—প্রতীকী চিত্র।
মল্লিকা বেশ স্বাস্থ্যসচেতন। শরীরকে তোয়াজে রাখে। নিয়ম করে ব্যায়াম করে, ক্যালরি মেপে খায়। দিনে অন্তত তিন লিটার জল খায় সে। তাই নিয়ে বন্ধুরা মজা করলে, গম্ভীর মুখে বলে— ‘সিস্টেম থেকে টক্সিন দূর করছি।’ এহেন স্বাস্থ্যসচেতন মেয়ে এক দিন ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রবল বমি, সেখান থেকে ডিহাইড্রেশন। চিকিৎসকের কাছে বিশদে সব জানাতে চিকিৎসকের প্রথম প্রশ্নেই চমকে গেল মল্লিকা। প্রশ্নটি হল, জলের বোতল নিয়মিত পরিষ্কার করেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে কেউই ঠিক বুক ঠুকে বলতে পারবে না যে নিয়মিত জলের বোতল পরিষ্কার করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জল ফুরিয়ে যাওয়ার পরে ফের জল ভরে নেওয়া হয়। এক বার হয়তো জল দিয়ে ধুয়ে নিলেন। অনেকের ক্ষেত্রেই স্বচ্ছ বোতলটি যখন ঘোলাটে হয়ে আসে তখন সাফ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হল, না ধোয়া জলের বোতলেই কিন্তু লুকিয়ে থাকতে পারে শয়ে শয়ে জীবাণু, মোল্ড ও ফাঙ্গি। আপাত দৃষ্টিতে যা পরিষ্কার মনে হচ্ছে, তা হয়ে উঠতে পারে অসুখের আঁতুড়ঘর। ত্বকের সমস্যা থেকে নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, ফ্লু, জন্ডিস কী নেই সেই অসুখের তালিকায়।
এ প্রসঙ্গে কথা বলা গেল চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, “জলের মাধ্যমে ব্যাক্টিরিয়া, প্রোটোজ়োয়া, ভাইরাস ইত্যাদি মুখ দিয়ে মানবশরীরে প্রবেশ করে। এর ফলে যে অসুখগুলি হয়, সেগুলিকে জলবাহিত বলা চলে। এর মধ্যে প্রথমেই মাথায় আসে টাইফয়েডের কথা। এ ছাড়া এক ধরনের জন্ডিস, কলেরা, ডিসেন্ট্রি ইত্যাদিও জলবাহিত অসুখের মধ্যে পড়ছে।”
আমরা জানি, গরমকালে জলের সঙ্কটে জলবাহিত অসুখ বেশি হয়। কাটা ফল, রাস্তার বরফ দেওয়া পানীয় থেকে সেগুলি ছড়ায়। তবে, এ বার ভাবতে হবে যে নিজেদের আপাত নির্দোষ জলের বোতলও হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী। বিশেষত বয়স্ক, শিশু ও যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাঁদের ক্ষেত্রে।
জলের বোতলে জীবাণুর হানা
ডা. তালুকদার বললেন, “বোতল, ফ্লাস্ক বা যে কোনও পাত্রে আবদ্ধ জলে ২৪ ঘণ্টা পরে একটি আস্তরণ পড়ে। একে বলা হয় বায়োফিল্ম। এটি চোখে দেখা যায় না সব সময়ে। এই ক্ষেত্রটিতে জলে থাকা অণুজীবরা বংশবিস্তার করে। যত বেশি দিন জল রাখা থাকে, তত বংশবিস্তার বাড়তে থাকে। এই জল যদি কেউ খায়, তবে অসুস্থ হয়ে পড়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়।”
এর পাশাপাশি জলে গ্লুকোজ় বা ওই জাতীয় জিনিস মিশিয়ে খাওয়ার প্রবণতাও রয়েছে। অনেকে ফ্লাস্কে ফলের রস নিয়ে বেরোন। গ্লুকোজ়, ফলের রস বা চিনিজাতীয় পানীয়ের ক্ষেত্রে জীবাণু ও মোল্ডের বংশবৃদ্ধি আরও বেশি হয়। সুতরাং ভাল করে পরিষ্কার করা আবশ্যিক।
জল পান করার ক্ষেত্রে হাত পরিষ্কার রাখাটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অপরিষ্কার হাতে বোতল বা জলের গ্লাস ধরলে হাত থেকে জীবাণু সহজেই পেটে পৌঁছে যেতে পারে। সেখান থেকে ডিসেন্ট্রি বা কলেরা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ডাক্তার তালুকদার জানালেন, বদ্ধ জলে লিজিয়োনেলা নামক একটি ব্যাক্টিরিয়ার বংশবিস্তারের সম্ভাবনা থেকে যায়। লিজিয়োনেলার প্রকোপে ডায়রিয়াও হয়, নিউমোনিয়াও হয়।
বোতলে মুখ দিয়ে জল খাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়
বোতলে বারবার মুখ দিয়ে জল খাওয়ার অভ্যেস আমাদের প্রায় সকলেরই রয়েছে। ডা. তালুকদার বললেন, “এই অভ্যেসটি একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এতে বোতলের মুখে বা জলের মধ্যে লালা বা ঠোঁটের উপরের ঘাম মিশে যায়। এই ঘাম বা লালায় থাকা ব্যাক্টিরিয়া জলে বংশবিস্তার করা অণুজীবগুলিকে আরও সহায়তা করে। কিছু কিছু মোল্ড বা ফাঙ্গাস রয়েছে যাদের কাছে এই ব্যাক্টিরিয়াগুলি খাদ্য। ফলে, নিজস্ব বোতলে বারবার মুখ দিয়ে জল খেয়ে সেটি ভাল করে না ধুলে নিজের অসুস্থতাই ডেকে আনা হয়।”
পাশাপাশি, অনেক সময়ে না জেনেই অন্যের মুখ দিয়ে খাওয়া বোতল থেকে জল খেয়ে ফেলেন অনেকে। বিশেষ করে এই ব্যাপারটি ঘটে বাড়িতে। অসুখ ছড়ায় এ ভাবেই।
ডা. তালুকদারের কথায়, “আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই এই জীবাণুদের সঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু কোনও কারণে তাতে কাজ না হলে অসুস্থতা অবশ্যম্ভাবী।”
কাচ, স্টিল, তামা না প্লাস্টিক... কোন বোতলে বিপদ কম?
আপাত ভাবে বলতে গেলে পরিষ্কার না করলে সব বোতলেই জীবাণুর বিপদ লুকিয়ে রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা কাচ বা স্টিলকে তুলনামূলক ভাবে সুরক্ষিত বলে মনে করেন। দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে প্লাস্টিকের বোতলের গায়ে সূক্ষ্ম ফাটল দেখা যায়। অনেক সময় বোতলের ভিতর দিকের অংশটি খরখরে হয়ে যায়। এই অংশে মোল্ড বা জীবাণু খুব সহজেই নিজেদের কলোনি তৈরি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে ডা. তালুকদার কলের মুখ ও পাইপের কথাও বললেন। তাঁর কথায়, “টাইমকলের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় জল আসে। বাকি সময়টা জল না এলেও অল্প পরিমাণ জল কলের মুখে বা পাইপে জমে থাকে। এই অঞ্চলগুলিতে জীবাণু ও অণুজীবের বংশবিস্তার হতে পারে। তুলনায় ২৪ ঘণ্টার প্রবহমান জল ভাল। তাতে বদ্ধ জলের সম্ভাবনা তৈরি হয় না।”
তিনি আরও জানালেন, বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে, গাড়িতে রাখা প্লাস্টিকের জলের বোতলের বিষয়ে। বাড়ির বোতল যদিও বা পরিষ্কার হয়, গাড়ির বোতলের কথা আমাদের মনেই থাকে না বহু ক্ষেত্রে। রোদে গরমে প্লাস্টিকের সঙ্গে থেকে যাওয়া জল বিক্রিয়া করে। এতে জলটি ধীরে ধীরে বিষিয়ে যায়।
তামার বোতলে এখন জল রাখেন অনেকে। সেটি উপকারী বলে মনেও করা হয়। তবে তামার বোতল না ধুয়ে বেশি দিন জল রাখলে বোতলের ভিতরের গায়ে একটি আস্তরণ পড়ে যায়। সেখান থেকে বিস্বাদ জল এবং জীবাণুর বংশবৃদ্ধি দুই-ই হতে পারে৷ তাই রোজ জল ভরার আগে বোতল ধুয়ে নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, মাসে এক বার লেবু বা তেঁতুল দিয়ে বোতল পরিষ্কার করা দরকার।
তা হলে উপায়?
বোতলের ব্রাশ ব্যবহার করে নিয়মিত বোতলটি ধুয়ে নিলেই আর বিপদের সম্ভাবনা নেই। ব্যবহার করতে পারেন খুব হালকা কোনও সাবান। বেকিং সোডা বা ভিনিগারও ব্যবহার করা যায়। বিশেষ করে গরম জলে বেকিং সোডা ব্যবহার করে ভাল করে ঘষে ঘষে ধুলে বোতলে মোল্ড হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না।
যদি নিয়মিত বোতল ধোয়ার সময় না থাকে, সপ্তাহে অন্তত এক দিন ধোয়ার রুটিন তৈরি করুন। পাশাপাশি, বোতলে মুখ লাগিয়ে খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
জলতেষ্টার সময়ে নিজের জলের বোতল হাতের কাছে না থাকলে বন্ধুবান্ধবের বোতল থেকে জল খাবেন না। দরকার হলে মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতল কিনে জল খান।
জলের সঙ্গে জীবাণুও শরীরের ভিতরে যাতে প্রবেশ করতে না পারে, তাই নিয়মিত এই অভ্যেসগুলো মেনে চলুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy