গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
১) প্রতিরোধের ভাষ্য: শ্রীহেমেন্দ্রনাথ মজুমদার/ অনুরাধা ঘোষ/ সিগনেট প্রেস
এ কাল হলে হয়তো মিটু-ওয়ালাদের লক্ষ্য হতেন। হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের খ্যাতি ‘সিক্তবসনা সুন্দরী’দের ছবি এঁকে। তবে তাঁর ছবি কিন্তু বটতলার জন্য নয়। তার কারণ একটিই— হেমেন্দ্রনাথ ছবি আঁকতে জানতেন। এই কালে তাঁর স্বীকৃতি অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলালের চেয়ে অনেক বেশি। হেমেন্দ্রনাথের শৈলী পুরোপুরি পশ্চিমী ধাঁচের। যদিও এই বইয়ের লেখক তা সম্পূর্ণ ভাবে স্বীকার করেন না। এ ধরনের ‘রাজনৈতিক শুদ্ধতা’ থাকলেও বইটি প্রণিধানযোগ্য।
২) গদ্য সংকলন/ অমিয় দেব/ দে’জ
সাহিত্যের মাস্টারমশাই। খ্যাতি কিন্তু ‘বৌদ্ধ’ হিসাবে। অর্থাৎ কি না, অমিয় দেবের পরিচিতি বুদ্ধদেব বসুর স্কুলের প্রতিনিধি হিসাবে। তাঁর সারা জীবনের গদ্যলিখনে সেই ঘরানার ছাপ বেশ স্পষ্ট। বিভিন্ন রসের, বিভিন্ন ধারার গদ্য লিখেছেন। কিন্তু সব ক’টির শিকড়ই যেন রয়ে গিয়েছে সাহিত্যের মাটিতে। নিজের বৃদ্ধাবস্থার সঙ্গে নিজেরই বালক সত্তার সাক্ষাৎ ঘটিয়ে তর্কে বসিয়ে শেষমেশ কিন্তু জিতিয়ে দেন বালককেই— ‘প্রজ্ঞা কাকে বলে জানি না। তবে এটুকু জানি খড় না পুড়িয়ে নতুন চালের ভাতপিঠে খাওয়া যায় না।’ পাঠকও যেন সক্ষম হন নিজের খোড়ো মানুষটাকে পুড়িয়ে নতুন চালের ভাতপিঠের আনন্দে মেতে পড়ে যেতে একের পর এক নিবন্ধ।
৩) স্মৃতি সত্তা সংলাপ/ দীপেশ চক্রবর্তী/ নির্ঝর
দীপেশ চক্রবর্তী পণ্ডিত মানুষ। নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছেন। ইংরেজিতে বেশি লিখলেও বাংলাতেও লিখছেন ইদানীং। সাধারণত ‘শিক্ষিত’ বাঙালিরা এমনটা করেন না। এই বইটিতে নিজের ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে শুরু করে যৌবনের দাপুটে সব মাস্টারমশাইদের সান্নিধ্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিপ্লবীয়ানার প্রসঙ্গে এসে দ্বিধাহীন ভাবে বলেছেন, ‘‘বিপ্লবের শিক্ষায় নিষ্ঠুরতার কিছু কমতি ছিল না।’’ ভারতীয় সত্তার ডাকখোঁজ আর কিছু সংলাপ-সাক্ষাৎকার নিয়ে কারবার এই বইয়ের। নিজের অবস্থান নিয়ে তাঁর স্পষ্টবচন— “আমি কলকাতার বামপন্থী। আমার জন্য সেই ঐতিহাসিক কারণেই ইউরোপীয় চিন্তায় প্রবেশের প্রথম পথ ছিলেন মার্ক্স।”
৪) ঈশ্বর দর্শন: অবাক থেকে বাক ছাপিয়ে/ সাজ্জাদ শরিফ/ বাতিঘর
সাজ্জাদ শরিফ পেশায় সাংবাদিক আর নেশায়, পরিচয়ে কবি, প্রাবন্ধিক। আকারে ছোট এই প্রবন্ধগ্রন্থটিতে মূলত কথা বলতে চেয়েছেন চেতনার বিষয়ে। আর তার অনুষঙ্গে উঠে এসেছে কবিতা, চিত্রকলা বা অন্য দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যমের প্রসঙ্গ। পেন্টিং থেকে সিনেমা, গুহামানবের আঁকা বাইসন থেকে আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রশোমান’ চেতনা ও সংবেদের অন্তর্লীন লেনদেনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নন্দনের বিন্দুগুলিকে ছুঁতে চেয়েছেন লেখক। ‘পরম’ কি শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য? তাকে কি শেষ পর্যন্ত ধরতে পারে মানুষের তৈরি যে কোনও ভাষা? ভাবা প্র্যাকটিস করার মহড়া শুরু করার হরেক আয়োজন এই বইয়ে।
৫) দ্যূতক্রীড়ক/ ব্রাত্য বসু/ আনন্দ পাবলিশার্স
মন্ত্রিত্ব করেন, নাটক করেন এবং ইদানীং দেখা যাচ্ছে তিনি উপন্যাসও লেখেন। এই উপন্যাসটি কিন্তু নাটকের জগতের এক নায়ককে ঘিরেই। অধ্যাপক থেকে থিয়েটারের ‘বড়বাবু’ হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন ব্রাত্য বসু। শিশিরকুমার ভাদুড়ির জীবনোপন্যাস হয়ে উঠেছে সেই সময় আর বাস্তবের রঙ্গমঞ্চের কুশীলবদের নিয়ে এক জমজমাট অভিযান।
৬) ফ্রম স্টারডাস্ট টু ফার্স্ট সেলস: দি অরিজিন অ্যান্ড ইভোলিউশন অফ আর্লি লাইফ/ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়/ স্প্রিঙ্গার
বাঙালি পদার্থবিদ আছেন, গণিতবিদও আছেন। কিন্তু ডাইনোসর নিয়ে চর্চা করেন, এমন বাঙালির হদিস হয়তো প্রফেসর শঙ্কুর কাছেও নেই। নিন্দকেরা বলতেই পারেন, জাতিটাই পুরোপুরি ডাইনোসর হয়ে গিয়েছে বা পশ্চিমবঙ্গ একটা আস্ত জুরাসিক পার্ক। শঙ্কর ডাইনোসর চর্চা করেন কলকাতায় নয়। আমেরিকায় বসে। তাঁর লেখা বই চর্চিত, বহু পুরস্কৃতও। তাঁর নতুন বইটিতে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন— কী ভাবে পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হল? মহাকাশবিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, রসায়ন, এমনকি, তথ্যপ্রযুক্তিকেও হাতিয়ার করে এই বই এগিয়েছে সেই রহস্যের সমাধানে। পৃথিবীতে আছড়ে পড়া উল্কাপিণ্ড থেকেই কি প্রাণ সম্ভব হয়ে উঠেছিল? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে কেমন ছিল সেই প্রক্রিয়া? বিজ্ঞানী এখানে অনেকটাই গোয়েন্দার ভূমিকায়।
৭) বন্ধু: মাই ফাদার মাই ফ্রেন্ড/ কুণাল সেন/ সিগাল বুকস
বাংলায় পিতৃস্মৃতি লেখার একটা রেওয়াজ রয়েছে। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায় থেকে রবীন্দ্রনাথ— সকলেই পিতৃতর্পণ করেছেন। কুণাল সেন সেই তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন। বন্ধু, পিতা আর চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনকে নিয়ে লেখা এই বই পাঠককে নিয়ে বসে পড়তে পারে খোলামেলা আড্ডায়।
৮) কোর্টিং ইন্ডিয়া: ইংল্যান্ড, মুঘল ইন্ডিয়া অ্যান্ড দি অরিজিন্স অফ এম্পায়ার/ নন্দিনী দাস/ ব্লুমসবেরি
পুরনো ভারতের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রটিতে প্রতিযোগিতা বেশ ভালই। উপিন্দর সিংহ থেকে রোমিলা থাপার সেখানে বিচরণ করছেন। সেই মাঠে প্রবেশ বেশ দুঃসাহসের ব্যাপার। নন্দিনী দাস সাহসিনী। কিন্তু সেই সাহস যে শূন্যগর্ভ নয়, তার প্রমাণ রয়েছে মুঘল দরবারের আগত ইংরেজ দূত টমাস রো-কে নিয়ে লেখা এই বইটিতে।
৯) শ্যাডোজ় অ্যাট নুন: দ্য সাউথ এশিয়ান টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি/ জয়া চট্টোপাধ্যায়/ পেঙ্গুইন ভাইকিং
জয়া চট্টোপাধ্যায় ডাকসাইটে ইতিহাসবিদ। তাঁর প্রথম বই ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কমিউনালিজ়ম অ্যান্ড পার্টিশন’ ছিল বিদ্বান জগতে এক বড় ভূমিকম্প। তাঁর সাম্প্রতিক এই বইয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেড়শো বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে খোঁজ করেছেন এখনকার ভারতের স্বরূপ। সেই সঙ্গে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের গেরস্থালির ইতিকথাও। রাজনীতির আবর্তের মাঝে উঠে এসেছে মানুষের খাদ্যাভ্যাস আর তার গভীরের রাজনীতির প্রসঙ্গ। পোশাক থেকে খিদে অথবা উপোসের ইতিহাসও ধরে রেখেছে এই বই। বর্তমানে ইতিহাসচর্চার জগতে ক্ষুদ্র ইতিহাস (মাইক্রো হিস্ট্রি) নিয়ে তাত্ত্বিক কচকচানি বিপুল। অনেক দিন পরে এমন একটি বই পড়া গেল, যা বৃহৎ পটভুমির আখ্যান। বইয়ের গদ্যের গতি রেস ড্রাইভারদের মতো। এ-ও এক বিরাট প্রাপ্তি।
১০) কাস্ট ইন বেঙ্গল: হিস্ট্রিজ় অফ হায়ারার্কি, এক্সক্লুশন অ্যান্ড রেজিস্ট্যান্স/ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, তনিকা সরকার/ ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
উচ্চবর্ণের শিক্ষিত বাঙালির অভিমান— বাংলায় নাকি জাতপাত নেই! নিন্দকরা কিন্তু দেখান, অধিকাংশ বাঙালি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন জাতপাতের কারণেই। আর তারই পরিণতি হিন্দু বাংলার বাইরে গিয়ে আলাদা রাষ্ট্র তৈরি। এই বইয়ে সে কথা অস্বীকার করা তো হয়ইনি, বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে বাংলার সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং আচার-বিচারের মধ্যে কী ভাবে আজও জাতপাতের ফল্গুস্রোত বয়ে চলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy