কী খাচ্ছির চেয়েও অনেক সময়ে বেশি গুরুত্ব রাখে, কী ভাবে তা খাচ্ছি। অর্থাৎ রোজকার ডায়েটে পুষ্টিকর খাবার রাখলেই শুধু হবে না, তা ঠিক উপায়ে শরীরে পৌঁছচ্ছে কি না, সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখা জরুরি। সহজ উদাহরণ হল ভাতের ফ্যান। যে কারণে প্রেশার কুকার বা রাইস কুকারে ভাত রান্না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কোনও কোনও আনাজ খোসা ছাড়ানোর পরে ধুলে কিংবা আমিষ খাবার উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলে তার পুষ্টিগুণ বজায় থাকে না। কাজেই খাওয়ার আগে তার প্রসেসিং এবং রান্নার পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি।
প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতা
পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ রেখে রান্না করার আগে গুরুত্বপূর্ণ হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট হিনা নাফিস এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে করিয়ে দিলেন হ্যান্ড হাইজিনের কথা। ‘‘আনাজ কাটা-ধোয়া কিংবা রান্নার জন্য প্রসেস করার সময়ে মনে রাখতে হবে, যিনি সেটা করছেন, তাঁর হাত যেন পরিষ্কার থাকে,’’ বললেন তিনি। করোনা আবহে বাজার করে বাড়িতে আনার পরে তা ভাল করে পরিষ্কার করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে অনেকের রান্নাঘরেই। কেউ কেউ খাবার সোডা দিয়েও পরিষ্কার করছেন আনাজ। ডায়াটিশিয়ান সুবর্ণা রায়চৌধুরী এ বিষয়ে বললেন, ‘‘বেকিং সোডা দিয়ে পরিষ্কার করতে গেলে তার অ্যালকালাইন কনটেন্ট খাবারের ভিটামিন বি ও সি-কে নষ্ট করে দেয়।’’ পরিষ্কার করার সময়ে গোটা অবস্থায় এবং কম জল ব্যবহার করে ধোয়া উচিত। ‘‘রানিং ওয়াটারে আধ মিনিট ধুয়ে নিলেই যথেষ্ট,’’ বললেন হিনা।
জরুরি সংরক্ষণ
বাজার থেকে আনার পরে আনাজ প্লাস্টিকে জড়িয়ে ফ্রিজে রাখবেন না। সবুজ পাতাওয়ালা আনাজ ধুয়ে জলসুদ্ধ ফ্রিজে ঢোকাবেন না। রান্নার ঠিক আগে আনাজ কাটাই ভাল, না হলে অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে খাদ্যগুণ নষ্ট হবে।
কাঁচা মাছ ধুয়ে পরিষ্কার করে নুন-হলুদ মাখিয়ে ফ্রিজে রাখবেন। তবে জ্যান্ত মাছ কিনে এনে তা ফ্রিজে কয়েক দিন রেখে খেলে জ্যান্ত মাছ কেনার উদ্দেশ্যই ক্ষুণ্ণ হয়। দুগ্ধজাত জিনিস কেনার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবহার করে ফেলবেন। ফল তাজা অবস্থায় খেয়ে নেওয়াই ভাল।
কেন খাব, কী ভাবে খাব
রান্নার পদ্ধতি অনুযায়ী খাবারের পুষ্টিগুণ ও শরীরে তার আত্তীকরণের মাত্রার তারতম্য ঘটে। যেমন কাঁচা ডিমের তুলনায় সুসিদ্ধ ডিমের প্রোটিন ১৮০ শতাংশ বেশি সহজপাচ্য। আবার ভিটামিন সি ও বি সমৃদ্ধ ভেজিটেবলস সিদ্ধ করলে তা হিট-সেনসিটিভ ও জলে দ্রাব্য হওয়ায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়। সুবর্ণা রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘মাছ-মাংসের মতো আমিষ পদ দেহের অন্যতম প্রধান প্রোটিন সোর্স। তবে তা ওভারকুক করলে প্রোটিন লসের সম্ভাবনা থাকে।’’ অধিক তাপমাত্রায় অনেকক্ষণ ধরে তেলে কিছু ভাজলে বা তেলের পুনর্ব্যবহারে তৈরি হয় অ্যালডিহাইড, যা ডেকে আনতে পারে বিভিন্ন রোগ। সুতরাং রান্নার উপকরণ, পদ্ধতি ও সময়— তিনটি সম্পর্কেই সম্যক ধারণা জরুরি।
• আনাজপাতি: ময়লার পাশাপাশি আনাজে রাসায়নিক ও কীটনাশকের প্রভাবও দূর করা দরকার। মাটির কাছাকাছি উৎপন্ন শাক-পাতায় ময়লা বেশি থাকায় তা গরম জলে হালকা ভাপিয়ে নিয়ে ঠান্ডা জলে ধুয়ে রান্না করা উচিত। হিনা নাফিস বললেন, ‘‘বর্ষার সময়ে বিশেষ করে প্যারাসাইট ও তার থেকে ইনফেকশন সম্পর্কে সতর্ক থাকা দরকার। কাঁচা বা সিদ্ধ খাওয়ার বদলে অনেক সময়ে সতে করে খাওয়া ভাল এ সময়ে।’’ নটে, সজনে, থানকুনি কিংবা মেথির মতো কিছু শাক আবার ভাজার আগে ভাল করে ধুয়ে নিলেই চলে।
ব্রকোলি, লেটুস পালংয়ে থাকা ভিটামিন সি, সিদ্ধ করার পরে বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে যায়। কচুজাতীয় আনাজ বা ওল সিদ্ধ করার সময়ে লেবু, তেঁতুল ব্যবহার করা হয়। এতে ক্যালসিয়াম অক্সালেটের কেলাস থাকায় গলা কুটকুট করে। লেবুতে থাকে সাইট্রিক অ্যাসিড, তেঁতুলে টার্টারিক অ্যাসিড— যাতে ক্যালসিয়াম অক্সালেটের কেলাস দ্রবীভূত হয়।
কিছু ফল-আনাজ খোসাসুদ্ধ খাওয়া ভাল, কারণ তা ফাইবার-সমৃদ্ধ। আর ভিটামিন, মিনারেলস খোসার ঠিক নীচেই থাকে। যে সব আনাজের খোসা না তুলেও রান্না করা যায়, তা মোটা করে কেটে বাদ দেওয়ার দরকার নেই। সিদ্ধ করলে খোসা-সমেত করে পরে খোসা ছাড়িয়ে নিতে পারেন।
• মাছ-মাংস-ডিম: আমিষ পদের ক্ষেত্রে রান্নার সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাছ বেশি ভাজলে তার প্রোটিন ও ফ্যাটি অ্যাসিড, দুই-ই নষ্ট হয়। ভাপিয়ে রান্না করা মাছে (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ) ওমেগা থ্রি-র পরিমাণ ভাজা মাছের তুলনায় বেশি সংরক্ষিত হয়। কাঁচা বা হাফ বয়েলড ডিমের পরিবর্তে সুসিদ্ধ ডিম খাওয়ার পরমার্শ দিচ্ছেন হিনা নাফিস, ‘‘রান্না করা ডিমে প্রোটিন সহজে ভেঙে সহজপাচ্য হয়ে যায়। এ ছাড়া সালমোনেলা ব্যাকটিরিয়ার কুপ্রভাবও নষ্ট হয়ে যায়।’’
থায়ামিন, নিয়াসিন ও অন্যান্য ভিটামিন বি-এর পরিমাণ বেশ খানিকটা নষ্ট হয় মাছ-মাংস গ্রিল বা রোস্ট করলে। যদিও মাইক্রোওয়েভে রান্না করলে আমিষ পদের গুণাগুণ অনেকটাই অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব। আবার সতে কিংবা স্টার ফ্রাই করলে কম সময়ে জল ছাড়া রান্না হওয়ায় ভিটামিন বি-সহ ফ্যাট-সলিউবল ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টসের অপচয় আটকানো যায়।
চলো নিয়মমতে
কম তাপমাত্রা আর কম জল ব্যবহার করে রান্না করলে খাদ্যগুণ সবচেয়ে বেশি করে ধরে রাখা সম্ভব। ক’টি সহজ নিয়ম মেনে চললেই খাদ্যগুণ বজায় রেখে রান্না করা আর ততটা কঠিন মনে হবে না। যেমন—
• যে কোনও আনাজই ডুমো ডুমো করে কেটে রান্না করা ভাল। যত ছোট করে কাটবেন, তত নিউট্রিয়েন্টস লসের সম্ভাবনা বাড়বে।
• চাপা দিয়ে ভাপে রান্না করার অভ্যেস করুন। আনাজ সিদ্ধ করার পরে তার জলটা ফেলে না দিয়ে সেই জলটাই রান্নায় দিন।
• প্রসেসডের তুলনায় কাঁচা স্যালাডে ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টসের পরিমাণ বেশি। খাওয়ার ঠিক আগে স্যালাড কাটবেন।
• হলুদ, আদা, রসুন ইত্যাদি কাঁচা অবস্থায় খেলে তার মধ্যকার বিভিন্ন বায়োঅ্যাক্টিভ কম্পাউন্ড সরাসরি অবিকৃত অবস্থায় দেহে পৌঁছয়।
এ রকম ছোট ছোট কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখলেই বজায় থাকবে আহারে পুষ্টি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy