বিলাস আর অল্পে সন্তুষ্টির লড়াইয়ে এখন ক্রমশ পিছু হঠছে দ্বিতীয়টি। সহজ জীবনের জায়গা নিচ্ছে আড়ম্বর ও আতিশয্য। আর এই ক্রমাগত ঝাঁ চকচকে হয়ে ওঠার প্রয়াসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শৈশব। সব মা-বাবারই তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে তাঁদের সন্তান হয়ে উঠুক পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। সেই ইচ্ছেপূরণে সন্তানের জন্য তাঁরা সর্বোচ্চ সুযোগ ও সুবিধের বন্দোবস্ত করেন। সেরা শিক্ষা, সেরা পুষ্টি-সহ বহু কিছু। আর সন্তানকে সেরা সব কিছু দিতে হবে, এই সহজ ইচ্ছের মধ্যে কখন চোরাস্রোতে ঢুকে পড়ে দেখনদারি, সামাজিক প্রতিযোগিতা ও সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার এক দুর্দমনীয় লোভ। ফলে, সন্তানের প্রকৃত উন্নতির চিন্তা কখন চাপা পড়ে যায় তা বোঝাও যায় না। মা-বাবার হয়তো মনে হয়, ‘এই তো আমার সন্তান ভাল স্কুলে পড়ছে, ভাল রেজ়াল্ট করছে। সেরা খাবার, পোশাক তাকে দিচ্ছি। সব আবদার মেটাচ্ছি। সন্তানের উন্নতিতে কোনও খামতি রাখিনি।’ কিন্তু বাস্তবে সেই ‘সব কিছু ভাল’-র মধ্যেই ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে সমস্যা।
এই সমস্যারই একটা উদাহরণ পাওয়া গেল বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের কথায়, “এমন অনেক ঘটনা দেখেছি যেখানে বাড়ির গাড়ি কিশোর সন্তানের মনোমত না হওয়ায় সে বাড়িতে জানাচ্ছে যে স্কুলের গেটে যেন সেই গাড়ি না যায়। তাতে তার বন্ধুদের কাছে সম্মানহানি হচ্ছে। এই ভাবনার পিছনে কিন্তু প্রাথমিক দায় থেকে যায় বাবা-মায়েরই।” ডা. রাম আরও জানালেন, আসলে বিষয়টা তুলনার। বর্তমান পরিস্থিতিতে কে কত ভাল আছি তার তুলনামূলক বিশ্লেষণেই আমাদের আনন্দ। জীবন খাতার হিসেবে আমি ১০০ পেয়েছি, বন্ধু ৮৫ পেয়েছে। এটা জানামাত্রই মনে হবে জীবনের সব ঠিক পথে চলছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে দেখব আমার বন্ধুও ১০০ ছুঁয়ে ফেলেছে, সেই নম্বর ছাপিয়ে যাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষার অস্ত্র হয়ে উঠছে আতিশয্য। সেই বিষয়টা চুঁইয়ে প্রবেশ করছে সন্তানদের মধ্যেও।
বিশিষ্ট মনোবিদ ও শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের সদস্য যশোবন্তী শ্রীমানী জানালেন, সন্তানকে যত্ন করে মানুষ করব, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে সেটা করতে গিয়ে যেন এমন আতিশয্য না করে ফেলি যাতে পরবর্তীতে সেই প্রকার বিলাস না পেলে সন্তানের হতাশা বেড়ে যায়। সব কিছু সহজে পেয়ে যাওয়ায় সব কিছুই তাদের একঘেয়ে লাগে। নতুন করে মনকে আনন্দ দেওয়ার উপকরণ দাবি করতে থাকে।
কী কারণে এই মানসিকতা?
ডা. রাম জানালেন, মূলত তিনটি বিষয় কাজ করে মাত্রাতিরিক্ত বিলাস ও আড়ম্বরে গা ভাসানোর পিছনে।
‘লোকে দারুণ বলবে’: এই প্রশংসার লোভ, সমাজের চোখে কে দারুণ আছে, কে একেবারেই ভাল নেই তার নির্ণায়ক আমরা। আমরাই সমাজ এবং সেই সমাজের চোখে নিজেদের ‘সর্বাঙ্গীণ সুন্দর’ করে তোলার দায় এখন বর্তিয়েছে আমাদের উপরেই। তার জন্যই এত ‘ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ’, শুধু সমাজের কাছে ‘দারুণ’ আখ্যা পাওয়ার লোভে মনের বর্মখানি হারিয়ে গিয়েছে। ফলে, ধীরে ধীরে জমা হচ্ছে ক্লান্তি ও অসন্তোষ। কোনও কিছুতেই খুশি হতে পারছেন না মানুষ। যশোবন্তী জানালেন, নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের বাঁধন বর্তমান জীবনযাপনে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। সেখানে ঠাঁই পাচ্ছে শূন্যতা। মানুষের জীবনে যত শূন্যতা বাড়ছে তত দেখনদারি বাড়ছে। সন্তান সবেতে সেরা হবে, সব কিছু সেরা পাবে, পেতেই হবে... এই তীব্র আকাঙ্ক্ষার সূচনা সেখানেই।
সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানোর চেতনা: এই প্রসঙ্গে মনোবিদ যশোবন্তী শ্রীমানী জানালেন, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো ভীষণ প্রয়োজন। বাবা মাকে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, যোগাযোগ হল সুসম্পর্কের চাবিকাঠি। পরিবারের সঙ্গে অন্তরের যোগাযোগ থাকলে দেখনদারি কমে যায়। সন্তানেরও সুবিধে হয় মাটিতে পা রেখে চলতে।
একই কথা শোনা গেল জয়রঞ্জন রামের মুখেও। তাঁর কথায়, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো মানে দামি খেলনা, দামি পোশাক, দামি খাবার নয়। তার সঙ্গে থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা। সে পাশাপাশি বসে কড়াইশুঁটি ছাড়ানোর সময়ও হতে পারে। বিলাসের পাঠ না পড়িয়ে সন্তানকে মানবিকতা ও এমপ্যাথির পাঠ পড়ালে তা হলেই মানুষ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাবে সে। কিন্তু অনেক সময়েই বাবা-মায়ের মধ্যে সেই চেতনা কাজ করে না।
ছোটবেলায় আমি পাইনি, সন্তান পাক: অনেক বাবা মায়ের মধ্যে এই বিষয় কাজ করে। বিশেষ করে খুব খেটে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন যাঁরা, তাঁরা মনে করেন ছোটবেলায় তাঁরা যা যা পাননি, তা সন্তানের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু কোথাও গিয়ে এই আবেগের রাশ আলগা হয়ে যায়। সেখান থেকেই শুরু হয় সমস্যা। অযাচিত চাহিদা বেড়ে যায় সন্তানের। সে বড় হয়ে ওঠে ভোগবাদের হাত ধরেই।
সন্তানকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দেওয়ার উপায়?
বিশিষ্ট মনোবিদ যশোবন্তী শ্রীমানী জানালেন, সন্তান কাঁদলেই হাতে জিনিস তুলে দেওয়া প্রথমেই বন্ধ করতে হবে। এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, আমার ক্ষমতা রয়েছে বলে আমি প্রভূত খরচ করে যে জীবনধারা সন্তানের জন্য তৈরি করে দিচ্ছি যা সে নিজে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে সামলাতে পারবে কি না। সেই অনুসারে পদক্ষেপ করা ভীষণ প্রয়োজন। সুতরাং, সন্তানকে ‘না’ বলাটাযেমন অভিভাবকদের অভ্যেস করতে হবে। পাশাপাশি, সন্তানকেও ‘না’ শোনানো অভ্যেস করতে হবে। কঠিন জীবনের জন্য তাদের তৈরি করতে হবে।
প্রায় একই কথা শোনা গেল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের মুখেও, অর্থোপার্জনের মূল্য সন্তানকে বোঝানোর কথা জোর দিয়ে বললেন তিনি। জানালেন, সন্তানকেও ছোট ছোট কাজ দেওয়ার মাধ্যমে উপার্জন করতে শেখানোর কথা, যাকে বলে রিওয়ার্ডিং সিস্টেম। তা হলে সন্তান বুঝবে, উপার্জন সহজ জিনিস নয়, অর্থ খোলামকুচি নয়। আর তার মাধ্যমে নিজেরাও দেখনদারির ফাঁদ পেরিয়ে খুঁজে পাবে নিজেদের আদত শিকড়।
আগামী প্রজন্মের কাছে বিত্তের বদলে সমৃদ্ধির মূলমন্ত্র তুলে ধরাটাই যেন হয় বাবা-মায়ের অন্যতম লক্ষ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy