খাবারে যেন এই মৌলের ঘাটতি না হয়। ছবি: শাটারস্টক
কোভিড আক্রান্তদের অনেকেই সেরে ওঠার পর বেশ কিছুদিন ক্লান্তিতে ভোগেন। তবে অনেকেই আছেন যাঁদের করোনা ভাইরাস স্পর্শ করতে না পারলেও দিনভর ঘুম ঘুম ভাব, কোনও কাজেই বিশেষ উৎসাহ পান না। কিংবা যত্ন-আত্তি করা সত্ত্বেও হু হু করে চুল ঝরে যাচ্ছে। আবার কম খেয়ে ওজন বাড়ছে আর বারবার ময়েশ্চারাইজার লাগিয়েও ত্বক শুকিয়ে যাচ্ছে। এ সব উপসর্গের মূল কারণ খাবারে আয়োডিনের অভাব।
আয়োডিন এমন একটা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যা আমাদের শরীরের পুষ্টির জন্য জরুরি। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস হল খাবারের এমন এক উপাদান যা অত্যন্ত অল্প পরিমাণে খাবারে থাকলেই শরীরের চাহিদা মেটে।
ল্যানসেটে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, বিশ্বের প্রায় ১৯০ কোটি মানুষের দৈনিক খাবারে আয়োডিনের অভাব আছে। এঁদের মধ্যে ২৮.৫ কোটি স্কুলের বাচ্চা।
আরও পড়ুন:ইভেরমেক্টিন কি করোনা মোকাবিলার নয়া তুরুপের তাস? কী বলছেন চিকিৎসকরা
নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রতিরোধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) আয়োডিনকে রোজকারের খাবারের তালিকায় রাখার ব্যাপারে জোর দিয়েছে, জানালেন ইন্টারন্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক অর্পণ চৌধুরী। আয়োডিনের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের দেশে ১৯৮৪ সালে নুনে আয়োডিন মেশানো বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। তখন থেকেই সাধারণ নুন সোডিয়াম ক্লোরাইডে সামান্য পরিমাণে সোডিয়াম বা পটাসিয়াম আয়োডাইড মিশিয়ে দেওয়া হয়। অর্পণ চৌধুরী বললেন যে খাবারের মাধ্যমে আয়োডিন পেতে গেলে একজন মানুষকে হাতির সমপরিমাণ খাবার খেতে হবে। তা সম্ভব নয় বলেই বিশ্বের অনেক দেশেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্দেশ মেনে নুন, আটা ইত্যাদি রোজকার কিছু খাবারের প্যাকেটে আয়োডিন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দিনভর ঘুম ঘুম ভাব। হতে পারে আয়োডিনের ঘাটতি। ছবি: শাটারস্টক
আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিজঅর্ডার সম্পর্কে বিশ্বের সব দেশের মানুষকে সচেতন করতে হু উদ্যোগী হয়েছে ১৯৬০ সাল থেকেই। আমাদের দেশের চিকিৎসক ও পুষ্টি বিজ্ঞানীরা তখন থেকেই এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। আর এই জন্য ২১ অক্টোবর দিনটিকে ‘গ্লোবাল আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি প্রিভেনশন ডে’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির সময়েও আয়োডিন ঘাটতি গুরুত্ব হারায়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও এই দিনটি পালন করা হয়েছে। যদিও আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ আয়োডিনযুক্ত নুন খান বলে ‘আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিজঅর্ডার’-এর প্রবণতা অনেকটাই কম, তাও এই মুহূর্তে আমাদের দেশের ছয় কোটি মানুষ আয়োডিনের অভাবজনিত গয়টার বা গলগণ্ড-সহ (গলার কাছটা মারাত্মকভাবে ফুলে যায়) নানা অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন:বিপদসঙ্কেত! ‘কেরলের শিক্ষা না নিলে পুজোর পর করোনা-সুনামি’
৮৮ লক্ষ মানুষের মনের অসুখ, মোটর নার্ভের অসুখ ও বুদ্ধির বিকাশ না হওয়ায় কারণ আয়োডিনের অভাব। সমুদ্রের ধারের গ্রাম বা শহরে আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা অনেক কম। তুলনামূলক ভাবে পাহাড় অঞ্চলে বাচ্চাদের মধ্যে ক্রেটিনিজম, স্প্যাস্টিসিটি ( মস্তিষ্কের বিকাশ কম ও পেশির সমস্যা), গলগণ্ড-সহ আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা অনেক বেশি। আসলে সমুদ্র হল আয়োডিনের একটা ভাল উৎস। আয়োডিন অত্যন্ত অল্প পরিমাণে প্রয়োজন হলেও এর অভাবে নানান শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে হবু মায়ের যদি আয়োডিনের অভাব থাকে তাহলে জড়বুদ্ধি ও স্প্যাস্টিক শিশুর জন্ম ছাড়াও থাইরয়েডের অসুখ গয়টার বা গলগণ্ড-সহ নানা ধরনের সমস্যা হয়। ডক্তারি পরিভাষায় একে বলে আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিজঅর্ডার (আইডিডি)।
আরও পড়ুন: দ্রুত মেদ ঝরাতে চান? বিপাকক্রিয়ার হার বাড়াতে কী কী করবেন
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জড়বুদ্ধি, কম বুদ্ধি ও স্প্যাস্টিক শিশুদের এসব সমস্যার অন্যতম কারণ হবু মায়ের খাদ্য তালিকায় যথাযথ পরিমাণে আয়োডিনের অভাব। সমুদ্রের জলে হ্যালোজেন গ্রুপের প্রায় সব কটি মৌল (যেমন ফ্লোরিন, ক্লোরিন, ব্রোমিন আর আয়োডিন) থাকে। সমুদ্রের কাছে থাকা মানুষদের আয়োডিনের অভাব হয় না।
আমাদের রোজকার ডায়েটে কতটা আয়োডিন প্রয়োজন সেই নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা তালিকা আছে। প্রতিদিন কার কতটা আয়োডিন প্রয়োজন। ( ১ গ্রাম = ১ লক্ষ মাইক্রোগ্রাম)।
০ থেকে ৬ মাস বয়সে ১১০ মাইক্রোগ্রাম
৭ থেকে ১২ মাস ১৩০ মাইক্রোগ্রাম
১ থেকে ৩ বছরে ৯০ মাইক্রোগ্রাম
৪ বছর থেকে ৮ বছরে ৯০ মাইক্রোগ্রাম
৯ বছর থেকে ১৩ বছরে ১২০ মাইক্রোগ্রাম
১৪ বছর থেকে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম
হবু মায়েদের ২২০ মাইক্রোগ্রাম
যে বাচ্চারা মায়ের দুধ খায়, সেই মায়েদের ২৯০ মাইক্রোগ্রাম।
হবু মায়ের আয়োডিনের অভাবে শিশুর বৌদ্ধিক বিকাশে সমস্যা হতে পারে। ছবি: শাটারস্টক
আমাদের গলার কাছে থাকা থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন ও অন্যান্য হরমোন বেরোয় যা আমাদের বুদ্ধির বিকাশ-সহ নানান শারীরিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন: হার্ট ভাল রাখার অব্যর্থ দাওয়াই, কেন রোজ খেতেই হবে ‘নিরামিষ মাংস’
অল্পবিস্তর আয়োডিনের অভাবে হাইপোথাইরয়েডিজম অর্থাৎ থাইরয়েড হরমোন কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা যায়। আয়োডিনের অভাবে আরও কিছু সমস্যা হয়। যেমন থাইরয়েড গ্রন্থি আকারে বেড়ে যায়, থাইরয়েড হরমোনের নিঃসরণ কমে গিয়ে হাইপো-থাইরয়েডিজম হয়, বুদ্ধির বিকাশ কমে যায়, মানসিক অসুস্থতা শুরু হয় এমনকি মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
এ ছাড়া স্নায়ু ও সংলগ্ন পেশির স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে গিয়ে পেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, হবু মায়ের আয়োডিন ঘাটতি হলে শিশুর বুদ্ধির বিকাশ হয় না, মানসিকভাবে বিপন্ন ও স্প্যাস্টিক শিশুর জন্ম হয়। এমনকি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই ভ্রূণ মারা যেতে পারে। বাচ্চাদের কানে কম শোনা ও কথা বলতে না পারার মত সমস্যার ঝুঁকি থাকে, জন্মের পর আয়োডিনে অভাব হলে বাচ্চা ক্রমশ জড়বুদ্ধি হয়ে পড়ে। বাচ্চার বেড়ে উঠতে সমস্যা হয়। বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে শিশুটি ডোয়ার্ফ বা বামন হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া চুল ঝরে যাওয়া, ওজন বাড়া, ত্বক খসখসে হয়ে যাবার মত সমস্যা হয়।
আরও পড়ুন:ঘন ঘন কফি পান ভাল না খারাপ?
ডায়েটিশিয়ান ইন্দ্রাণী ঘোষ জানালেন কোন কোন খাবার থেকে আমরা কতটা আয়োডিন পেতে পারি। ১/৪ চা চামচ নুন থেকে মেলে ৯৫ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন, ১ পিস সামুদ্রিক মাছে ৬৫০ মাইক্রোগ্রাম, ১ টা কলায় ৩ মাইক্রোগ্রাম, ১ টা বড় ডিমে ১২ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন পাওয়া যায়। এছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া, মাংস, সমুদ্রের সবরকম মাছ ও অন্যান্য সি ফুড আর দুধেও আয়োডিন পাওয়া যায়। প্রমাণিত না হলেও কিছু বিজ্ঞানীর দাবি আয়োডিনযুক্ত নুন জলে গার্গল করলে কোভিড-১৯ ভাইরাস জব্দ হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy