‘দ্য ইন্দ্রাণী মুখার্জি স্টোরি: বারিড ট্রুথ’ তথ্যচিত্রের পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।
আমি নাকি ভাল মা নই! সন্তানদের প্রতি যত্নশীল না। তার উপরে আমার একাধিক বিয়ে। কখনও কান্নাকাটি করতে দেখা যায় না। সবই বুঝলাম। কিন্তু সে সবের সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক কী?
অপরাধ তো আলাদা বিষয়। তার সঙ্গে প্রেম-বিয়ে-মাতৃত্বের সম্পর্ক কী? আমার বিরুদ্ধে নিজের মেয়ে শিনা বরাকে খুনের অভিযোগ ওঠার পর থেকে চরিত্র নিয়ে চর্চা শুরু হয়। আর সে সব দেখেই একটি প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদি আমি নারী না হয়ে পুরুষ হতাম, তা হলে কি গল্পের মোড় একই রকম থাকত? একই ভাবে মুখরোচক গল্প তৈরি হত কি আমাকে নিয়ে? একই ধরনের প্রশ্ন উঠত?
সম্প্রতি শিনা বরা-কাণ্ড নিয়ে একটি তথ্যচিত্র ওটিটি-তে মুক্তি পেয়েছে। নাম ‘দ্য ইন্দ্রাণী মুখার্জি স্টোরি: বারিড ট্রুথ’। সেখানেও নানা জনে আমাকে নিয়ে নানা কথা বলেছেন। বিরুদ্ধ-মত শুনতে আপত্তি নেই আমার। কিন্তু সেই মতের তো কোনও যুক্তি থাকবে। মহিলাদের কথা বলতে গেলে যেন অধিকাংশেই যুক্তি হারায়।
প্রথমে আমার তথ্যচিত্র নিয়ে চিন্তায় পড়েছিলেন অনেকেই। সে কারণে নির্ধারিত দিনে মুক্তিও পায়নি ছবিটি। তার পর সে ছবি দেখানোর অনুমতি দেয় বম্বে হাইকোর্ট। বিচারপতিরা স্পষ্ট জানান, এমন কিছু সে তথ্যচিত্রে নেই, যা আগে বলা হয়নি। আমি বা অন্যরা এমন কিছু বলিনি, যা আগে বলা হয়নি এবং লোকে জানেন না। তা ছাড়া, আমি এখনও আদালতে দোষী প্রমাণিত হইনি। ফলে এখনও আইনের চোখে আমি নির্দোষ। আমার অধিকার আছে নিজের দিকটা খুলে বলার। অনেকেই অবাক হয়েছেন এই তথ্যচিত্র দেখে। আমাকে নিয়ে যাঁরা খারাপ কথা বলেছেন, তাঁরাও কী করে আমার গল্পে স্থান পেলেন, তা ভাবছেন। কিন্তু সকলকে বলতে দেওয়ার মধ্যে শক্তির পরিচয় আছে। সে কারণেই তথ্যচিত্রটি করতে রাজি হই আমি। এত বছরে, এত কিছুর মধ্যে দিয়ে গিয়ে এটুকু আমি বুঝেছি, নিজে আগের চেয়ে অনেকটাই শক্ত হয়ে গিয়েছি। অন্যে আমার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছে বলেই যে আমিও অন্যদের মুখ বন্ধ করতে চাইব, তার তো কোনও মানে নেই। বরং অন্যকে বলতে দিয়েও যদি ঋজু হয়ে নিজের কথা বলতে পারি, তবেই তো আমি শক্তিশালী।
এ সব শুনে কেউ কেউ বলছেন, আমি নতুন প্রেম করছি। না হলে এত শক্ত হলাম কী করে! তা মোটেও নয়। বরং নিজের দিকে নজর দিচ্ছি। আমার জীবনে এত বড় ঝড় বয়ে গিয়েছে বলে শুধু বলছি না। কিন্তু মেয়েদের একটা সময় আসে, যখন নিজের মন-স্বাস্থ্য, ভালমন্দে নজর দেওয়া জরুরি। আমার সেই সময়টা এসে গিয়েছে। এখন আর প্রেম-বিয়ে নয়। নিজের ভাল থাকা দরকার। কখনও প্রেম করব না, এমন না। তবে আপাতত সে সবে নেই। ঠিক আমাকে তথ্যচিত্রে যে রকম দেখিয়েছে, সে রকমই আমার জীবন। মানসিক ভাবে অনেকটা ভারমুক্ত। বিয়ে নেই। স্বামী-সংসারের ভার নেই। ভিধি-মিখাইল নিজের মতো চলার জন্য যথেষ্ট বড় হয়ে গিয়েছে। আর শিনার কথা তো আলাদা। সে যা-ই হোক। এখন আমি একা। আমি আমার মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। পুজো আগেই করতাম। এখন সঙ্গে নাচ শিখছি। লিখছি। ঘুরছি। কান্নাকাটি করছি না।
অনেকে আমার তথ্যচিত্র দেখে অবাক হয়েছেন। প্রশ্ন করেছেন, আমি চোখের জল ফেলিনি কেন? করি না আমি কান্নাকাটি। কাঁদব কেন? আমি নারী বলেই কাঁদতে হবে? ছেলে হলে কেউ এই প্রশ্নটা করতেন? আমার মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকেই সেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত বলে ধরা হচ্ছে। সব খুব কঠিন। কিন্তু কঠিন মানেই সকলের সামনে কাঁদতে হবে, এতে আমি বিশ্বাস করি না। নিজের দুঃখ নিজের মতো করে বুঝে নিই। মনখারাপ হলে একা একা তো কাঁদিই। তবে সকলের সামনে কাঁদি না বলে হয়তো আমাকে খারাপ মা বলে মনে করেন অনেকে। আমি তো তথ্যচিত্রেও বলেছি, সত্যিই হয়তো আমি খারাপ মা। তবে নিজেকে ভাল প্রমাণ করার জন্য কান্নাকাটি করতে পারব না। মেয়েদের নিয়ে যেন অদ্ভুত সব ধারণা তৈরি করে ফেলে সমাজ। সেই ধারণার ছকের মধ্যে যদি নিজেকে বসিয়ে দিতে না পারি, তা হলেই সকলের মনে হয় আমি ঠিক নই।
ঠিক আমি না-ই হতে পারি। যদিও মামলায় আমি হারব না জানি। তা-ও। কিন্তু আজ, সে সব নিয়ে কিছু বলতে যাব না। শুধু বলে রাখতে চাই, আমি কান্নাকাটি করছি কি না, তার সঙ্গে আমার দোষী বা নির্দোষ হওয়ার সম্পর্ক আছে কি? মেয়েরা কোনও ঘটনার কেন্দ্রে এলেই যেন নানা রকম মতামত চলে আসতে থাকে তাঁর ব্যক্তিগত রুচি, পছন্দ-অপছন্দ এবং আচরণ নিয়ে। আমি তথ্যচিত্রটি করার পর আবার সেই কথা টের পেলাম। যেমন পেয়েছিলাম ২০১৫ সালে হঠাৎ এক দিন, স্বামী পিটার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যেখানে সংসার ছিল, সেই ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ আমাকে আমারই মেয়ে শিনাকে খুন করার অভিযোগে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরের ঘটনাক্রম দেখে।
এ দিকে, সেই নারীর চোখে জল না দেখে সমাজ অবাক হয়েছিল, যাঁকে স্বভাবে মা বলে মানেন না কেউ। এমনকি, নারীসুলভ মনে হয় না যাঁকে, তাঁকেই আবার অনেকের মনে ধরছে। জামিনের পর নতুন জীবন শুরু করেছি থেকে কিন্তু প্রেম-বিবাহের কম সংখ্যক প্রস্তাব পাইনি।
সে সবে যাচ্ছি না আপাতত। তবে সমাজের এত কাণ্ড দেখে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমি যদি কান্নাকাটি করতাম, বিপর্যস্ত হওয়ার কথা বলতাম, তবে কি এ সমাজ বিশ্বাস করত আমাকে? মেয়েরা তো সমস্যায় পড়ে সকলের সামনে কান্নাকাটি করলে আবার কুমিরের অশ্রুর প্রসঙ্গও আসে। সকলে কি চোখের জল দেখে বিশ্বাস করেন? তবে মেয়েরা কাঁদবেন কেন? নারী মানেই চোখের জল ফেলতে হবে কেন? চোখের জলের আদৌ সম্মান আছে কি?
(লেখক শিনা বরা হত্যায় মূল অভিযুক্ত। এখন জামিনে মুক্ত। অনুলিখন সুচন্দ্রা ঘটক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy