Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
ভাষানগর
teenagers

জেন জেড

কোন ভাষায় কথা বলছে নতুন সহস্রাব্দের নব্য প্রজন্ম? তাদের শব্দভান্ডার, ভাবনা, ব্যাকরণের পাঠোদ্ধার করতে, অভিভাবকদের জন্য গাইড।

চিরশ্রী মজুমদার 
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১১
Share: Save:

জীবনে দু’বার নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক থেকে বেঁচে গিয়েছি। প্রথম বার, সেই স্কুলজীবনে। যখন শুনেছিলাম সচিন তেন্ডুলকরের মতো শান্ত, সুশীল, সোনার টুকরো ছেলে কিংবদন্তি কপিল দেবকে সামনাসামনি ‘পাজি’ বলেন! অত সম্মাননীয় মানুষটা পাজি? আর দ্বিতীয় ধাক্কা এল এই বছর কয়েক আগে। যখন রণবীর সিংহ সর্বত্র, প্রকাশ্যে প্রবল বিনয়ের সঙ্গে অমিভাভ বচ্চনকে ‘গোট’ বলে বেড়াতে লাগলেন! শৈশবে কপিলকে ‘পাজি’ (পঞ্জাবিতে দাদা অর্থে) বলে ডাকতে শিখে জেনেছিলাম, বাংলা, ইংরেজির বাইরেও অনেক ভাষা আছে আমাদের দেশে। আর ২০১৭-য় বুঝলাম, ‘গোট’ মানেই একহাত দাড়িওয়ালা পাঁড়েজি-র ছাগল নয়! ‘গোট’ হল সর্বকালের সেরা— ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’, G.O.A.T। তখন ভিরমি খেতে খেতেও হঠাৎই খুব নিশ্চিন্ত লাগল। তাই তো! ভাষা তো শুধু ভূগোলের সঙ্গেই পাল্টায় না, সময়ের সঙ্গেও বদলে যায়!

নব্বই দশকের পপ লিঙ্গোয় অমিতাভ, সচিন, লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিয়ো ছিলেন ‘সুপারস্টার’। সহস্রাব্দের গোড়ায় জীবনে হুহু করে ঢুকে এল বিশ্বায়নের হাওয়া আর ইটালীয় কায়দায় তাঁদের ডাকলাম ‘মায়েস্ত্রো’। আর এখন মিলেনিয়াল লিঙ্গোয় তাঁরা হয়েছেন ‘গোট’! নতুন প্রজন্ম, যারা সহস্রাব্দের সঙ্গেই পৃথিবীতে এসেছে, বেড়ে উঠেছে ইন্টারনেট সাম্রাজ্যে, তাদের ব্যবহৃত ভাষাই মিলেনিয়াল লিঙ্গো, জেন জ়েড স্ল্যাং। জেন ওয়াই বা মিলেনিয়ালদের জন্ম ’৮১-’৯৬-এর মধ্যে। পরের দশ বছরে যাদের জন্ম, তারা জেন জ়েড অথবা জ়ুমার্স। তবে, এই সীমারেখা নিয়ে কিঞ্চিৎ ধোঁয়াশা আছে। যাদের জীবনে সহস্রাব্দের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, যারা আদ্যোপান্ত ডিজিটাল নাগরিক, ব্যাপক ভাবে তাদের সকলেরই ডাকনাম মিলেনিয়ালস।

স্মার্টফোনের ছোট্ট স্ক্রিনে, কম জায়গার মধ্যে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটের উপযুক্ত হতে এদের ভাষা মুচমুচে, সংক্ষিপ্ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচলিত অনুষঙ্গে (হ্যাশট্যাগ, ইমোটিকনস) ঠাসা। কেঠো নয় কেজো, উচ্ছল। কোনও শব্দের বাড়তি মেদ ছেঁটে, কারও ধ্বনিটুকু পাকড়ে, কোথাও বানান নিয়ে খেলে, বহুব্যবহারে জরাজীর্ণ কোনও শব্দ আর বাক্যের মানেটাই উল্টেপাল্টে ধুলো ঝেড়ে ঝাঁ-চকচকে নতুন বানিয়ে দিচ্ছে ওরা। যাকে কিছু দিন আগেও বলা হত ‘মেকওভার’, ওরা বলে
‘গ্লো আপ’!

ঠোক্কর & রোদ্দুর

কোনও শব্দের নির্দিষ্ট অর্থকে আঁকড়ে থাকে না ওরা। তার সঙ্গে যুগোপযোগী কোনও ধারণাকে যুক্ত করা গেলে, সেটাই তৎক্ষণাৎ হিট। যেমন, ওদের দুনিয়ায় ‘থার্স্টি’ মানে তৃষ্ণার্ত ঠিকই, তবে এ ক্ষেত্রে তেষ্টাটা হল মনোযোগ বা নজর কাড়ার পিপাসা।। ‘সল্টি’ মানে দুখী আত্মা বা হিংসুটি খুকি। ডিজিটাল পৃথিবীতে প্রচলিত শব্দকে ভিন্নার্থেও পরিবেশন করা হচ্ছে। উদাহরণ ওটিপি। ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড নয়, তার মানে ‘ওয়ান ট্রু পেয়ার’ (যেমন, রণবীর-আলিয়া)। এম টিভি-চ্যানেল ভি-র সোনালি দিনে কলেজে র‌্যাগিংকে বলা হত ‘রোস্টিং’, এখন ট্রোলিং-ইউনিভার্সে ‘বুলি’ করাকে বলে ‘ড্র্যাগিং’। টি আর স্ন্যাকস মানে চা-বার্গার মোটেও নয়। ‘স্পিল দ্য টি’ হল একটু গসিপ শোনাও। আবার ‘স্ন্যাক’ (বানান কিন্তু Snacc!) বলা হয় ঝিকঝ্যাক দেখতে ছেলেমেয়েদের। সৌন্দর্যের সঙ্গে খাদ্যকে এমন সরাসরি জুড়তে দেখে শঙ্কা হয়, একুশ শতকের ভোগ্যপণ্যবাদের ছায়া ঘনিয়েছে ওদের মনে? তবে একই সঙ্গে আশার রোদ্দুরেরও তেজ বাড়ে। দেখা যায়, একটু-আধটু ঠোক্কর থাকলেও ওদের ভাবনাচিন্তার দরজাগুলো বেশির ভাগই খোলামেলা। চলতি সময়ের দোষগুলোকে চিনে নিয়ে সেগুলো শোধরানোর চেষ্টা করছে। আগের দশকেই মহামন্দার ঢেউ দেখেছে, তাই মিলেনিয়ালদের অনেকেই বেশ সাশ্রয়ী। মিনিম্যালিস্টিক জীবন ভালবাসে, অল্প লিখে অনেকটা বুঝিয়ে দেয়। বর্ণভেদ, লিঙ্গভেদে এক বিন্দু আগ্রহ নেই, তৃতীয় লিঙ্গের বন্ধুদের সঙ্গেও দারুণ স্বচ্ছন্দ। স্লিপওভারগুলোতে ছেলে কিংবা মেয়ে, তস্য বন্ধু, বন্ধুর বন্ধুর বন্ধু সকলেই ‘ব্রো’, পনেরো থেকে পঁচিশের বাঙালিরা যেমন সব বন্ধুদেরই ‘ভাই’ ডাকতে অভ্যস্ত। প্রেম-ভালবাসার জন্য জীবন খরচ করে ফেলতে তেমন উৎসাহ নেই। তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেরিয়ার, স্বাবলম্বন, স্বাধীনতা আর নিজের চারপাশের মানুষ ও পরিবেশকে ভাল রাখা।

জিজি’দের শব্দগণিত

সহস্রাব্দের প্রথম দশকে যখন ওদের দুনিয়াটা সদ্য গড়ে উঠেছে, বিরাট একটা পদক্ষেপ করেছিল ‘ডিজ়নি’। ‘প্রিন্স চার্মিং’-এর ভাবমূর্তিটাকে ভেঙে দেখিয়েছিল আসলে সে ভিলেন। হ্যাপিলি এভার আফটারের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে সিনেমার শেষ দৃশ্যে তুলে ধরেছিল পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকার। আজ গ্রেটা থুনবার্গদের পরিবেশ সচেতন প্রজন্ম নিজেদের বলে জিজি। জেনারেশন গ্রিন। শব্দসম্পদ খরচেও হিসেবি ওরা। বাই দ্য ওয়ে-র বদলে ‘বিটিডব্লিউ’, আই ডোন্ট নো-কে ছোট্ট করে ‘আইডিকে’ বলেই সময় আর শ্রম বাঁচিয়ে ফেলে।

ভাষাতাত্ত্বিকরা বলেন, প্রতি প্রজন্মেই সদ্যযৌবনে প্রচলিত ধ্যানধারণা, ভাষারীতির বিনির্মাণ চলে। অভিধানে নবীন শব্দও ঢোকে। ইমেলের যুগ আসতেই বি রাইট ব্যাক-এর সংক্ষেপ ‘বিআরবি’, ‘পিং’ প্রভৃতির প্রয়োগ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এখন তেমনই রাত জেগে ওয়েব সিরিজ় বিঞ্জ ওয়াচিংয়ের পরে রক্তচক্ষু সেলফি তুলে পোস্টে লেখা হচ্ছে ‘এফওএমও’ বা ‘জেওএমও’ (ফিয়ার অব মিসিং আউট/ জয় অব মিসিং আউট)।

তবে মিলেনিয়াল লিঙ্গোর লিস্ট ভীষণ দ্রুত বদলাচ্ছে। GR8 (গ্রেট), ওএমজি, চিল্যাক্স, এমনকি মাত্র ক’দিন আগের YOLO (You Only Live Once) -ও এখন ডাগআউটে ফিরে গিয়েছে। মাঠ মাতাচ্ছে Smol (স্মল অ্যান্ড কিউট), Bae (বিফোর এনিওয়ান এলস, অর্থাৎ বিশেষ বন্ধু), TBH (টু বি অনেস্ট), Finsta (ফেক ইনস্টাগ্রাম), KK (ওকে, কুল), STAN (স্ট্রং ফ্যান), Mood (সেম হিয়ার).... ‘হট’ এখন ‘ফায়ার’, ‘কুল’ হয়েছে ‘স্যাভেজ’!!!

আমরা বেড়া ভাঙি...

এদের শব্দের খেলায় বড়দের যতই ধন্দ লাগুক, একটা বিষয় বিলক্ষণ স্পষ্ট। কোনও বিশেষ ভাষার অভিসন্ধিমূলক আগ্রাসনের কোনও জায়গা নেই ওদের দুনিয়ায়! আসলেতে যে সেখানে রয়েছে যৌবনধর্মে ভাষানদীর প্রাকৃতিক গতি। যুগের ভূপ্রকৃতি দেখেশুনে বাঁক বদলে, চারপাশের পাথর-পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে, ঝর্নার স্রোত, পাহাড়ি খরস্রোতাকে জুড়ে নিয়ে তিরতির করে এগিয়ে চলেছে। সহজ, স্বাভাবিক, সুস্থ!

@মিলেনিয়ালস#RESPEK... 4, 5, 9 মানে, গত দশকের কোড ল্যাঙ্গুয়েজে ১, ৪, ৩। তবুও বুঝলেন না? গত শতাব্দীর ইয়ুথ অ্যান্থেম! ইলু! ইলু! I.L.U!

টিবিএইচ, সেখান থেকেই এই পথের শুরু!

ছবি: শুভদীপ সামন্ত

মডেল: যশোজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, পূজিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌম্যা রায়

মেকআপ: সৈকত নন্দী; হেয়ার: স্বরূপ দাস; লোকেশন: ক্লাব ভর্দে ভিস্তা

অন্য বিষয়গুলি:

language teenagers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy