২৫০০ বছর ধরে যা নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়েছেন বহু ডাকসাইটে ভাষাবিদ। সে সাগরে ডুব দিয়েছিলেন ভারতের তরুণ ঋষি রাজপোপটও। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
টানা আড়াই বছর শব্দ ধরে ধরে অঙ্ক মিলিয়েছেন। কোনও কোনও দিন সারা রাত লাইব্রেরিতে বসে নতুন শব্দ খুঁজে খুঁজে তার হিসাব মিলিয়েছেন। দেখেছেন, দিব্যি মিলেও যাচ্ছে সব হিসাব!
কাত্যায়ন, পতঞ্জলির মতো প্রাচীন ভারতের সংস্কৃত পণ্ডিতরা যে কথা বুঝতে পারেননি, তা বুঝলেন ২৭ বছরে ১২টি ভাষা জানা এক যুবক! তিনিও ভারতীয়। বিলেতে গবেষণা করেন। শুনতে দারুণ লাগলেও, কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। এ ধাঁধা আজকের নয়। ২৫০০ বছর ধরে তা নিয়ে মাথার চুল ছিঁড়েছেন বহু ডাকসাইটে ভাষাবিদ। সে সাগরে ডুব দিয়েছিলেন ভারতের তরুণ ঋষি রাজপোপটও। সংস্কৃত ব্যাকরণের ভিত যে প্রাচীন পণ্ডিতের হাতে তৈরি, সেই পাণিনির একের পর এক সূত্র নিয়ে চলছিল নাড়াছাড়া। ন’মাস ধরে দিন-রাত এক করেও হিসাব না মেলায় অস্বস্তি বাড়ছিল। এক সময়ে তো ঋষি কাজটাই ছাড়তে বসেছিলেন! ঠিক করেন, আর লেখাপড়া করে লাভ নেই। শান্তিই আসল। বই বন্ধ করে চলে যান নিজের শান্তির সন্ধানে।
এক মাস টানা ছুটি কাটান। সাইকেল চালিয়ে, রান্নাবান্না, খেলাধুলো করেই দিন কাটাচ্ছিলেন। সংস্কৃত সূত্রের হিসাব মেলার চিন্তা আর করবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন। কিন্তু তার পরে? ঋষি বলেন, ‘‘এ সব করে দিন কাটিয়ে হঠাৎ এক দিন বসেছিলাম বই নিয়ে। তখনই নতুন ভাবনা মাথায় এল।’’
পাণিনি একটি মূল শব্দের শেষের অংশটির ভিত্তিতে নতুন শব্দ তৈরির দু’টি সূত্র বলেছেন। তারই একটি নিয়ে যত গোলমাল। অনেক সময়েই দেখা যায়, সূত্র মেনে কাজ করলেও হিসাব মেলে না। ভুল উত্তর আসে। ২৫০০ বছর ধরে এই ধাঁধার সমাধান কেউ করতে পারেননি। ঋষি গবেষণা করছিলেন সেই ধাঁধা নিয়েই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক মৌ দাশগুপ্ত জানান, পাণিনির ওই সূত্র নিয়ে অনেক দিন ধরে রয়েছে ধোঁয়াশা। সেই সূত্রের বক্তব্য ঠিক কী, তা বুঝে উঠতে পারছিলেন না কেউই। তাই সেটি নিয়ে কাজও হয়েছে অনেক।
পাণিনির ১৫০ বছর পর এসেছেন কাত্যায়ন। তিনি পাণিনির সেই সূত্র ব্যবহারের জন্য কিছু নয়া সূত্র তৈরি করলেন। পরবর্তীকালে পতঞ্জলি মুনি আরও কিছু নিয়মকানুন দিয়ে পথ দেখালেন। এবং সে সবের ভিত্তিতেই কাজ চালানো হচ্ছিল। সে কারণেই সংস্কৃত ভাষাচর্চায় এই তিন জনকে ‘ত্রিমুনি’ বলা হয়। তবে পাণিনি কেন এমন একটি সূত্র দিলেন, যা সবটা মেলে না— সেই উত্তর কারও কাছেই ছিল না।
কোনও ভাষায় কখন কী নিয়ম অনুসরণ করে শব্দ তৈরি হয়, তা বোঝায় ব্যাকরণ। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাকরণের হিসাব খাটে না। তখন তৈরি হয় নতুন সূত্র। তা সব ভাষার ক্ষেত্রেই সত্য। সংস্কৃতও ব্যতিক্রম নয়। তেমনই একটি ক্ষেত্রের কথা হচ্ছে এখানেও। পাণিনির কথার ভাঁজ ঠিক কোথায়, বুঝতে পারেননি প্রাচীন ঋষি-মুনিরাও। পরবর্তীকালে কাত্যায়ন থেকে পতঞ্জলি, নানা ভাবে বোঝার চেষ্টা করেন সেই সূত্রকে। সে সব চেষ্টার ভিত্তিতেই এত দিন চলছিল ভাষাচর্চা।
এ বার পাণিনির সেই সূত্রটির মানে নতুন করে বোঝালেন ঋষি। এই তরুণের বক্তব্য, পাণিনি একাই একশো! কাত্যায়ন বা পতঞ্জলির সূত্রের সাহায্য ছাড়াই পাণিনির সূত্র বুঝে তা দিয়ে নতুন শব্দ তৈরি হতে পারে। ঋষির গবেষণা বলছে, পাণিনি ঠিক যে কথা বলেছিলেন, তা সকলে বুঝতে পারেননি। অন্য ভাবে বিষয়টি দেখলেই তাঁর সূত্র বোঝা সম্ভব। ভাষাবিদদের অনেকেই তাই মনে করছেন, ঋষির গবেষণা সংস্কৃতচর্চার পথ আরও মসৃণ করে দিল।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সংস্কৃত ব্যাকরণের এই সমাধান ‘যুগান্তকারী’। এর ফলে কম্পিউটারকে পাণিনির ব্যাকরণ শেখানো আরও সহজ হবে। অর্থাৎ, কম্পিউটারের মধ্যে ‘প্রোগ্রাম’ হিসাবে ভরা যাবে। ঋষি জানিয়েছেন, প্রথম যখন সমাধান পেয়েছিলেন তিনি, মনে হয়েছিল ‘ইউরেকা’। ঠিক গ্রিক আর্কিমিডিসের মতোই। ২৭ বছরের গবেষকের কথায়, ‘‘এখনও অনেক কাজ বাকি। তবে সূত্রের বড় অংশ ধরে ফেলেছি।’’
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাণিনির তৈরি ‘অষ্টাধ্যায়ী’ সূত্র শুধু সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, অন্যান্য ভাষাকেও বুঝতে সাহায্য করেছে। সেখানকার সব সূত্রের ভিত্তিতে যে কোনও শব্দ তৈরি করা যায়। একটি শব্দ থেকে অনেক শব্দ তৈরি করার পথ হয়। একটি বিশাল ভাষাকে সংক্ষেপে শেখার পথ দেখায় এই সব সূত্র। তাই ভাষাতত্ত্বের প্রাচীনতম সূত্র হিসাবে দেখা হয় পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’-কে। তাই পাণিনির ‘ভাষা যন্ত্র’ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। দেশ-বিদেশে ভাষাতত্ত্বের দিকপালেরাও এই সূত্রের উপর নির্ভর করেন। সুৎজারল্যান্ডের ফার্দিনান্দ দে সসুর থেকে আমেরিকার লেনার্ড ব্লুমফিল্ড— পাণিনির দ্বারা প্রভাবিত অনেকেই।
পাণিনি যে ভাবে ভাষাকে ভেঙেছেন, সেই যুক্তি প্রায় অঙ্কের মতো। ফলে পরবর্তীকালে বিভিন্ন যন্ত্রকে কোনও ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রেও পাণিনির সূত্র সাহায্য করেছে। এ বার পাণিনির সেই সূত্র ব্যবহারের নয়া পথ দেখাচ্ছে ঋষির গবেষণা।
সূত্রের মূল অংশের সমাধান বার করার পর বাকি অংশের জন্যও কম খাটেননি ঋষি। পাণিনি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘পাণিনি যা তৈরি করেছিলেন, তার তুলনা মানবসভ্যতার ইতিহাসে খুব বেশি নেই। তবে তিনি আশা করেননি যে, তাঁর সূত্রের সঙ্গে আমরা আরও নতুন ভাব জুড়ব। তাই আমরা যতই এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি, ততই পাণিনির সূত্রগুলি আমাদের এড়িয়ে দূরে সরে যায়।’’
এ বার পাণিনির এই সূত্রের সমাধানের ফলে একটি সংস্কৃত শব্দ থেকে হাজার হাজার সঠিক শব্দ তৈরি করা যাবে বলে জানাচ্ছেন ভাষাবিদরা। ভাষাবিদদের অনেকের বক্তব্য, গত ২৫০০ বছর ধরে এই সমস্যারই সমাধান বার করতে হাবুডুবু খেয়েছেন সেরার সেরা পণ্ডিতরা। পাতার পর পাতা অঙ্ক কষেছেন। তবু কিনারা পাননি। ঋষি দেখালেন, পাণিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁর সূত্র ব্যবহারের জন্য অন্য কারও সূত্রের প্রয়োজন নেই। তাঁর কাজের মাধ্যমে দাবি করলেন, কাত্যায়ন আর পতঞ্জলি হয়তো সম্পূর্ণ বুঝতে পারেননি পাণিনিকে। বোঝেননি অন্য পণ্ডিতেরাও। তাই এত নতুন সূত্র বার করেছেন। এ বার পাণিনির প্রাচীন সূত্রের নতুন মানে বেরোল।
ঋষি দেখিয়েছেন, একই শব্দের দু’রকম মানে হয়। দ্বিতীয় মানেটি অনুসরণ করে কাজ করলে পরবর্তীকালে যে সব সূত্র তৈরি করতে হয়েছে, তার আর কোনও প্রয়োজন নেই। এক দিনে হয়নি কাজটি। মূল সমাধান বার করার পর তা মিলিয়ে দেখতে হয়েছে। পাণিনির সূত্রের যে মানে জেনে অভ্যস্ত সকলে, তার অন্য একটি মানেও হয়, এমনই। এবং দ্বিতীয় মানের ভিত্তিতে কাজ করলে একের পর এক অঙ্ক মিলতেও শুরু করে। এর পর টানা আড়াই বছর শব্দ ধরে ধরে অঙ্ক মিলিয়েছেন ঋষি। বলেন, ‘‘কোনও কোনও দিন তো সারা রাত লাইব্রেরিতে বসে নতুন শব্দ খুঁজে খুঁজে তার হিসাব মেলাতাম। দেখতাম, দিব্যি মিলেও যাচ্ছে সব হিসাব।’’
অভিজ্ঞ ভাষাতাত্ত্বিকরা ঋষির এই আবিষ্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন কারণ এর পর যন্ত্রকে ভাষা শেখানো আরও সহজ হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক মৌ বলেন, ‘‘যে সমাধানের কথা ঋষি বলছেন, তা যদি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তবে এটি বড় কাজ। কিন্তু তা সময় বলবে। আপাতত ভাষাতাত্ত্বিকদের অনেকে আবার দাবি করছেন, এই সমাধান বিশেষ কিছু করবে না। দেখা যাক কী হয়। সময় বলবে।’’ তবে পাণিনিকে নতুন করে পড়ার এই পদক্ষেপ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন সংস্কৃতের অধ্যাপক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy