—প্রতীকী চিত্র।
‘মোদের বলতে নাহি লাজ, মোদের মিষ্টি খাওয়াই কাজ...’
বাঙালির নাকি শুধু মিষ্টি হলেই হয়। পিঠে-পুলি-পাটিসাপটা, রসগোল্লা, মিষ্টি দই ইত্যাদির পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে সুফলে, কেক, কুকিজ়, আইসক্রিম নানা মিষ্টি জাতীয় খাবারও। অথচ অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকেই এখন বাদ মিষ্টি। কারণ, ডায়াবিটিসের রক্তচক্ষু। এ দিকে সকালে মিষ্টি ছাড়া চা মুখে রোচে না। তা হলে উপায়?
ছেলের বিয়েতে বাংলার নানা প্রান্তের হরেক রকমের মিষ্টির আয়োজন করেছিলেন প্রদীপ্তবাবু। কিন্তু নিজের তো বটেই নিমন্ত্রিত অনেকেরই যে রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি। উপায় বাতলালেন কারিগর। ডায়াবেটিক অতিথিদের জন্য সব মিষ্টিতেই চিনির বদলে ব্যবহার হবে কৃত্রিম চিনি।
অন্য দিকে ক্রমাগত বাড়তি ওজন নিয়ে চিন্তিত ঋক। পুষ্টিবিদের পরামর্শ মতো নিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়া করলেও, এই গরমে ঠান্ডা নরম পানীয় ছাড়া চলে নাকি! ঋকের মতো আরও অনেকের দুশিন্তা মেটাতে জনপ্রিয় এক সংস্থা বাজারে এনেছে ডায়েট পানীয়। রাস্তায় বেরোলে আজকাল তাই নিশ্চিন্তে ঋক নিজের জন্য বেছে নিচ্ছে ডায়েট কুকিজ়, ডায়েট কোক।
এ ধরনের নানা উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের চারপাশে। কিন্তু চিনির বদলে কৃত্রিম চিনির এই ব্যবহার শরীরের জন্য কতটা উপযোগী? ডায়েট পানীয়, কুকিজ়ে আদতে কতটা মিষ্টি কম থাকে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃত্রিম চিনিতে ওজন কমে না, বরং এতে ব্যবহৃত উপাদান শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্যই প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কৃত্রিম চিনির মূল উপাদানগুলি হল— অ্যাসপার্টেম, সুক্রোজ়, সুক্রালোজ়, স্যাকারিন, নিওটেম, স্টিভিয়া ইত্যাদি। যে কোনও প্রক্রিয়াজাত খাবার, জাঙ্ক ফুড, ডায়েট পানীয়তে এই অ্যাসপার্টেম থাকে।
চিকিৎসকদের মত
জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর মণ্ডল বললেন, “কৃত্রিম চিনি দু’ধরনের হয়। এক ধরনের কৃত্রিম চিনি শরীরে গিয়ে কোনও রকম ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে না। এ ধরনের চিনি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর নয়। এর প্রাকৃতিক উৎসও রয়েছে। তবে তা সহজলভ্য নয়। অন্য দিকে চিনি থেকেই রাসায়নিক পদ্ধতিতে এক ধরনের কৃত্রিম চিনি তৈরি হয়, যা শরীরে গিয়ে নানা যৌগে ভেঙে যায় এবং শরীরের ক্ষতি করে। সুগার-ফ্রি মিষ্টি, কুকিজ়, আইসক্রিম, কেক... যা-ই হোক না কেন, তাতে মূলত এই দ্বিতীয় রকম কৃত্রিম চিনি ব্যবহার হয়। কিন্তু তাপের সংস্পর্শে এলে এই ধরনের চিনি বিক্রিয়াজাত হয়ে আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। ফলে তা আরও মারাত্মক হয়ে যায়।” ডা. মণ্ডলের মতে, চিনির তুলনায় এই কৃত্রিম চিনি কম করেও অন্তত প্রায় তিনশো গুণ বেশি মিষ্টি হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই এর দাম বেশি হয়। ব্যবসায়িক কারণে মধ্যবিত্তের সাধ্যের নাগালে আনতে তাই অনেক সময়েই এতে সিলিকা সহ নানা ধরনের ক্ষতিকর পণ্য মেশানো হয়। ফলে নানা ধরনের ক্ষতি হয়েই থাকে।
ক্ষতিকর নানা দিক
ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট অনন্যা ভৌমিকের কথায়, শরীরে অতিরিক্ত পরিমাণে অ্যাসপার্টেম প্রবেশে ক্যানসারের মতো মারণরোগের আশঙ্কা বাড়ে, মাথা যন্ত্রণা, অস্থিরতা, স্নায়ুর সমস্যাও হতে পারে। তা ছাড়া রয়েছে নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও।
বিশেষজ্ঞদের মত
পুষ্টিবিদ কোয়েল পালচৌধুরীর মতে, অ্যাসপার্টেমে যে পরিমাণ ক্যালরি থাকে, তা চিনির সমকক্ষ। কিন্তু চিনির চেয়ে অ্যাসপার্টেম বেশি মিষ্টি এবং পরিমাণে লাগে কম। অ্যাসপার্টেমের গ্লাইসেমিক ইনডেক্সও শূন্য। সে কারণে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খাবারের মধ্যে তা ব্যবহারের অনুমতি দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিষ্টি খাওয়ার অভ্যেস ছাড়তেই হবে। তা ছাড়া, ‘সুগার-ফ্রি’ কথাটা আদতে মিথ। ডায়েট পানীয় বা ডায়েট কুকিজ় কথাগুলি কেবল ব্যবসায়িক স্বার্থে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত।
পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরীর মতে, বিষয়টি নতুন নয়। আগেও এই সব খাদ্যপণ্যকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কৃত্রিম মিষ্টি ল্যাবে তৈরি। তার প্রাকৃতিক কোনও উৎস নেই। তাই ডায়াবেটিক রোগীদের বিকল্প নয়, মিষ্টি খাওয়া সম্পূর্ণ রূপে বাদ দিতে হবে। রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বরং তাঁরা কখনও ছানার হালকা সন্দেশ একটা-দুটো খেতে পারেন। পাশাপাশি সুবর্ণার মতে, ওজন কমাতে মিষ্টি বাদ দিলেও শরীরে চিনির প্রয়োজন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিষ্টি ফল খাওয়া যেতে পারে। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অল্প মধু কিংবা গুড়ও রাখা যায়। ডায়াবেটিক রোগী মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে দমন করতে না পারলে দিনে অর্ধেক খেজুর খেতে পারেন।
অনন্যা বলছেন, কৃত্রিম মিষ্টি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই নির্দেশ কিন্তু কেবল খাদ্যপণ্যের ব্যাপারেই লাগু হয়। বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্য যেমন টুথপেস্ট, ত্বকের ক্রিম, ওষুধ বা সুগার অ্যালকোহলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে এই নির্দেশিকা নিয়ে কথাবার্তা এখনও প্রাথমিক স্তরেই রয়েছে। অনন্যার মতে, ভূপ্রকৃতি, পরিবেশ, কর্মক্ষমতা নির্বিশেষে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বয়সের অধিবাসীদের ব্যবহার মাত্রা ও অন্যান্য নানা বিষয়ের উপরে কৃত্রিম চিনির পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে। ডা. মণ্ডলের মতে, এর ব্যবহারে ঠিক কোন ধরনের ক্যানসার হয়, তাও নির্দিষ্ট করে জানায়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কোয়েলের মতে, কৃত্রিম চিনির মধ্যে স্টিভিয়া কিন্তু অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক অর্থাৎ ক্যান্সার প্রতিরোধক। যদিও সহজলভ্য নয়, তবে প্রয়োজনে কিন্তু তা খাওয়া যায়।
কৃত্রিম চিনিতে ক্যানসারের আশঙ্কা এবং শারীরিক অন্যান্য ক্ষতির বিষয়টি এখনও আলোচনা সাপেক্ষ হলেও, অবশ্যই প্রাথমিক ভাবে সাবধান হওয়া উচিত। কিন্তু চিনির বিকল্প হিসেবে তা কি দৈনন্দিন খাদ্যতালিকা থেকে একেবারেই পরিহার করতে হবে? একজন মানুষের খাদ্যতালিকায় কৃত্রিম চিনি কতটুকু রাখা যেতে পারে, তা নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট নির্দেশিকা এখনও পর্যন্ত আসেনি। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে তা খাওয়া যে বিষ, সে বিষয়ে একমত চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ সকলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy