ফুসফুসের ক্যানসার ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ভারতে।
ফুসফুসের ক্যানসার। চিকিৎসকদের মতে, ধূমপানই এই ধরনের ক্যানসারের প্রধান কারণ। তাই ধূমপায়ীদের মধ্যেই এই অসুখের প্রবণতা বেশি। তবে আজকাল প্যাসিভ স্মোকার ও নন স্মোকাররাও এই অসুখের শিকার হচ্ছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। প্যাসিভ স্মোকিং যদি এর একটি কারণ হয়, তবে আর একটি কারণ অবশ্যই পরিবেশ দূষণ। এ ছাড়া আরও এক ধরনের ফুসফুসের ক্যানসার আছে, যার অন্যতম কারণ জিনগত পরিবর্তন। কিন্তু এর কারণ আজও অজানা।
তবে ধূমপায়ী নন, এমন মানুষের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যানসার রোগীকে আংশিক রোগমুক্ত রেখে ইতিমধ্যেই সফল কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। বিদেশেও এমন চিকিৎসা চলে আসছে। কেবল কলকাতা মেডিক্যালই নয়, দেশের কয়েকটি নামী ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রও কিছু ওষুধের উপর ভর করে আংশিক রোগমুক্ত তুলতে পারছে ক্যানসার। তাদের অন্যতম হাতিয়ার ক্রিজোটিনিব, জেফাইটিনিব, আর্লোটিনিব, ওসিমারটিনিব, আফাটিনিব ইত্যাদি গোত্রের নানা ওষুধ। সম্প্রতি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা এই ওষুধের উপর ভর করে দুই রোগীকে সম্পূর্ণ রোগমুক্ত করতে সফল হয়েছেন।
ক্লিনিকাল অঙ্কোলজিস্ট সোমনাথ সরকারের মতে, “ক্রিজোটিনিব, জেফাইটিনিব, আর্লোটিনিব ইত্যাদি ড্রাগ নতুন নয়। বিদেশে এর প্রয়োগও বেশ পুরনো। তবে এই ড্রাগ আবিষ্কারের পর আমাদের দেশেও এদের সাহায্য নেওয়া শুরু হয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে রোগীদের সুস্থও করছি আমরা। আজকাল ভারতেও একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা বিদেশি ওষুধগুলোর ব্যয়ভার কমাতে ভারতীয় সংস্করণ বার করেছে। তাতে খরচ বেশ কমেছে। এই সব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও তেমন নেই।’’
আরও পড়ুন: কলোস্ট্রাম থেকে বঞ্চিত রাখছেন সদ্যোজাতকে? কী কী ক্ষতি করছেন জানেন?
ধূমপান গিলে ফেলছে আয়ু।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিশেষজ্ঞ শিবাশিস ভট্টাচার্য আনন্দবাজার ডিজিটাল-এর সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা। তাঁদের বেলায় কী ভাবে তাঁরা এই রোগের চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোয় শুরু করেন জানালেন সে কথা। এই রোগ থেকে বাঁচার দাওয়াইয়ের হদিশও দিলেন।
প্রথম বার রোগী ছিলেন পুরুষ এবং ধূমপান থেকে শতহস্ত দূরে। মুম্বইয়ের অন্যতম সেরা ক্যানসার হাসপাতালে কয়েকটি কেমো নেওয়া সম্পূর্ণ করেছিলেন। তাতে আংশিক রোগমুক্তিও ঘটে। অবশেষে শিবশিস ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে ক্রিজোটিনিব প্রয়োগ শুরু হয় ও ৬ মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ রোগমুক্তি ঘটে।
কিন্তু দ্বিতীয় প্রমাণ মিলল খুব সম্প্রতি। এ ক্ষেত্রে রোগী মহিলা ও নন স্মোকার। এঁদের চিকিৎসার ভার পেয়ে কেমন করে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিলেন মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অঙ্কালজি বিভাগের চিকিৎসকরা? কী ফলাফলই বা পেলেন, জানালেন শিবাশিসবাবু।
তাঁর মতে, ‘‘নন স্মোকার ও স্মোকার— দুই ধরনের রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যানসারের মিউটেশনগত তফাত থাকে। ধূমপায়ী হলে তাঁদের জন্য ‘আরএএস’ (র্যাস) এবং ধূমপায়ী নন, বয়সও কম, এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ইজিএফআর এবং এএলকে বা অ্যাল্ক মিউটেশন। তবে আমাদের দেশে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষের টিউমারে স্মোকারদের ক্ষেত্রে হওয়া মিউটেশনই ধরা পড়ে। বাকি ২০ শতাংশ নন স্মোকারদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কাজে আসবে কি না তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ মেলে।’’ যদিও সুকুমারবাবুর মতে, ‘‘আজকাল এই ধরনের ওষুধের প্রয়োগ কেবল নন স্মোকারদের ক্ষেত্রেই আটকে নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্মোকারদেরও এই চিকিৎসার আওতায় আনা হচ্ছে, কারণ তাঁদের ক্ষেত্রেও উপরোক্ত মিউটেশনগুলি কখনও কখনও মিলে যাচ্ছে।’’
আরও পড়ুন: গর্ভাবস্থায় রাতে গাঢ় ঘুম? সম্ভব, যদি এ সব মানেন
নন স্মোকার রোগীর ক্ষেত্রে ঠিক কী ভাবে এগোলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা? আদতে এই ওষুধ প্রয়োগের আগে কী কী খতিয়ে দেখতে হয়? শিবাশিসবাবু জানান দিলেন এই সব খুঁটিনাটিও। ‘‘অ্যানাপ্লাস্টি লিম্ফোমা কাইনেজ বা অ্যাল্ক ট্রান্সলোকেশনের এক্সপ্রেশন ইন ইমিউনো হিস্টোকেমিস্ট্রি যা কি না একটি বিশেষ স্টেন— সেই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রথমে দেখা হয় রোগীর ক্ষেত্রে ক্রিজোটিনিব ওষুধ কাজ করবে কি না। বায়োপসির প্যারাফিন ব্লকের উপর এটা করতে হয়। এই খরচসাপেক্ষ পরীক্ষা এক সময় কলকাতায় একেবারেই হত না। আজকাল বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে হয় বটে, তবে আশার কথা, দু’টি ক্ষেত্রে সাফল্য মেলার পর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে সরকারি উদ্যোগে একেবারে বিনামূল্যে এই পরীক্ষা খুব শীঘ্রই শুরু করা হবে। এ নিয়ে ইতিমধ্যে টেন্ডারও ডাকা হয়েছে।’’
ক্রিজোটিনিব ওষুধ বস্তুতপক্ষেই খুব দামী ও এই চিকিৎসার ব্যয়ভার নিম্নমধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে নেই। এ দিকে ফুসফুসের ক্যানসার শ্রেণিগত ভেদ বোঝে না। তাই দুই রোগীর ক্ষেত্রেই চিকিৎসার ব্যয়ভার সামাল দিতে এগিয়ে এসেছিল সরকার, অসরকারি প্রতিষ্ঠান ও মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিশেষ সাপোর্ট টিম। কিন্তু পরীক্ষার পর?
চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘দুই রোগীর ক্ষেত্রেই যখন জানতে পারি যে ক্রিজোটিনিব এঁদের শরীরে কাজ করবে, তখন আমরা টাকাপয়সা তুলে ও সরকারি সাহায্য নিয়ে বিপুল ব্যয়ভারের চিকিৎসা শুরু করার সাহসটা দেখাতে পারি। মাস তিনেক যাওয়ার পরেই আমরা পেট স্ক্যান করাই, এতে টিউমারের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। সেই পরীক্ষায় দেখা যায়, তিন মাসে রোগীর শরীরের ৫০ শতাংশ টিউমার উধাও। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, একে ‘পার্শিয়াল মেটাবলিক রেসপন্স (আংশিক রোগমুক্তি) বলে ডাকা হয়। কিছুটা সফল হয়ে আরও তিন মাস এই ওষুধ প্রয়োগ করলে অবশেষে প্রথম জনের ক্ষেত্রে ক্যানসার বহনকারী সব টিউমার উধাও হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম এই সাফল্যে আমরা খুশি হই। আজ পাঁচ বছর সেই রোগী এখনও ক্রিজোটিনিব নিয়ে চলেন ও সম্পূর্ণ রোগমুক্ত।’’
তবে প্রথম সাফল্য সম্পর্কে তৎকালীন সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচুর নিউজপ্রিন্ট খরচ হলেও এটি কেবলই ‘ব্যতিক্রমী’ ঘটনা কি না তা নিয়ে চিকি়ৎসকদের মধ্যে খানিক সংশয় ছিল। দ্বিতীয় সুযোগও মিলে গেল সম্প্রতি। আবারও ক্রিজোটিনিব কাজে আসে, নন স্মোকার ও বয়স কম এমন রোগী হাতে আসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিক্যাল অঙ্কোলজি বিভাগের চিকিৎসকদের কাছে। তবে এ বার রোগী মহিলা। দেখা যায়, এঁর ক্ষেত্রেও ৬ মাসের মধ্যেই সম্পূর্ণ রোগমুক্তি ঘটেছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘কমপ্লিট মেটাবলিক রেসপন্স’। শুধু তা-ই নয়, হাড় ও লিভার থেকেও উধাও হয়েছে অসুখের থাবা। একটানা ক্রিজোটিনিব নিয়ে চলা ও কিছু নিষেধাজ্ঞা পালনে রোগমুক্ত আছেন হাওড়ার সেই রোগীও।
কিন্তু কী কী নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন? শিবাশিসবাবুর মতে, ‘‘ভিড় জায়গায় যাওয়া, ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়িতে যাওয়া এবং কাঁচা অসিদ্ধ খাদ্যদ্রব্য খাওয়া (সালাড বা কাঁচা ফল) বারণ। মোদ্দা কথা, ইনফেকশন ছড়াতে পারে, এমন কাজ এড়াতে হবে। খাওয়াদাওয়াও বাড়ির তৈরি কম তেল-মশলার ও যতটা সম্ভব দূষণ এড়িয়ে থাকা যায় ততই ভাল। এর বাইরে তেমন কোনও নিষেধাজ্ঞা থাকে না।’’
ক্রিজোটিনিব, জেফাইটিনিব ইত্যাদি জাতীয় ওষুধের প্রয়োগের সাফল্য নিয়ে বরাবরই উচ্ছ্বসিত কলকাতার অঙ্কোলজিস্ট মহল। তবে কেউ কেউ ‘ক্যানসার সেরে গিয়েছে’ বলতে রাজি নন। শিবাশিসবাবুরা এ বিষয়েও স্পষ্ট অবস্থানে। তাঁদের মতে, জ্বরও জীবনে বার বার হয়। যে কোনও অসুখই ঘুরে আসতে পারে, কিন্তু তা বলে রোগমুক্তির সাফল্য তাতে খাটো হয়ে যায় না। ফের ঘুরে এলে তার জন্যও উন্নত গবেষণা ও চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ থাকবে। কিন্তু এই দুই রোগীর ক্ষেত্রেই তাঁদের অসুখ এখনও ঘুরে আসেনি ও আর পাঁচ জন স্বাভাবিক মানুষের জীবনযাপন করছেন তাঁরা। অফিসও যাচ্ছেন তাঁদের এক জন। তাই সেরে যাওয়ার পরিবর্তে ‘রোগমুক্তি’ বলতে অসুবিধা থাকার কথা নয়।
আরও পড়ুন: দৈনন্দিন জীবনে এ সব ভুল আর নয়, স্ট্রোক রুখতে মেনে চলুন কিছু মাস্টারস্ট্রোক
এক ধরনের ফুসফুসের ক্যানসার আছে, যার অন্যতম কারণ জিনগত পরিবর্তন। কিন্তু এর কারণ আজও অজানা।
কিন্তু রোগ হওয়ার আগেই যদি সাবধান হওয়া যায়, তা হলে তো অসুখের সঙ্গে যুদ্ধ অনেক সহজ হয়। ফুসফুসের ক্যানসার আটকানোর কোনও আলাদা করে নিয়ম আছে কি? মেডিক্যাল অঙ্কোলজিস্টদের মতে:
ধূমপান এর প্রধান কারণ। তাই যত দ্রুত পারবেন ধূমপান ত্যাগ করুন। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে হবে। সরকারি কিছু হাসপাতালে মনোরোগ বিভাগে ধূমপান তাড়ানোর কিছু বিশেষ চিকিৎসাপদ্ধতি (নেশা নিবারণ ক্লিনিক) থাকে। দরকারে তার সাহায্যও নিতে পারেন। পরিবেশে গাছেদের উপস্থিতি বাড়ান। দূষণ কমাতে নিজস্ব উদ্যোগে যতটা পারেন গাছ লাগান। বাজারচলতি সস্তা কাপড়ের মাস্কে কোনও উপকার নেই। বরং ভাইরাস-ব্যাকটিরিয়া প্রতিরোধী কোনও মাস্ক চিকিৎসকদের পরামর্শমতো ব্যবহার করুন, তবে তাতে ভাইরাস-ব্যাকটিরিয়া ঠেকানো সম্ভব হলেও দূষণ ঠেকানো যায় না।
আর অসুখ ধরা পড়ার পর? শিবাশিসবাবু জানালেন:
অসুখ ধরা পড়লেই দ্রুত চিকিৎসকের শরণ নিতে হবে। বায়োপসি নিয়ে অযথা ভয় পাবেন না, এই পদ্ধতিতে ক্যানসার ছড়ায় না বরং দ্রুত রোগের প্রকৃতি নির্ণয় সহজ হয়। নিজের মতামত খাটাতে যাবেন না, চিকিৎসা চলাকালীন ভরসা রাখুন চিকিৎসকের উপর। মেনে চলুন তাঁর দেওয়া বিধিনিষেধ। ‘ক্যানসার মারণ রোগ’ এই ধারণা আগেই মাথা থেকে সরিয়ে ফেলুন। নিয়ম মানলে ও ঠিকঠাক চিকিৎসা হলে অসুখ নিয়ন্ত্রণে থাকে, রোগমুক্তিও হয় অনেক ক্ষেত্রে।
(ছবি: শাটারস্টক ও আইস্টক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy