Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
মস্তিষ্কেও টিউমার হতে পারে। হলেই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জানালেন নিউরোসার্জন সৈকত সাহা

টিউমার যখন মস্তিষ্কে

শরীরের অন্য জায়গায় হওয়া ক্যানসার অনেক সময়ে ছড়িয়ে মস্তিষ্কে চলে যায়। মস্তিষ্কে টিউমার তৈরি হয়। বংশগত কারণেও ব্রেন টিউমার হতে পারে।

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। নিজস্ব চিত্র

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৪০
Share: Save:

প্রশ্ন: ব্রেন টিউমার কী?

উত্তর: টিউমার হচ্ছে শরীরের যে কোনো জায়গায় বা অঙ্গে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এবং এই টিউমারটি যখন মস্তিষ্কের ভিতরে হয় তখন সেটাকে আমরা বলি ব্রেন টিউমার।

প্রশ্ন: ব্রেন টিউমার কেন হয়?

উত্তর: ব্রেন টিউমারের কারণ এখনও পর্যন্ত অজানা। শরীরের অন্য জায়গায় হওয়া ক্যানসার অনেক সময়ে ছড়িয়ে মস্তিষ্কে চলে যায়। মস্তিষ্কে টিউমার তৈরি হয়। বংশগত কারণেও ব্রেন টিউমার হতে পারে।

প্রশ্ন: এর লক্ষণগুলো কী কী?

উত্তর: ব্রেন টিউমারের লক্ষণ এক এক সময়ে এক এক রকম হতে পারে। এর প্রধান বা স্বাভাবিক লক্ষণ হচ্ছে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া এবং দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ কমে যাওয়া। এই তিনটিকে আমরা সব টিউমারের ক্ষেত্রে ধরতে পারি। এ ছাড়াও অনেক সময় রোগীর অন্য লক্ষণও দেখা দিতে পারে। যেমন, রোগীর খিঁচুনি হতে পারে অথবা শরীরের যে কোনো এক দিকের হাত বা পা দুর্বল হয়ে যায় অথবা তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে অর্থাৎ তার আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেবে। অনেক ক্ষেত্রে হরমোনের নিঃসরণের আধিক্য বা ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যা ব্রেন টিউমারের রোগীর ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পায়।

প্রশ্ন: কাদের এই রোগ বেশি হতে পারে। এ দেশে এই রোগের প্রকোপ কেমন?

উত্তর: কিছু টিউমার আছে যা ছোটদের বেশি হয়, আবার কিছু টিউমার আছে যা ৬০ বছরের উপরে বেশি হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে সব ধরনের টিউমারের লক্ষণ এক রকম নয়। এক এক ক্ষেত্রে টিউমারটি এক এক রকম ভাবে প্রকাশ পায়। যার ফলে আমরা বলতে পারব না কাদের ক্ষেত্রে টিউমার বেশি হয়। এক কথায় বলতে পারি, যে কোনও বয়সের, যে কোনো পুরুষ বা মহিলার ব্রেন টিউমার হতে পারে। শিশু, বয়স্ক ও মহিলাদের টিউমারের ক্ষেত্রে রকমফের রয়েছে। এটা সত্যি দুঃখজনক যে, ক্রমশ আমরা এর প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে দেখছি। তবে ঠিক পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই।

প্রশ্ন: ব্রেন টিউমার কি সারানো সম্ভব?

উত্তর: ব্রেন টিউমার মানেই ক্যানসার এটা ভুল ধারণা। কিছু কিছু টিউমার আছে যা খারাপ টিউমার বা ক্যানসারের টিউমার। কিন্তু অনেক টিউমারই আছে যেগুলি সম্পূর্ণ ভাবে সেরে যেতে পারে। কিছু কিছু টিউমার আছে যার ঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যায়। আর কিছু থেকে সমস্যা হতে পারে।

প্রশ্ন: বিনাইন ব্রেন টিউমার আর ক্যানসারের ব্রেন টিউমারের মধ্যে পার্থক্য কী?

উত্তর: বিনাইন টিউমার মানে ভাল আর ক্যানসারের ব্রেন টিউমার হচ্ছে খারাপ টিউমার। প্রকৃতিগত ভাবে পার্থক্য হচ্ছে বিনাইন ব্রেন টিউমার খুব আস্তে আস্তে হয়, যার ফলে এই রোগের লক্ষণ বা প্রকাশ অতটা তাড়াতাড়ি হয় না। আর ক্যানসারের ব্রেন টিউমার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

প্রশ্ন: প্রাইমারি ব্রেন টিউমার কী কী?

উত্তর: প্রাইমারি ব্রেন টিউমার সাধারণত মস্তিষ্কের বিভিন্ন কোষ-কলা থেকে তৈরি হয় এবং এর মধ্যে ক্যানসারের টিউমারগুলি হচ্ছে— অ্যাস্ট্রোসাইটোমা, অলিগোডেন্ত্রোগ্লাইয়োমা, মেডুলোব্লাস্টোমা, ইপেনডাইমোমা ও লিম্ফোমা।

প্রশ্ন: ব্রেন টিউমার কী ভাবে চিহ্নিত করা হয়? এর জন্য কী ধরনের পরীক্ষা করা হয়?

উত্তর: যে কোনও রোগ নির্ণয়ের প্রথম পদ্ধতিই হচ্ছে রোগীকে ক্লিনিকে আনা, পর্যবেক্ষণে রাখা। রোগীর শারীরিক পরীক্ষা করাকে আমরা বলি নিউরোলজিক্যাল বিশ্লেষণ। রোগীর বর্ণনা থেকে এবং রোগের লক্ষণ দেখে ধারণা করা যায়। মাথার সাধারণ এক্স-রের মাধ্যমে আমরা কিছু ধারণা করতে পারি কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভাবে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি নয়। ঠিক পদ্ধতি হচ্ছে সিটি-স্ক্যান। এবং আরও ভাল হচ্ছে এমআরআই।

প্রশ্ন: ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত রোগীর পরিণতি কী?

উত্তর: সাধারণ ভাবে আমরা টিউমারকে দুই ভাগে ভাগ করি। ১) ভাল টিউমার, ২) খারাপ টিউমার। ভাল টিউমার যদি ঠিক ভাবে অপারেশন করে সম্পূর্ণ বের করা যায় তা হলে রোগী সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যাবেন। আর যদি ক্যানসারের টিউমার হয়, তবে তার রকমভেদ আছে। কিছু কিছু খারাপ টিউমার আছে যা হলে রোগী কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকতে পারেন। আর কিছু কিছু টিউমার আছে যা এতই খারাপ যে, রোগী ছ’মাস থেকে এক বছরের বেশি বেঁচে থাকে না।

প্রশ্ন: ব্রেন টিউমার চিকিৎসায় কী কী পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়?

উত্তর: টিউমারের চিকিৎসার অন্যমত পদ্ধতি হল অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচার করে রোগীর টিউমারকে বের করে, বায়োপসি করে প্রকৃতি নির্ণয় করে পরবর্তী চিকিৎসার
ব্যবস্থা করা হয়।

প্রশ্ন: এই রোগের কি কোনও খাওয়ার ওষুধ আছে। যা থেকে রোগ সারানো সম্ভব?

উত্তর: ব্রেন টিউমারের খাওয়ার ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়, তবে রোগের লক্ষণগুলির চিকিৎসা ওষুধ দ্বারা করা সম্ভব। টিউমারের জন্য যে সব লক্ষণ যেমন, মাথাব্যথা ও বমি হওয়া এই সব লক্ষণের চিকিৎসা আমরা ওষুধ দিয়ে করতে পারব। তাও সাময়িক ভাবে। টিউমার যখন আস্তে আস্তে বড় হবে টিউমারের লক্ষণগুলি আরও বেশি প্রকট হয়ে ধরা পড়বে, যার ফলে ওষুধ দিয়ে শুধু সাময়িক ভাবে তার লক্ষণগুলিকে কিছু দিন কমিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু ওষুধের চিকিৎসা টিউমারের জন্য নয়।

প্রশ্ন: অপারেশনের মাধ্যমে কী ভাবে ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা করা হয়?

উত্তর: অপারেশনের মাধ্যমে মস্তিষ্ক খুলে যে অংশে টিউমারটা আছে সম্ভব হলে সম্পূর্ণ বা আংশিক ভাবে টিউমারটাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ক্যানসারের টিউমারের ক্ষেত্রে আমরা যতটুকু সম্ভব বের করে দিই। যত বেশি বের করা যায় রোগীর উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। এমন কিছু পদ্ধতি আছে, যার মাধ্যমে ব্রেন টিউমার বের করার জন্য মস্তিষ্ক খুলতে হয় না। রেডিও সার্জারির মাধ্যমে ছোট ছোট টিউমার যেমন ২.৫ সেন্টিমিটার বা ১ ইঞ্চির
মতো সেগুলিকে আরও ছোট বা নষ্ট করে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন: কী ধরনের অপারেশন হবে তা কী ভাবে নির্ণয় করা হয়?

উত্তর: কী ধরনের অপারেশন হবে তা নির্ভর করে টিউমারের আকার, চরিত্র এবং কোথায় হয়েছে তার উপরে। যেমন, বড় টিউমার, যদি মনে হয় কিছু না করে রেখে দেওয়া বিপজ্জনক, যদি গুরুত্বপূর্ণ কোষ এবং স্নায়ুকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে যে পুরো বাদ দিলে বিপদের আশঙ্কা আছে, সে ক্ষেত্রে ডি-বালকিং সার্জারি করা হয়। অর্থাৎ আশপাশের অংশগুলিকে কম বিব্রত করে যতখানি সম্ভব টিউমার কেটে বাদ দেওয়া। এতে দু’টি লাভ, প্রথমত, কোষ পরীক্ষা করে টিউমারের ধরন ঠিক করা যায়। অপারেশনের পরে চিকিৎসা মূলত এর উপরেই নির্ভর করে।

দ্বিতীয়ত, রোগী কষ্টের হাত থেকে কিছুটা বা পুরোটা মুক্তি পান। আবার মাথায় ছোট ফুটো করে অপারেশন করা যায়, কখনও কম্পিউটারে টিউমারের জায়গা মেপে বাইরে থেকে রেডিয়েশন পাঠিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছোট বিশেষ ধরনের টিউমারে গামা নাইফ দিয়ে অপারেশন করে খুব ভাল ফল পাওয়া যায়। বড় টিউমারেও অনেক সময় অপারেশন করে যতটা সম্ভব বাদ দিয়ে বাকিটুকুর জন্য গামা নাইফ ব্যবহার করা যেতে পারে। গামা নাইফ লক্ষ্যকেন্দ্রিক বলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব কম। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারে অপারেশন এবং রেডওথেরাপি করে ভাল ফল হয়।

প্রশ্ন: সবার ক্ষেত্রেই কি ব্রেন টিউমার অপরাশেন করা যায়?

উত্তর: মস্তিষ্কের প্রতি সেন্টিমিটার জায়গা কোনও না কোনও শারীরিক বা মানসিক কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে অংশেই টিউমার হোক না কেন, যত ছোটই হোক, বিপদের আশঙ্কা আছে। কাজেই তাকে বাদ দিয়ে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সব সময় তা করা যায় না। ছোট টিউমার, উপসর্গ তেমন নেই, দৈবাৎ নজের এসেছে বা সামান্য উপসর্গ আছে কিন্তু অপারেশন করলে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি অথবা রোগী বয়স্ক অন্য কোনও কারণে অসুস্থ মানুষ— এ রকম ক্ষেত্রে উপসর্গ থাকলেও সচরাচর অপারেশন করা হয় না। তার বদলে রোগীকে নজরদারিতে রেখে দেখা হয় টিউমার কী গতিতে বাড়ছে, শারীরিক কষ্ট দেখা দিচ্ছে বা বাড়ছে কি না, টিউমার বাদ না দিলে কী কী ক্ষতির আশঙ্কা আছে, অপারেশন বা রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রোগী মেনে নিতে প্রস্তুত কি না ইত্যাদি অর্থাৎ টিউমার নিয়ে রোগী যে রকম জীবনযাপন করছেন বা করবেন, অপারেশন করে তার চেয়ে ভাল জীবন দেওয়া গেলেই অপারেশনের প্রশ্ন।

প্রশ্ন: ব্রেন টিউমারের চিকিৎসায় রেডিওথেরাপির ভূমিকা কী?

উত্তর: রেডিওথেরাপি টিউমারটিকে আপাত ছোট করে দেয় বা টিউমারের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। অপারেশন করার পরে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। অপারেশন করার পরে যদি দেখা যায় যে টিউমারিটি ক্যানসারের টিউমার বা খারাপ টিউমার। সে ক্ষেত্রে রোগীকে আগে থেকেই বলে দেওয়া হয় সার্জারি করলে সম্পূর্ণ ভাবে এটি ভাল হবে না এবং অপারেশন করার পরেও রেডিওথেরাপি মাধ্যমে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। টিউমারটি বের করে দেওয়ার পরে ওই জায়গায় রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় যেন টিউমারটির ক্ষমতা
কমে যায়।

প্রশ্ন: অপারেশনের পরে কী রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন?

উত্তর: অপারেশন করা হয় রোগীর ভালর জন্যই। কাজেই অপারেশনের পরে রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। তবে জটিল টিউমারে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে রোগীর মুখ অল্প বেঁকে যেতে পারে, চোখে ট্যারা ভাব আসতে পারে। শ্রবণশক্তির ঘাটতি, ভারসাম্য কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তির কিছুটা কমে যাওয়া ইত্যাদি নানা কিছু হতে পারে। আসলে সম্পূর্ণ ব্যাপারটিই নির্ভর করে টিউমার কোথায় হয়েছে, কী গতিতে বাড়ছে এবং তার ধরনের উপরে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগ ঠিক সময়ে ধরা পড়লে খুব ভাল ভাবে অবস্থা সামলানো যায়।

সাক্ষাৎকার: বিপ্লব ভট্টাচার্য

অন্য বিষয়গুলি:

Brain Tumour Interview Doctor Fear Treatment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE