প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সম্প্রতি শহরের বুকে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় যেন বেআব্রু হয়ে গিয়েছে র্যাগিংয়ের মতো সমাজের দীর্ঘলালিত কুপ্রথা। কিন্তু এই র্যাগিংয়ের বীজবপন তো অনেক আগেই। তা থেকে যা এখন মহীরুহের আকার ধারণ করেছে, সেই বিষবৃক্ষের শিকড় সমাজের অনেক গভীরে বিস্তৃত। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ র্যাগিংমুক্ত করার পদক্ষেপও কম হয়নি। কাগজে-কলমে পাতার পর পাতা গাইডলাইন তৈরি করলেও তা কি অনুসরণ করা হয়েছে? এই ধরনের মানসিকতা তৈরি হয় কেন? রইল বিশেষজ্ঞদের আলোচনা—
র্যাগিং, বুলিং ও হ্যারাসমেন্ট
বেশির ভাগ মানুষ সচরাচর এই তিন ধরনের মানসিক হেনস্থার শিকার হন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, “র্যাগিং, বুলিং ও হ্যারাসমেন্ট যা-ই হোক না কেন, তার কারণ ক্ষমতা জাহির বা ক্ষমতার প্রদর্শন— শারীরিক, মানসিক হেনস্থা বা গালিগালাজের মাধ্যমে। তবে র্যাগিং, বুলিং ও হ্যারাসমেন্টের মধ্যে সূক্ষ্ম ভাগ আছে। র্যাগিং মূলত প্রাতিষ্ঠানিক। এটা মূলত জুনিয়রদের উপরে করে থাকে সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা। এখানে দলবদ্ধ আচরণ দেখা যায়। এর একটা প্রস্তুতিও থাকে। র্যাগিংয়ের ক্ষেত্রে একটা দলে অনেকজন অংশগ্রহণ করে। তার মধ্যে অনেকে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থাকে। অনেকে কোনও কারণে যুক্ত থাকে। কেউ-কেউ হয়তো র্যাগিংয়ের পক্ষে নয়, কিন্তু সে দলটার মধ্যে থাকতে চায় বলে সে কাজের ভাগীদার হচ্ছে। অনেকে আবার সিনিয়রদের আধিপত্য উপেক্ষা করতে না পেরে তাদের দিকে থাকে। একই হেনস্থা এক ব্যক্তি যদি আর এক ব্যক্তিকে করে এবং করেই চলে, সেটা বুলিং। আর হ্যারাসমেন্ট তো প্রতিটি পদক্ষেপে চলতেই থাকে। কারও গাত্রবর্ণ, জাতপাত, ধর্ম, শ্রেণি, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন... সব কিছু নিয়েই কোনও ব্যক্তিকে হেনস্থা করে অনেকে আনন্দ পান।”
মূলত র্যাগিং, বুলিং, হ্যারাসমেন্টের মোদ্দা কথা হল, একটা দল বা পক্ষ তার চেয়ে দুর্বলতর পক্ষকে দমিয়ে রাখতে চায়। শারীরিক ভাবে দুর্বল হলে এক রকম অত্যাচার, মানসিক ভাবে দুর্বল হলে আর এক ধরনের হেনস্থা... এ ভাবেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে তা ছড়িয়ে আছে। হাসিঠাট্টা, মজার ধরন এক-এক সময় সীমা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এর পিছনে কী ধরনের মানসিকতা কাজ করে?
শিকড় অনেক গভীরে...
কারণটা অনেক গভীরে নিহিত। আইআইটি খড়্গপুরের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবারতি আচার্য বলছেন, “র্যাগিং আর বুলিং যারা করে, তারা মানুষকে এমন কিছু কথা বলে, যাতে মানুষটা দুঃখ পায়, লজ্জা পায়, অপমান বোধ করে— সেটা দেখে আনন্দ পায় তারা। এর ভিতটা বোঝার জন্য ‘স্যাডিজ়ম’ বুঝতে হবে। কিছু মানুষ থাকে, যাঁরা অন্য মানুষকে দুঃখ, কষ্ট পেতে দেখে উত্তেজনা অনুভব করে, তা উপভোগ করে। তবে এমন আচরণ যে কেবল পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়, তা নয়। বিভিন্ন পরীক্ষায় উঠে এসেছে যে, ৫-৬ বছর বয়স থেকেই মানুষের মধ্যে এই ব্যবহার দেখা যায়।”
কিন্তু তাদের মধ্যে এই ব্যবহার কেন দেখা যাচ্ছে? “অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আসলে এরাও বাড়িতে, বন্ধুমহলে বা সমাজের বিভিন্ন স্তরে মানসিক বা শারীরিক হেনস্থার শিকার। ফলে যেটা তাদের সঙ্গে হয়েছে, সেটা অন্যের উপরে করতে পেরে এরা আনন্দ পায়।” তবে শারীরবৃত্তীয় ও পরিবেশগত কারণও এই ধরনের ব্যবহারের জন্য দায়ী। এটা বোঝার জন্য জিন এনভায়রনমেন্ট কো-রিলেশন ব্যাখ্যা করলেন দেবারতি:
ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় আর-একটি দিক উল্লেখ করলেন, “একটা পরম্পরাও তৈরি হয়ে যায় যেন! সিনিয়ররা র্যাগ করেছে বলে পরবর্তীতে জুনিয়ররাও সেটা করে থাকে। আবার অনেক সময়ে দেখা যায়, যে র্যাগিংয়ের শিকার, সে-ই পরবর্তী কালে র্যাগ করছে। আসলে র্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার পরে মানুষের চারিত্রিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখা দেয়। যে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়, তা থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয় অনেকের মধ্যে। তখন সে যখন সিনিয়র হয়, জুনিয়রের সঙ্গে সেই একই কাজ সে করে থাকে। যে ক্ষমতার দাপটের নীচে সে ছিল, সেই ক্ষমতা তখন সে নিজে প্রদর্শনের সুযোগ পায়। এখানে নেশারও একটা বড় ভূমিকা আছে। নেশাগ্রস্ত হলে মানুষ অনেক হিংস্র হয়ে ওঠে। তখন সে অনেক কিছুই করতে পারে।” তাই র্যাগিং বন্ধ করতে চাইলে অনেক দিকে নজর রাখা জরুরি।
দীর্ঘলালিত এই কুপ্রথা সমাজের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রেও হেনস্থার শিকার হন অনেকেই। কিন্তু তা চুপ করে মেনে না নিয়ে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত আওয়াজ তোলা জরুরি। ভয় পেয়ে পিছিয়ে এলে চলবে না। ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী, র্যাগিং, বুলিং দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই প্রয়োজনে আইনের দ্বারস্থ হতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy