ভার: দায়িত্ব সামলাচ্ছেন একাকী মেয়েরা। নিজস্ব চিত্র
‘‘এমআরআইয়ের রিপোর্ট নিয়ে বাবাকে ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই শুরু হয়ে গেল লকডাউন। এখন ঘরের কাজ, বাজার করা, বাবা-মাকে সামলানো, অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি, হন্যে হয়ে চিকিৎসকের খোঁজ— সবই একা হাতে করতে বড় সমস্যা হচ্ছে।’’ বলছেন কলেজশিক্ষিকা সায়ন্তী পোদ্দার। দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, অবিবাহিতা সায়ন্তীর কাছে পরিস্থিতি ক্রমশই ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সঙ্গে সংক্রমণের আতঙ্ক ছাপ ফেলছে মানসিক স্বাস্থ্যেও।
বেঙ্গালুরুর তথ্যপ্রযুক্তিকর্মী সোনালি মুখোপাধ্যায় আবার লকডাউনের আগে নিজেই বাড়ি ফিরতে চাননি। ভেবেছিলেন, বাবা-মায়ের বিপদ বাড়াবেন না। কিন্তু একাকিত্বের জীবনে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিন্তাই এখন কুরে কুরে খাচ্ছে তাঁকে। সঙ্গে রয়েছে ছাঁটাইয়ের আতঙ্কও।
সন্তান দূরে থাকায় রীতিমতো মানসিক চাপে রয়েছেন বেহালার দেবারতি ধর। বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলাকালীনই কলকাতায় চলে আসা দেবারতি সম্প্রতি নতুন চাকরিতে ঢুকে মেয়েকে কয়েক দিনের জন্য রানাঘাটে দাদুর বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। তার পরেই শুরু হয় লকডাউন। ‘‘এক মাস মেয়ে কাছে নেই। হতাশ লাগছে। আমি কোনও ভাবে অসুস্থ হলে ওর কী হবে, ভাবতেই পারছি না।’’— আতঙ্কিত শোনায় দেবারতির গলা।
আরও পড়ুন: বিবর্তিত হতে হতে করোনা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, বলছে গবেষণা
লকডাউন ইতিমধ্যেই গুরুতর প্রভাব ফেলছে মেয়েদের জীবনে। ঘরবন্দি মেয়েরা আরও বেশি করে গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জও জানিয়েছে, এই সময়ে বিশ্বে মেয়েদের উপরে নির্যাতন বেড়ে গিয়েছে ২৫ শতাংশ। নিরাপত্তা, আর্থিক সুরক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য— সব দিক থেকেই মেয়েদের উপরে চাপ পড়ছে বেশি। নিস্তার পাচ্ছেন না শহুরে মধ্যবিত্ত একাকী মেয়েরাও।
লকডাউনের সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বাড়ি থেকে কাজ করার উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে। তার জেরেই মহিলাদের উপরে, বিশেষত একা মেয়েদের উপরে চাপ বেশি পড়ছে বলে মত অনেকের। দেশের একা মেয়েদের একজোট করতে ‘স্টেটাস সিঙ্গল’ নামে একটি অনলাইন পেজ বানিয়েছেন কলকাতার বাসিন্দা শ্রীময়ী কুণ্ডু। রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপও। লেখিকা শ্রীময়ীর মতে, বাড়ির কাজ এবং বাড়ি থেকে কাজ— এ দু’য়ের জাঁতাকলে পড়ে বেশি পিষ্ট হচ্ছেন একাকী মেয়েরাই। অবিবাহিতা, বিবাহবিচ্ছিন্না, স্বামীহীনা, একা থাকা মেয়েদের অনেকেরই কর্মক্ষেত্রে এটা দ্বিতীয় ইনিংস, কেউ কেউ আবার স্বনিযুক্ত। ফলে চাকরি হারানোর ভয় বা কাজ না-আসার ভ্রুকুটি রয়েছে। ‘‘সংসারে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কাজ করলে চাপ কম হয়। কিন্তু একা মেয়েদের সে সুযোগ নেই। সব কিছু একার ঘাড়েই এসে পড়ছে। ফলে আতঙ্ক জাঁকিয়ে বসছে।’’— মত শ্রীময়ীর।
এ সময়ে বয়স্ক বাবা-মা অথবা ছোট সন্তানের গুরুদায়িত্বও এসে পড়ছে মহিলাদের একার কাঁধেই। ফলে শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছেন সঙ্গীহীন মেয়েরা। সমস্যায় পড়ছেন অসুস্থ, প্রতিবন্ধী মহিলা বা রূপান্তরকামীদের অনেকেও।
২০১১ সালের জনগণনা বলছে, এ দেশে মেয়েদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে একা থাকা মেয়েদের সংখ্যা (৩৯ শতাংশ)। জনগণনা অনুযায়ী, দেশে অবিবাহিতা মেয়েদের মোট সংখ্যা ১ কোটি ২৩ লক্ষ। শহুরে এলাকায় একা মহিলাদের সংখ্যা প্রায় দু’কোটি ৭০ লক্ষ (বৃদ্ধির হার ৫৮ শতাংশ)। এ রাজ্যে সেই সংখ্যাটা ২১ লক্ষ ৪১ হাজার। দেশে মহিলাপ্রধান পরিবারের সংখ্যাও বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট ‘প্রোগ্রেস অব দ্য ওয়ার্ল্ডস উইমেন ২০১৯-২০২০: ফ্যামিলিজ় ইন দ্য চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড’ অনুযায়ী, ভারতের ৪.৫ শতাংশ পরিবারই চালাচ্ছেন একা মহিলারা (বিশ্বের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ)। ওই সব সংসারে দারিদ্রও বেশি। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩৮ শতাংশ একা মায়ের সংসারেই থাবা বসাচ্ছে দারিদ্র, স্বামী-স্ত্রীর সংসারের ক্ষেত্রে যা শতকরা ২২.৬ ভাগ। ফলে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই লকডাউন আরও বেশি করে আর্থিক-মানসিক বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে একলা মহিলাদের।
আরও পড়ুন: করোনা-পরবর্তী বিশ্ব শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখবে
তবে মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই পরিস্থিতিতে অন্য মহিলাদের থেকে একা মহিলারা যে তুলনায় ভাল আছেন, সে কথা নিজেকে বোঝাতে পারলে মানসিক চাপ কাটানো অনেকটাই সম্ভব। তাঁর কথায়, ‘‘গার্হস্থ্য হিংসা বা বিশাল পরিবারের বোঝা টানার মতো সমস্যার মুখোমুখি কিন্তু হতে হচ্ছে না এঁদের। এটা অনেকটাই স্বস্তির। তাই এ সময়ে নিজেদের পুরনো প্রতিভা, পুরনো বন্ধুত্বকে ফের চাঙ্গা করে তুলুন। সে দিকে মন দিলে মানসিক চাপ কাটবে অনেকটাই।’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy