Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Bengal Tant

কঙ্গনা-প্রিয়ঙ্কারা পরছেন বাংলার তাঁত, তবু তাঁতির সংখ্যা কমছে! কতটা টানাপড়েন চলছে তাঁতঘরে?

জামদানি, শান্তিপুরী, বেগমপুরী, ধনেখালি— বাংলার তাঁতে বোনা বারো হাতের সুতোলি মায়াজাল! এককালে এই সব শাড়ির কদর ছিল কেবল বাঙালির অন্দরমহলেই। ইদানীং সেই মায়াসুতোতেই বাঁধা পড়ছে রুপোলি জগৎ থেকে শুরু করে রাজনীতির তারকারাও।

(বাঁ দিকে) কঙ্গনা রানাউত এবং প্রিয়ঙ্কা চোপড়া বাংলার তাঁতের শাড়িতে।

(বাঁ দিকে) কঙ্গনা রানাউত এবং প্রিয়ঙ্কা চোপড়া বাংলার তাঁতের শাড়িতে। ছবি: সংগৃহীত।

ঐন্দ্রিলা বসু সিংহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪ ১২:২৮
Share: Save:

পুজোয় তাঁতের শাড়ি কিনেছেন নিশ্চয়ই। বাংলার তাঁতিদের হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি! ভাবছেন, ‘কিনব না আবার! গরমে আরামের শাড়ি তো ওগুলোই।’ তবে জেনে রাখুন, শুধু আপনি কেন হিল্লি-দিল্লি-মুম্বই-বলিউডেও অনেকে তাঁতের শাড়ি কিনছেন এবং পরছেনও। যেমন ধরুন কঙ্গনা রানাউত। লোকসভা ভোটে জিতে মাস চারেক হল সাংসদ হয়েছেন বলিউডের অভিনেত্রী। মাণ্ডির সাংসদ কঙ্গনাকে এই সে দিন দিল্লির সংসদ ভবনে হনহনিয়ে ঢুকতে দেখা গেল মেটে রঙা একখানা আটপৌরে শান্তিপুরী শাড়িতে। কাজল আবার তাঁর ছবির মহরতে হাজির হলেন খাস বাংলার লালপেড়ে তসর রঙা জামদানি শাড়ি পরে। জাতীয় পুরস্কারের মঞ্চে প্রিয়ঙ্কা চোপড়াও পরেছিলেন বাংলার ফুলিয়ার তাঁতে বোনা লেবু-হলুদ মিনাকারি জাল জামদানি শাড়ি!

বাংলার তাঁতে বোনা বারো হাতের সুতোলি মায়াজাল।

বাংলার তাঁতে বোনা বারো হাতের সুতোলি মায়াজাল। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলার তাঁতে বোনা বারো হাতের সুতোলি মায়াজাল— জামদানি, শান্তিপুরী, বেগমপুরী, ধনেখালি! এককালে এই সব শাড়ির কদর ছিল কেবল বাঙালির অন্দরমহলেই। নকশা করা লেসের ব্লাউজ়ের সঙ্গে বেড় দিয়ে পরতেন বাঙালি ঘরের মহিলারা। পরম ভরসায় পোক্ত আঁচলের খুঁটে বেঁধে নিতেন চাবির গোছাখানা। কিন্তু বিশেষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার হলে তাঁত পড়ে থাকত এক পাশে। খোঁজ পড়ত দামি সিল্ক, বেনারসি, মিহি সুতোর মসলিন বা ঢাকাই শাড়ির। তাঁতের ঠাঁই হত ট্রাঙ্ক কিংবা আলনায়। ভাল শাড়ির জন্য খুলত আলমারি। দেখনদারি বাহারি পোশাক হিসাবে উচ্চ মহলে বহু দিন তেমন মর্যাদা পায়নি ‘সাধারণ’ সুতির তাঁতের শাড়ি। ইদানীং অবশ্য সেই বাংলার তাঁতের মায়াসুতোতেই বাঁধা পড়ছে রুপোলি জগৎ থেকে শুরু করে রাজনীতির ‘তারকা’রাও। এখন বিদ্যা বালন, শাবানা আজ়মি, ক্যাটরিনা কাইফের মতো নায়িকারা বাংলার তাঁত পরেন। সনিয়া গান্ধী, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা, নির্মলা সীতারামন, স্মৃতি ইরানি, মহুয়া মৈত্রের মতো রাজনীতিবিদেরাও সংসদে, রাজনৈতিক মঞ্চে হাজির হন তাঁতের শাড়ি পরে। দেশের রাষ্ট্রপতি ভবনে বিশেষ অতিথি আপ্যায়নের জন্যও বাংলার তাঁতকেই বেছে নেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুও। বলা যায় তাঁতের আমূল উত্তরণ হয়েছে। বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে তাঁত। কিন্তু যাঁদের রক্ত জল করা শ্রমে তাঁত বোনা হয়, তাঁরা বলছেন, উত্তরণ তো দূর অস্ত, তাঁতঘরে এখন অস্তাচলের হাতছানি!

তারকারা তো বটেই রাষ্ট্রপতি ভবনের বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য বাংলার জামদানি বেছে নেন রাষ্ট্রপতিও। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরাও বক্তৃতা মঞ্চে যান বাংলার তাঁতের শাড়িতে।

তারকারা তো বটেই রাষ্ট্রপতি ভবনের বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য বাংলার জামদানি বেছে নেন রাষ্ট্রপতিও। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বঢরাও বক্তৃতা মঞ্চে যান বাংলার তাঁতের শাড়িতে। ছবি: সংগৃহীত।

পদ্মশ্রী পাওয়া বাংলার তাঁতশিল্পী বীরেনকুমার বসাক বলছেন, ‘‘বাংলার হাতে বোনা তাঁতের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গিন। কোনও মতে বেঁচে আছে। অবস্থা এমনই যে, তাঁত ছেড়ে অন্য পেশার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন বহু তাঁতশিল্পী। তাঁতের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না নতুন প্রজন্ম। এ ভাবে চললে আর কিছু দিন পরে বাংলার তাঁত শেষ হয়ে যাবে।’’

বীরেন বসাকের ফেসবুক পেজ থেকে।

বীরেন বসাকের ফেসবুক পেজ থেকে। ছবি: সংগৃহীত।

১২ হাতের এক একটা শাড়ি বীরেনের কাছে ক্যানভাসের মতো। তাঁর পদ্মসম্মান প্রাপ্তি মিনা জামদানির কাজে সেই ক্যানভাস নিপুণ ভাবে সাজিয়ে তোলার জন্য। রংবেরঙের সুতোয় সেই শাড়িতে কখনও ফুটে ওঠে রামায়ণ, কখনও মহাভারতের কাহিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও তাঁতে বুনেছেন বীরেন। তাঁর সুতোয় আঁকা গ্রাম বাংলার ছবি দেওয়া শাড়ি পরেছিলেন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বীরেনের নকশা করা তাঁতের শাড়ি পরেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। সেই বীরেন বলছেন, ‘‘বাংলার তাঁতকে কিছুটা বাঁচিয়ে রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর কিছুটা তন্তুজ। কিন্তু যে হারে মেশিনে তাঁত বোনা হচ্ছে এবং সুরত থেকে শাড়ি ঢুকছে বাংলায়, তাতে বাংলার হাতে বোনা তাঁত বেশি দিন টিকবে না।’’

বীরেন বসাকের ফেসবুক পেজ থেকে।

বীরেন বসাকের ফেসবুক পেজ থেকে। ছবি: সংগৃহীত।

অথচ তাঁতের শাড়ির চাহিদা কম এ কথা বলতে পারবে না কেউ। নেটফ্লিক্সের জন্য তৈরি মীরা নায়ারের ছবি ‘দ্য স্যুটেবল বয়’-এর জন্য শাড়ির নকশা করেছিলেন উৎসব বুটিকের শর্মিষ্ঠা সাহা। মনে করে বললেন, ‘‘তিনি (পরিচালক) আমার থেকে বেশির ভাগই তাঁতের শাড়ি চেয়েছিলেন। মনে আছে বেগমপুরী, ধনেখালি, শান্তিপুরী শাড়ি দিয়েছিলাম। ওঁর পছন্দও হয়েছিল। আসলে সুতির শাড়ি পরার আরাম যেমন আলাদা, তেমনই সুতির শাড়ি আমাদের লুকও অন্য রকম করে দেয়। আমার বুটিকে রোজ যা শাড়ি বিক্রি হয়, তার ৭০-৮০ শতাংশই সুতির বা তাঁতের শাড়ি। বছর দশেক আগেও তাঁতের শাড়ি নিয়ে এত আগ্রহ দেখিনি।’’ অর্থাৎ, তাঁতের শাড়ির চাহিদা নেই, এমন বলা যায় না। বরং চাহিদা অন্য শাড়ির তুলনায় বেড়েছে।

বাংলার তাঁতের শাড়ি পরেন শাবানা আজমি, কাজল, বিদ্যা বালন, ক্যাটরিনা কাইফের মতো বলিউডের তারকা অভিনেত্রীরাও।

বাংলার তাঁতের শাড়ি পরেন শাবানা আজমি, কাজল, বিদ্যা বালন, ক্যাটরিনা কাইফের মতো বলিউডের তারকা অভিনেত্রীরাও। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলার তাঁতের শাড়িকে বিশ্ব বাংলা ব্র্যান্ডের মাধ্যমে বিদেশেও পৌঁছে দিয়েছে বাংলার সরকার। বাংলার জামদানি, বেগমপুরী, শান্তিপুরী, ধনেখালি পাওয়া যায় বিশ্ব বাংলার দেশ-বিদেশের শোরুমে। আবার তাঁতশিল্পীদের কাজ সরাসরি সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জেলায় জেলায় প্রতি বছর হয় তাঁতবস্ত্র মেলা। তার পরেও তাঁতিরা সুফল পাচ্ছেন না কেন?

নদিয়ার খরসড়াইয়ের তাঁতি নিতাই দে তাঁত বুনছেন প্রায় ৪০ বছর। তিনি বলছেন, ‘‘হাতে বোনা তাঁতে এক একটা শাড়ি বুনতে সময় লাগে অনেক বেশি। সারা দিন কাজ করে বড়জোর শাড়ি হয় চারটে কি পাঁচটা। অন্য দিকে, এক একটা মেশিনে একসঙ্গে দু’টি শাড়ি বোনা যায়। তাতে এক দিনে দু’টি লুমে তৈরি হয়ে যায় ৩২টা শাড়ি। মেশিনের গতির সঙ্গে কি মানুষ পাল্লা দিতে পারে?

নাম না প্রকাশের শর্তে জাঙ্গিপাড়া সমবায় সমিতির তাঁতি অনুপ দে (নাম পরিবর্তিত) আবার বলছেন, ‘‘পরিশ্রম যে করব, তার উপযুক্ত মজুরি তো দিতে হবে। এক এক দিনের তাঁতের কাজের জন্য দু’শো-আড়াইশো টাকা করে মজুরি দেওয়া হয়। সুতো সরকার দেয়। কিন্তু তাঁতির হাতে তা পৌঁছতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। বহু তাঁতিই ওই সব সমস্যার কারণে বংশানুক্রমিক কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। আমাদের ছেলেরাও পড়াশোনা করে আর তাঁতের কাজে আসছে না। ফলে আগে যত ঘর তাঁতি ছিল, এখন তার অর্ধেকও নেই। মেশিনে বোনা তাঁতের জন্য সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’’

কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা তাঁতের ক্লাস্টারগুলির ছবি একটু আলাদা। তাদের মজুরিও সমবায় সমিতির তাঁতিদের তুলনায় বেশি। বেগমপুর ক্লাস্টারের সদস্য সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘তাঁতের চাহিদা এখন অনেক বেশি। ভাল তাঁতের চাহিদা আরও বেশি। ক্লাস্টারের তাঁতিদের কোনও সমস্যা নেই। তাঁরা ভাল ভাবেই কাজ করছেন। সময়ে মজুরি এবং সুতোও পাচ্ছেন। মেশিনের শাড়ি কখনওই ভাল তাঁতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে পারবে না।’’

যদিও অভিজ্ঞ শিল্পী বীরেনের বক্তব্য, মেশিনের সঙ্গে হাতে বোনা তাঁতের পাল্লা দেওয়া কঠিনই নয়, অসম্ভব। তিনি আরও একটি সমস্যার কথা বলছেন, ‘‘বাংলার তাঁতিদের শাড়ির নকশার আদল হুবহু নকল হয়ে যাচ্ছে। আমরা সাত-আট মাস ধরে যে শাড়ির নকশা করছি। সেই শাড়ির নকশা নকল হয়ে চলে আসছে গুজরাতের সুরত থেকে। তফাত শুধু একটাই। মেশিনে এখনও পুরোপুরি সুতোর শাড়ি বোনা যায় না। নাইলন বা পলিয়েস্টার মেশাতেই হয়। তবে শুনছি, এ বার সুতোও বোনা হবে। সেটা হলে আর বাংলার হাতে বোনা তাঁতের শিল্পীদের বাঁচানো যাবে না।’’

অভিজ্ঞ তাঁতিরা পেশা ছেড়ে চলে যাওয়ায় এখন গ্রামের মহিলাদের দিয়েই তাঁত বোনানো হচ্ছে।

অভিজ্ঞ তাঁতিরা পেশা ছেড়ে চলে যাওয়ায় এখন গ্রামের মহিলাদের দিয়েই তাঁত বোনানো হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত।

বীরেনের সুরেই কথা বলছেন তৃণমূল বিধায়ক ব্রজকিশোর গোস্বামীও। বাংলার তাঁতের খাসতালুক যে শান্তিপুর, সেই শান্তিপুরের বিধায়ক তিনি। সুরতের কাপড় যে বাংলার শাড়ির অস্তিত্বকে বিপন্ন করছে, তা মেনে নিয়েই ব্রজকিশোর বলছেন, ‘‘গুজরাতের সুরত থেকে আসা শাড়ির জন্য বাংলার শাড়ির ক্ষতি হচ্ছে। চাহিদাও কমছে। তা ছাড়া এটাও ঠিক যে, তাঁতের শিল্পে নতুন প্রজন্ম আসছে না।’’ তবে একসঙ্গেই শান্তিপুরের বিধায়ক এ-ও বলছেন যে, সরকার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছে। ব্রজকিশোর বলছেন, ‘‘এ বারের রাজ্য বাজেটের পুস্তিকায় নজর রাখলেই দেখবেন, তাঁতশিল্পীদের জন্য সরকার একটি ডব্লু বি কার্ড তৈরি করেছে। ওই কার্ডে ৫-১০ হাজার টাকার সুতো বিনা সুদে পাবেন তাঁতিরা। তাঁতঘর নির্মাণ এবং মেরামতের জন্যও পাঁচ হাজার টাকা করে পাবেন। এ ছাড়া, ওই কার্ডের সাহায্যে বাংলার তাঁতিরা ১-১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের সংস্থানও পেতে পারেন।’’

যদিও তাঁতশিল্পী বীরেন বলছেন, সুরত থেকে আসা শাড়ি আটকানো না গেলে বাংলার তাঁতকে রক্ষা করা যাবে না। বীরেনের কথায়, ‘‘এখন যা পরিস্থিতি, তাতে যাঁরা একটু অন্য রকম তাঁতের কাজ করতে পারেন, তাঁরাই টিকে থাকবেন। যাঁরা সাধারণ পাড় আর বুটিদার তাঁত বোনেন, মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাঁদের বেঁচে থাকা মুশকিল। আমার এখানে কাজ করা বহু তাঁতিই তাঁতের কাজ ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছেন। কেউ কাজ করতে চাইছেন না। তাই আমরা এখন গ্রামের মেয়েদের কাজ শেখাচ্ছি। তাঁদের ধৈর্য আছে। সংসার সামলে কাজ শিখে কাজ করছেও। কিন্তু বাইরে থেকে শাড়ি আসা বন্ধ না করা গেলে বাংলার তাঁতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা মুশকিল।’’

অর্থাৎ, তাঁতের শাড়ি আছে। কিন্তু তাঁতি নেই। চাহিদা আছে অথচ খাঁটি জোগানদারদের কদর নেই। তাঁতশিল্পের উন্নতির নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও বাংলার তাঁতঘরের ছবিটা আপাতত এ রকমই।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengal Tant
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy