প্রত্যাবর্তন: দু’বছর পরে সরশুনায় নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে নীলাঞ্জনা। নিজস্ব চিত্র
প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালানোর কথা মনে হয়নি! তবু সরশুনায় হারানো ঘর-দুয়ারের কাছে ফিরতে ভিতরটা হাঁকপাঁক করছিল। ঘরে ফিরেছেন। তবে, থাকা হয়নি। জানাই ছিল, ফেলে আসা ফ্ল্যাটে থাকা সম্ভব নয় এখনই। তবু দেওয়ালির ঠিক আগে দু’বছর ধরে পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটে এক বার ঢোকা তো হল।
আগের তালা ভেঙে নতুন তালা-চাবির ব্যবস্থা হয়েছে পুরনো ঠিকানায়। কিন্তু নতুন জীবনে ফেরার চাবিকাঠি পাওয়ার যুদ্ধ চলছেই! ভাঙাচোরা জীবনের এলোমেলো সব টুকরোই যেন দু’বছর বাদে নিজের অগোছালো ফ্ল্যাটে ধুলো সরিয়ে খুঁজলেন নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়। মানসিক হাসপাতালে থেকে সেরে ওঠার পরেও বৃহত্তর সমাজের কাছে কার্যত ব্রাত্য নরনারীর মূল স্রোতে ফেরার লড়াইটা কত দূর কঠিন, তা ফের দেখল কলকাতা।
সমাজকল্যাণ দফতরের জীবন সহায়তা কেন্দ্র ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিক নীলাঞ্জনাকে দু’বছর আগে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। সেটা ২০২০-র সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবার মৃত্যুর পরে পড়শি এবং স্থানীয় পুলিশ মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একমাত্র কন্যা ঠিক প্রকৃতিস্থ নন, এই যুক্তিতে নীলাঞ্জনা বাবাকে শেষ দেখাও দেখতে পাননি বলে অভিযোগ। পুলিশি সূত্রের খবর, মধ্য চল্লিশের নীলাঞ্জনার বাবা রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের দেহটি করোনা-কালে কাঁটাপুকুর মর্গে নিয়ে গিয়ে সৎকার করা হয়। পাভলভ থেকে ছাড়া পেলেও নীলাঞ্জনার ঠাঁই হয়েছে প্রত্যয়ের হোমে। এত দিন বাদে শনিবার তিনি ফের নিজের বাড়ির অবস্থা দেখতে পেলেন।
জীবনযুদ্ধে ধ্বস্ত নীলাঞ্জনা রবিবার দুপুরে বলছিলেন, “নিজের বাড়ি থাকতে অন্য কোথাও কেন থাকব? আমি নিজের বাড়িতেই থাকতে চাই। কিন্তু তার আগে বাবার পেনশনের টাকা উদ্ধার করতে হবে। বাবা এভারেস্ট হাউসে ইলেকট্রনিক কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করতেন। ব্যাঙ্কে বাবার যা আছে, তা দিয়ে পারলে ব্যবসা শুরু করব।” নীলাঞ্জনার ইচ্ছে, পাভলভ থেকে প্রত্যয়ের জীবনে প্রিয় বন্ধু স্বপ্না নস্করকে সঙ্গে নিয়েই সরশুনার ফ্ল্যাটে থাকবেন। স্বপ্নাকে সঙ্গে নিয়েই ছোটখাটো ব্যবসা করতে চান। বাড়ি থেকে ভোটার কার্ড, গানের খাতা, সব খুঁজে এনেছেন নীলাঞ্জনা।
এ মেয়ের পুরনো জীবনের সঙ্গে নতুন স্বপ্ন মেলানোর কাজে পাশে রয়েছেন প্রত্যয়ের প্রকল্প আধিকারিকেরা। তাঁদের তরফে অভিজিৎ রায় বলছিলেন, “আমরা নীলাঞ্জনাদির পাড়া-পড়শি এবং পুলিশ, সবার সঙ্গে কথা বলেছি। ওঁরা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। কিছু ভুল বোঝাবুঝির ফলে ওঁর বাবার শেষকৃত্যে নীলাঞ্জনাদি থাকতে পারেননি। আমরা এখন সেই ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করার চেষ্টা করছি। পুলিশ আমাদের সাহায্যও করছে। এর পরে নীলাঞ্জনাদির বাবার পেনশনের টাকা জোগাড়ের বিষয়টি সুনিশ্চিত করার চেষ্টা করব।”
জীবনের কোনও এক মোড়ে এলোমেলো টুকরোগুলো সবাইকেই গোছগাছ করতে হয়। কিন্তু মানসিক রোগীর তকমা সেঁটে গেলে এটুকু চেষ্টা আরও জটিল হয়ে ওঠে। নীলাঞ্জনার জীবনে সেটাই দেখছেন মানসিক রোগীদের ক্ষমতায়নের কাজে শরিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার রত্নাবলী রায়। তাঁর কথায়, “মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে পুলিশ থেকে শুরু করে বৃহত্তর সমাজের সংবেদনশীলতায় খামতি রয়েছে। এই মেয়েটির ঘটনায় সেটা পরিষ্কার। নীলাঞ্জনার বাবার ডেথ সার্টিফিকেট থেকে পেনশনের লড়াইয়ে তাই এত ঝক্কি হচ্ছে।” বাধা ঠেলে অনাগত কোনও দেওয়ালিতে উদ্ভাসিত হওয়ার আলো তবু খুঁজে চলেছেন নীলাঞ্জনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy