিজেকে আঘাত করার একটা প্রবণতা তৈরি হয় এই বয়সে।
সমস্যা থেকে বেরোনোর উপায়
মানসিক রোগকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। কমন মেন্টাল ডিজ়অর্ডার, সিরিয়াস মেন্টাল ডিজ়অর্ডার। বাইপোলার ডিজ়অর্ডার বা স্কিজ়োফ্রেনিয়া গুরুতর সমস্যা। এ সব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং, থেরাপি, ওষুধ সবেরই প্রয়োজন। অন্যান্য ক্ষেত্রে সমস্যার গভীরতা এবং কারণ বুঝে চিকিৎসা পদ্ধতি স্থির করতে হবে।
দেবারতি আচার্য জোর দিলেন বাবা-মায়ের ইতিবাচক মানসিকতা, সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে উৎসাহ এবং স্ট্রেস কাটাতে সন্তানকে সাহায্য করার উপরে। ‘‘সন্তানের ভাল কাজের জন্য প্রশংসা করুন। ও যদি খুব সামান্য চেষ্টা করেও কোনও কাজ করে, সেখানে ওকে উৎসাহ দিন। মা-বাবাকে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। ওর সঙ্গে খেলাধুলো করুন, ছবি আঁকুন। সাধারণত ছোটরা এই কাজগুলোর মধ্য দিয়েই নিজের মনের ভাব ফুটিয়ে তোলে। মানসিক রোগের ক্ষেত্রে বাবা-মাকে খুব সন্তর্পণে সন্তানের সমস্যাগুলো সামলাতে হবে। আর কোনও কারণেই বকাবকি করা চলবে না। ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে হবে, কোথায় তার ভুল,’’ মন্তব্য দেবারতির। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের ডায়েরি লেখার অভ্যেস করানোর পরামর্শ দিলেন তিনি। যাতে কোথাও তারা নিজেদের মনের কথা খোলসা করতে পারে। বাড়ির গণ্ডির বাইরে পড়শি, কাছের আত্মীয়দের সঙ্গেও যেন মেলামেশার সুযোগ থাকে।
মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য সুষম আহার, পর্যাপ্ত ঘুম, খেলাধুলো ও মেডিটেশন প্রয়োজন। তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মা-বাবার সচেতনতা। কাউন্সেলিং বা থেরাপি শুরু করার আগে এ প্রসঙ্গে সন্তানের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলে নিন। ছোট হলেও ওদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। সমস্যাটা বুঝতে পারলে, ও নিজেও চেষ্টা করবে তার থেকে বেরিয়ে আসার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy