গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
১) অবলা বসু ও সেই সময় দময়ন্তী দাশগুপ্ত সিগনেট প্রেস
লেডি অবলা বসুর কৃতবিদ্য জীবন নিয়ে সবিশেষ আলোকপাত হয় কি? শুধু দেশের মহিলা চিকিৎসকদের অন্যতমা নন, শিক্ষাবিদ হিসাবেও তাঁর ভূমিকাকে মনে রাখেন ক’জন? এই গ্রন্থে শুধু অবলা বসুর জীবনকেই তুলে আনেননি লেখক, সেই সঙ্গে এনেছেন সমকালের প্রসঙ্গও। সবিস্তার আলোচিত হয়েছে উনিশ শতকের ব্রাহ্ম ও হিন্দু সমাজ, সেই সময়ের দাম্পত্যকথা, ভ্রমণবৃত্তান্তও। অবলা বসুর পরিচয় যে শুধুমাত্র জগদীশচন্দ্র বসুর স্ত্রী হিসাবে নয়, সে কথা মনে করিয়ে দিল এই বই।
২) তাম্বুলি আখ্যান বিশ্বজিৎ রায় ধানসিড়ি
পেশায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক। গুরুগম্ভীর প্রবন্ধকার এ বার লিখেছেন পুরোদস্তুর উপন্যাস। পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজপরিবার আর এক কথক ঠাকুরের সম্পর্কের কাহিনিতে ইতিহাস রয়েছে, তার সঙ্গে মিশেছে কল্পনাও। রাজা সিংহদেব এবং তাঁর কথক তাম্বুলির সখ্যের এই আখ্যানে প্রবেশ করছেন এক ব্রাহ্মণও। দেশে তখন মহাবিদ্রোহের হাওয়া। সেই পরিস্থিতিতে মানভূমের ভূমিতে ব্রাহ্মণভূম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন ব্রাহ্মণ। সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে ষড়যন্ত্র, আমলা-বিন্যাস। তারও কিছু পরে শুরু হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, কংগ্রেসের আন্দোলন। কথকতার কালে মিশছে রাজনীতি। সুবিস্তৃত প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসে ধরা রয়েছে লেখকের নিজস্ব ‘পুরুল্যা’ দর্শনও।
৩) থেরীগাথা স্বাতী ঘোষ সিগনেট প্রেস
আড়াই হাজার বছর আগে যাঁরা ‘স্থবিরি’ বা ‘থেরী’ নামে পরিচিত ছিলেন, সেই সব বৌদ্ধ ভিক্ষুণী পালি ভাষায় রচনা করেছিলেন গীতিকাব্য। বুদ্ধের উপদেশ, সঙ্ঘজীবন, ব্যক্তিগত পরিসরে মেনে চলা নিয়ম-নীতি ছাড়াও সেই কবিতাগুলিতে প্রকাশ পেয়েছিল মেয়েদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। ‘থেরীগাথা’ হয়ে ওঠে বৌদ্ধদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’-এর অঙ্গ। নারীর অধ্যাত্ম অর্জন নিয়ে যেমন কথা বলেছিল এই গাথাগুলি, পাশাপাশি কথা বলেছিল বৌদ্ধধর্মে বর্ণিত অপশক্তি ‘মার’-এর বিরুদ্ধে তাঁদের কর্তব্যের কথাও। সমসময়ের সমাজ ও নারীদের প্রতি পুরুষতন্ত্রের মনোভাবও স্পষ্ট এই সব কবিতায়। অর্থনীতির অধ্যাপিকা শুধুমাত্র সেই সব রচনার অনুবাদই করেননি, সেই সঙ্গে লিখেছেন ভাষ্য, সেগুলির প্রেক্ষাপট ও টীকা। বাংলা ভাষায় বৌদ্ধধর্ম চর্চার ধারাটি এখন ক্ষীণ। এই বই সেই ধারায় এক নতুন স্রোত।
৪) শ্যামা নাট্যকথা শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় চার্বাক-হরপ্পা
তুলনামূলক সাহিত্যের পণ্ডিত বেশ কিছু কাল নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন মহাভারত চর্চায়। লিখেছেন তা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই। কিন্তু এ বার আর মহাভারত নয়, তুলে আনলেন রবীন্দ্রনাথকে। তা-ও আবার একটি মাত্র টেক্সট— ‘শ্যামা’। বৌদ্ধগ্রন্থ ‘মহাবস্তু অবদান’ থেকে রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করেছিলেন ‘শ্যামা’র কাহিনি। মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বণিক বজ্রসেন, নটী শ্যামার কাহিনি বৌদ্ধ শাস্ত্রের মধ্যেই যেন ঘুমিয়ে ছিল। তার ঘুম ভাঙালেন রবিঠাকুর। এক বার নয়, তিন বার। কাহিনিকাব্য ‘পরিশোধ’, নাট্যগীতি ‘পরিশোধ’ এবং নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’য় একই কাহিনিকে ফিরিয়ে আনলেন কবি। কেন? সেই কারণ সন্ধানের সমান্তরালে গ্রন্থকার তুলে এনেছেন ধ্রুপদী ট্র্যাজেডির প্রসঙ্গ, তার সূত্রে আলোচিত হয়েছেন অ্যারিস্টটল থেকে শেকসপিয়রও। বাদ পড়েননি বাল্মীকি বা ভবভূতিও। সাম্প্রতিক সময়ের রবীন্দ্রচর্চার নিরিখেও ‘শ্যামা’কে দেখেছেন লেখক। একটি মাত্র ‘টেক্সট’কে ঘিরে এতখানি বিস্তৃত চর্চা বাংলা ভাষায় বিরল।
৫) বীরেশ্বর সামন্তর হত্যা রহস্য শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য সুপ্রকাশ
নামে ‘হত্যা রহস্য’ হলেও এই উপন্যাস আদৌ কোনও গোয়েন্দা কাহিনি নয়। বরং এই আখ্যান সমাজের প্রান্তবাসী কিছু মানুষের জীবনের কথা বলে, যেখানে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, রিরংসা, লোভ, কামের চিরকালীন ওঠানামা। আসলে এই আখ্যান রাজনৈতিক। বৃহৎ অর্থেই এখানে ক্ষমতা ও তার পালটা ক্ষমতার ঘাত-প্রতিঘাত বুনে দেয় জটিল নকশা। সেই নকশায় বাঁধা থাকে কিছু জীবন। জনপদের প্রতাপশালী বীরেশ্বরের মৃত্যুরহস্যের চাইতেও বড় রহস্য এখানে মানুষের মনোজগৎ। কাহিনি কথনের প্রথাসিদ্ধ ঋজুগতিকে এড়িয়ে লেখক এখানে এনেছেন অজস্র বাঁক, যা হয়তো কোনও রহস্য কাহিনিই ধারণ করতে পারে, হয়তো নয়। শেষ পর্যন্ত এই বই কি পাঠককে কোনও স্থির সত্যে পৌঁছে দেবে? সম্ভবত না। কারণ, সত্য যে কিছুতেই স্থির নয়, তা এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় বর্ণিত।
৬) ছোঁক অন ফুড, ইকোনমিক্স অ্যান্ড সোসাইটি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (শেন অলভিয়ের চিত্রিত) জাগেরনট
‘ছোঁক’ শব্দটি বাংলা নয়। হিন্দি। এর বাংলা অর্থ— ‘ফোড়ন’। তেলের সঙ্গে মশলা যেমন মেশে, তেমনই এ বইতে ব্যক্তিগত স্মৃতির সঙ্গে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং অবশ্যই রন্ধনশিল্পী লেখক মেশালেন রান্না-খাওয়া আর সমাজকে। মিশে গেল পালংশাকের ঘণ্টর সঙ্গে প্রয়াত মায়ের স্মৃতি। অথবা মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানার সঙ্গে, যৌথ পারিবারিক পরিসরে ঠাকুরদার কাছ থেকে গল্প শোনা আর রাঙা আলুর স্ট্যু। একাধারে এই বই স্মৃতিকথা, সমাজ-অর্থনীতির ভাষ্য আর রসনাতৃপ্তির মানচিত্র। সঙ্গে রয়েছে শেন অলভিয়েরের চিত্রণ। সব মিলিয়ে অভিনব প্রয়াস, সন্দেহ নেই।
৭) লোরেঞ্জো সার্চেস ফর দ্য মিনিং অফ লাইফ উপমন্যু চট্টোপাধ্যায় স্পিকিং টাইগার
আমলার কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। কম লিখলেও ‘ইংলিশ অগস্ট: অ্যান ইন্ডিয়ান স্টোরি’র লেখক এখনও যে গল্প বলায় নজর কাড়েন, তার প্রমাণ এই বইতে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে ইটালির এক কিশোর দুর্ঘটনায় আহত হয়ে কয়েক মাস শয্যাশায়ী ছিল। সেই অবস্থাতেই তার মস্তিষ্কে জেগে ওঠে আত্মজিজ্ঞাসা। সেই জিজ্ঞাসাই তাকে ক্রমে টেনে নিয়ে যায় জীবনার্থ সন্ধানের দিকে। এক সময়ে এক ধর্ম সম্প্রদায়ের কাজ নিয়ে সে এসে পড়ে বাংলাদেশের খুলনায়। ঈশ্বরচিন্তা, উপাসনা আর নিয়মের নিগড়ে বাঁধা জীবনের মাঝে উঁকি দিয়ে যায় প্রেমও। চিরন্তন দার্শনিক জিজ্ঞাসার সমান্তরালে এ কাহিনি জীবনের, কখনও বা তাকে অতিক্রম করে আরও বেশি কিছুর।
৮) এশিয়া আফটার ইউরোপ ইম্যাজিনিং আ কন্টিনেন্ট ইন দ্য লং টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি সুগত বসু হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
এলগিন রোডের বসুবাড়ির সন্তান এক সময়ে সাংসদ থাকলেও বিদ্যাচর্চা থেকে দূরে সরিয়ে রাখেননি নিজেকে। তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থটিতে এই ইতিহাস ভাবুক কথা বলেছেন ‘এশিয়া’ নামক মহাদেশের বাসিন্দাদের ‘আত্মপরিচিতি’ নির্মাণের রাজনীতির ইতিবৃত্তকে নিয়ে। বিংশ শতকে এশিয়াকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন তার বাসিন্দারা। নেশন স্টেটের তত্ত্বকে ছাপিয়ে ‘এশীয়’ পরিচিতির উত্থান এবং তার বিলয়কেও দেখেন লেখক। এরিক হবসবম বিংশ শতককে ‘শর্ট টুয়েন্থিয়েথ সেঞ্চুরি’ বলেছিলেন ঘটনাপ্রাচুর্য ও তার গতিশীলতার কারণে। কিন্তু এই বইতে লেখক দেখেছেন এক ‘দীর্ঘ’ শতককে, যার মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধ ও উপনিবেশের বিলুপ্তির পরবর্তী কালের সংঘাত ও সহাবস্থানের প্রলম্বিত ইতিকথা।
৯) রিলিজিয়ন অ্যান্ড উইমেন ইন ইন্ডিয়া, ১৭৮০জ়-১৯৮০জ়: জেন্ডার, ফেথ অ্যান্ড পলিটিক্স তনিকা সরকার পার্মানেন্ট ব্ল্যাক এবং অশোকা ইউনিভার্সিটি
উপনিবেশের কালে এবং উপনিবেশ-উত্তর পর্বে ভারতীয় নারী সম্পর্কে এ যাবৎ লিখিত ইতিহাস যে সাক্ষ্য দেয়, তার মধ্যে বিস্তর উনিশ এবং বিশ রয়ে গিয়েছে। বর্ষীয়ান ইতিহাস চর্চাকারী হিসাবে লেখক সেই ফারাকের দিকেই নজর ফিরিয়েছেন তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে। অঞ্চলভেদে চর্চা ও আলোকপাতের তারতম্য যে রয়ে গিয়েছে, তা স্পষ্টতই তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে। বাংলার নারী যে ভাবে আলোচিত, পঞ্জাবের ক্ষেত্রেও কি সেই একই মনোযোগ পেয়েছেন নারীরা? প্রথাসিদ্ধ নারীবাদের দূরবিন থেকে চোখ সরিয়ে ধর্মকে এক বৃহৎ আঙিনা হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রন্থকার। ‘লিঙ্গ রাজনীতি’র অন্দরমহলে থমকে থাকা ‘অপবিত্র’ বর্গের কথা যেমন উঠে এসেছে আলোচনায়, তেমনই ঠাঁই পেয়েছে গৃহকর্মের নিক্তিতে দেখা নারীদের প্রসঙ্গও। রাজনীতি থেকে সমাজ, সংস্কৃতি, সম্পত্তি বা শাস্ত্র অথবা পোশাক-আশাকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে লিঙ্গ রাজনীতির সবিস্তার খতিয়ান এই বই ভারতীয় উপমহাদেশের নারীকথার এক বিশ্লেষণী জরিপকর্ম।
১০) গোস্টলি পাস্ট, ক্যাপিটালিস্ট প্রেজ়েন্স: আ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ ফিয়ার ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল তিথি ভট্টাচার্য ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস
ভূতেদের কি ইতিহাস থাকে? বাঙালির নজরে ‘তেনারা’ যে সর্বদাই সমান মহিমায় বিরাজ করেননি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থকার এ বইয়ের গোড়াতেই। রবীন্দ্রনাথ বা অবনীন্দ্রনাথের আত্মস্মৃতি থেকে উঠে আসা ব্রহ্মদৈত্য বা শাঁখচুন্নিদের সঙ্গে যে সহাবস্থান এক সময়ে ‘স্বাভাবিক’ ছিল, উপনিবেশের দাপটে তা আর টিকে থাকেনি। বরং পশ্চিমের ছোঁয়া লেগে বদলে যায় বাঙালির ‘ভূত-ভাবনা’। ঝিম ধরা সাঁঝের গল্পের ভূতেরা উধাও হয়ে যায় ইউরোপ থেকে উড়ে আসা প্ল্যানচেট বা সিয়াঁসের দাপটে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের লুল্লু বা নাকেশ্বরীর মতো ফুরফুরে ভূতেদের জায়গা দখল করে গম্ভীর, বিষাদময় প্রেতাত্মার দল। বদলে যায় বঙ্গজনের ভয় পাওয়ার ইতিবৃত্ত। শিশুসাহিত্য থেকে সেই সব প্রেতেরা ছায়া ফেলে ‘বড়দের’ সাহিত্যে। বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন কানাচ নিয়ে চর্চা হলেও ভয়ের জগৎটি বিদ্যাচর্চার আঙিনায় খানিক অপাঙ্ক্তেয়ই ছিল বলা যায়। এই বইয়ে সেই অভাবটাই যেন পূরণ করলেন গ্রন্থকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy