পিয়ানোর তালিমে কতটা আগ্রহী শহরের শিশুরা? ছবি: শাটারস্টক
‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে অভিনেত্রী মহুয়া রায়চৌধুরীর ‘এসো প্রাণভরণ’ গানই হোক কিংবা ‘পরিণীতা’-এ সইফ আলি খানের ‘পিউ বোলে পিয়া বোলে’— পর্দায় অভিজাত বাঙালিদের বাড়ি দেখানো হলে পিয়ানো মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ত। সাধারণের বাড়িতে অবশ্য এই যন্ত্রটি বিশেষ দেখা যেত না। এখন সমাজমাধ্যমের পাতায় মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে, ছোট ছেলেমেয়েরা পিয়ানোয় টুংটাং করছে। হিন্দি কিংবা বাংলা গানের সুর বাজিয়ে ফেলছে দক্ষ হাতে। আর সেই প্রতিভায় মজছেন আট থেকে আশি। ছোট শিশুদের এমন সঙ্গীতবোধ দেখে অবাক হচ্ছেন কমবেশি সকলেই।
বছর দশেক আগেও শিশুকে পিয়ানো শেখানোর আগ্রহ দেখা যেত গুটি কয়েক বাড়িতে। তবে এখন স্মার্টফোনের যুগে অনেকেই এই বাজনার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। শহর কলকাতায় একই ছবি ধরা পড়ছে। হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ছেড়ে শিশুদের পিয়ানো শেখানোর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন অভিভাবকরা।
গান-বাজনার চর্চা সন্তানের বুদ্ধির বিকাশ তো ঘটায়ই, সঙ্গে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে তাজা রাখে। শিশুকে স্মৃতিধর করে তোলে। গানের স্বরলিপি বা বাজনার তাল মনে রাখার অভ্যাসই খুদের স্মৃতিশক্তি উন্নত করে। মনোবিদদের মতে, গান-বাজনা শিখে মঞ্চে উঠে তা প্রদর্শন করার সুযোগ ছোটবেলা থেকেই পেলে সন্তানের ভীতি দূর হয়, সমালোচনা গ্রহণ করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। এ অভ্যাস তাদের আত্মিক শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বাঙালিদের বরাররই সঙ্গীতপ্রীতি বেশি। ৪-৫ বছর বয়স থেকেই শিশুদের গানের স্কুল, তবলার ক্লাস কিংবা অন্য কোনও বাদ্যযন্ত্র শিখতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন বাবা-মায়েরা। তবলা-গিটার-সিন্থেসাইজ়ার-হারমোনিয়ামের রমরমা আগেই ছিল। এখন মধ্যবিত্তের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে পিয়ানোও।
সব বয়সেই সব যন্ত্র শেখা যায় কি? কোন বয়সের শিশুরা পিয়ানোর তালিম নিতে পারে?
দক্ষিণ কলকাতায় পিয়ানো শেখান কৌশিক দাস। নানা বয়সের ছাত্রছাত্রী তালিম নিতে পৌঁছে যান তাঁর বন্ডেল রোডের ঠিকানায়। কেবল অফলাইনেই নয়, অনলাইনেও পিয়ানো শেখান তিনি। আনন্দবাজার অনলাইনকে কৌশিক বলেন, ‘‘পিয়ানোর ক্ষেত্রে আঙুলে চাপ দিয়ে সুর তুলতে হয়। শিশুদের মোটামুটি সাড়ে পাঁচ-ছ’বছর বয়স থেকে আঙুলে চাপ দিতে পারার ক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে সেই বয়স থেকেই তালিম শুরু করে দেওয়া যায়। বাদ্যযন্ত্র শেখার কোনও নির্দিষ্ট বয়স হয় না, আমার কাছে ছ’বছর থেকে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা রয়েছেন।’’
কৌশিকের কাছে এখন বিভিন্ন ধরনের পরিবার থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসেন। কৌশিকের কথায়, ‘‘একটা সময় কেবল অ্যাকুয়াস্টিক পিয়ানোই পাওয়া যেত। সেই পিয়ানোর দাম অনেকটাই বেশি। দু’লক্ষ টাকার নীচে তখন পিয়ানো পাওয়াই ছিল মুশকিল। তাই আর পাঁচটা বাদ্যযন্ত্রের তুলনায় পিয়ানো শেখার খরচ ছিল অনেকটা বেশি। তাই অনেকে চাইলেও এই বাদ্যযন্ত্রটি শিখতে পারতেন না। তবে এখন বাজারে ডিজিটাল পিয়ানোর বেশ রমরমা। ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যেই এ ধরনের পিয়ানো পাওয়া যাচ্ছে। ফলে পিয়ানো শিখতে আসার চল একটু বেড়েছে।’’
তবে সকলে একমত নন এই ধারণার সঙ্গে। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য এব্রাহাম মজুমদার। যাদবপুরে রয়েছে তার নিজস্ব সঙ্গীত শিক্ষা কেন্দ্র ‘এব্রাহাম মজুমদার অ্যাকাডেমি অফ মিউজ়িক’। সেখানকার অধিকর্তা ও এব্রাহাম মজুমদারের স্ত্রী মধুশ্রী মজুমজারের মতে, শহরের শিশুদের মধ্যে পিয়ানো শেখার প্রতি আগ্রহ ততটাও চোখে পড়ার মতো নয়। মধুশ্রী বলেন, ‘‘আমার মনে হয় পিয়ানোর তুলনায় এখন ভায়োলিন, গিটারের প্রতি আগ্রহ অনেক বেশি। কেউ কিবোর্ডে টুকটাক হিন্দি, বাংলা কিংবা ইংরেজি গানের সুর বাজিয়ে দেওয়া মানেই সে দক্ষ পিয়ানোবাদক হয়ে উঠবে, তা কিন্তু বলা যায় না। সঠিক পন্থায় পিয়ানো শিখতে গেলে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল পিয়ানোর তালিম নিতে হবে। শহরের শিশুদের মধ্যে কিন্তু ইউরোপিয়ান ক্লাসিক্যাল পিয়ানো শেখার প্রতি আগ্রহ তেমন একটা চোখে পড়ে না। শিশুদের থেকেও বেশি অভিভাবকদের মধ্যে এই বোধ আগে তৈরি করতে হবে।’’
ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল পিয়ানো শেখার প্রতি কেন আগ্রহ কম শিশুদের? এর পিছনে অন্যতম কারণ হতে পারে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজ়িকের শ্রোতার সীমিত সংখ্যা। অন্য দিকে, চটজলদি কিবোর্ডে কিছু কর্ড শিখে গান বাজিয়ে ফেলার চাহিদা খুদেদের মধ্যে অনেক বেশি। সকলেই এখন সমাজমাধ্যমে পরিচিতি লাভের পিছনে ছুটছে। একটা গান বাজিয়ে রেকর্ড করে সমাজমাধ্যমে ছেড়ে দিলেই হল, তাতেই শোরগোল শুরু হয়ে যায় নেটপাড়ায়। মধুশ্রী বললেন, ‘‘এই প্রবণতা সঙ্গীতের জন্য মোটেই ভাল লক্ষণ নয়। এতে অশিক্ষা তৈরি হচ্ছে। আগে বলিউড ছবির একটা গান তৈরির সময়ে নানা ধরনের পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করার চল ছিল। তবে এখন সে সব চল খুব একটা নেই, পুরোটাই ট্র্যাকে বাজানো হয়। ফলে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজ়িক শিখলেও তা প্রদর্শনের সুযোগ এখন কমেছে, তাই শেখার আগ্রহ কমেছে। কিবোর্ড বাজাচ্ছে খুদেরা, তবে আসল পিয়ানোর তালিম হচ্ছে কোথায়?’’
শহরে কোথায় কোথায় পিয়ানো শিখতে পারে খুদেরা?
শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন জায়গায় পিয়ানো শেখানো হয়। তবে সব জায়গায় ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল পিয়ানোর তালিম দেওয়া হয় না। শিশুদের মধ্যে পিয়ানো শেখার আগ্রহ থাকলে ওকে ‘দ্য ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজ়িক’-এ ভর্তি করতে পারেন। এ ছাড়া ‘দোলনা ডে স্কুল’-এর সল্টলেকের শাখায় কেবল স্কুলের পড়ুয়ারাই নয়, বাইরের শিশুরাও পিয়ানো শিখতে পারে। মধুশ্রী বললেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর আগে অনেক প্রবীণ পিয়ানো প্রশিক্ষক ছিলেন এ শহরে, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই মৃত্যু হয়েছে। আমার মনে হয়, কলকাতায় এখন দক্ষ পিয়ানো প্রশিক্ষক হাতে গোনা।’’ সে কারণেই তাঁদের অ্যাকাডেমিতেও আপাতত পিয়ানোর ক্লাস বন্ধ বলে বক্তব্য মধুশ্রীর। অতিমারির আগে পর্যন্ত না হলে সেখানে গিয়েও পিয়ানো শেখা যেত।
পিয়ানোর প্রতি কলকাতার টান কেমন, সে চিত্রটা আর একটু অন্য ভাবে দেখছেন পিয়ানোশিল্পী সৌরেন্দ্র মল্লিক। গায়ক সৌমজিৎ দাস এবং সৌরেন্দ্রর জুটি শহরের সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয়। আনন্দবাজার অনলাইনকে সৌরেন্দ্র বলেন, ‘‘আমি যখন ছোটবেলায় পিয়ানো শিখতে শুরু করি, তখন ১০০ জনের মধ্যে হয়তো দু’জন এই যন্ত্রটি শিখতেন। এখন ১০০ জনের মধ্যে ৪ জন শেখেন।’’ ফলে পিয়ানো খুব যে জনপ্রিয় হয়েছে, তা বলতে চান না তিনি। তবে আগের তুলনায় কিছুটা হলেও মধ্যবিত্ত বাঙালির মনের কাছাকাছি এসেছে এই বাজনা, এমনই মত সৌরেন্দ্রর।
সৌরেন্দ্রর মতে, কোভিড পরিস্থিতি পিয়ানোর মতো বাদ্যযন্ত্রের প্রতি অভিভাবক ও শিশুদের আগ্রহ বেড়েছে। সৌরেন্দ্র বললেন, ‘‘কোভিডের লকডাউন পর্বে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা দেশবিদেশের নানা রকম গানবাজনার ভিডিয়ো দেখেছে। অন্যকে পিয়ানো বাজাতে দেখে তাদেরও আগ্রহ বেড়েছে। এই যন্ত্রের রূপ, তার মধুর সুর আকৃষ্ট করে ছেলেমেয়েদের। পুরোনো দিনের বাঙালি বাড়িগুলিতে অনেকেই পিয়ানো রাখতেন, সেখান থেকেও অনেকের আগ্রহ জন্মায় এই বাদ্যযন্ত্রটি শেখার প্রতি।’’
সে সময়ে যখন পিয়ানো বাজানোর ততটা চল ছিল না বিশেষ, সৌরেন্দ্রকে কেন এই যন্ত্রটি আকৃষ্ট করেছিল? তিনি জানান, মধ্য কলকাতার মার্বেল প্যালেসে তাঁদের বাড়িতে পিয়ানো ছিল। পরিবারে সকলেই কমবেশি তা বাজাতেও পারতেন। সৌরেন্দ্র বলেন, ‘‘আমার পিয়ানো শেখা শুরু হয় ঠাকুরদার কাছেই। দূরদর্শনে পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজানো রাগ শুনে শুনে আমিও ঠাকুরদার কোলে বসে পিয়ানোতে তা বাজানোর চেষ্টা করতাম।’’ সকলের বাড়িতে ঠাকুরদার কাছে পিয়ানো শেখার সুযোগ থাকে না। কিন্তু এখন বাড়ি বসে এই বাজনা শেখার সুবিধা বেড়েছে বলেই মনে করেন সৌরেন্দ্র। তিনি বলেন, ‘‘অনলাইনে পিয়ানোর শেখার বিভিন্ন রকম কোর্স রয়েছে। সেগুলি শিখতে পারে ছোটরা। পশ্চিমি বাদ্যযন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষাটা কিন্তু অনলাইনে সম্ভব। ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন প্রাথমিক পর্যায় গুরুর উপস্থিতি ভীষণ ভাবে জরুরি, পশ্চিমি বাজনার বিষয়টি কিন্তু আলাদা।’’ বাড়ি বসে নতুন জিনিস শেখার সুযোগ যত বাড়ছে, সে সবের প্রতি টানও বাড়ছে অতিমারি পরবর্তী এই সময়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy