গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
গেঁয়ো যোগীর মতো ভিখ পায় না দেশীয় গাছগাছড়া। আমাদের দেশের গবেষকরা গুরুত্ব দেন না এই সব গাছগাছড়ার ভেষজ গুণকে। অথচ গ্রামবাংলায় সহজলভ্য এমন বহু গাছ আছে, সঠিক প্রয়োগে যারা জটিল থেকে জটিলতর অসুখে অত্যাশ্চর্য ভাবে কার্যকর হতে পারে। এ রকমই দাবি জৈব রসায়নের গবেষকদের।
আমলকি, হরীতকী, বহেড়া, খয়ের, বিলিতি আমড়া, কুলত্থ কলাই এবং অনন্তমূল। নামগুলির স্থান শহুরে জীবনে দশকর্মা দোকানে হলেও গ্রামে এদের সাক্ষাৎ এখনও বিরল নয়। এবং, এদের ভেষজ প্রয়োগ ক্যানসার নিরাময়ে খুবই ফলপ্রসূ। দীর্ঘ গবেষণার পরে এ কথা বলছেন অধ্যাপক রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায়। ১৯৭৫ সালে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারী, সাউথ পয়েন্ট, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন এবং আইআইটি কানপুরের প্রাক্তনী রাজাগোপালের দাবি, এই গাছগুলির ভেষজ গুণ কার্যকর হবে করোনাভাইরাস মোকাবিলাতেও। কিন্তু কী ভাবে, তার জন্য পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কিছুটা। জানতে হবে, কর্কটরোগে কী ভাবে কার্যকরী হয় এই ভেষজ উপাদানগুলি।
বোস ইনস্টিটিউট-এর বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে দীর্ঘ ২৪ বছর কাটিয়েছেন তিনি। দেশে গবেষণা করবেন বলেই ফিরে এসেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ভেষজ বা আয়ুর্বেদিক উপাদান তকমা দিয়ে গাছগাছড়াকে ব্রাত্য করে রাখার পক্ষপাতী নন তিনি। বরং তাঁর বিশ্বাস, স্বয়ং স্রষ্টা শ্রেষ্ঠ বায়োকেমিস্ট। তাই তাঁর দেওয়া কোনও উপাদানকেই অবহেলা করতে রাজি নন এই বিজ্ঞানসাধক।
ডিএনএ-গুলিকে গিঁটমুক্ত করার জন্য টোপোআইসোমারেজ দু’টি অপরিহার্য—ছবি: রয়টার্স
কর্কটরোগকে তিনি তুলনা করেন মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রূণের সঙ্গেই। কারণ দু’টি ক্ষেত্রেই কোষের বৃদ্ধির হার অত্যন্ত দ্রুত। দু’টি ক্ষেত্রেই অনুঘটকের কাজ করে ক্যালসিয়াম। তাঁর সাবধানবাণী, বয়স হলেই হাড় মজবুত করার নামে যথেচ্ছ ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাওয়ার প্রবণতা ক্ষতিকারক হতে পারে । বরং, ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া উচিত দৈনন্দিন সুষম খাবারকেই।
অ্যালোপ্যাথিক ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপিতে যে সব ওষুধ ব্যবহৃত হয়, তার ৬০ শতাংশই হয় টিউবুলিনের ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়াকে অথবা হিউম্যান ডিএনএ টোপোআইসোমারেজ ওয়ান বা টু-কে প্রভাবিত করে। জৈব কোষের আণবিক স্তরে যে প্রক্রিয়াগুলি চলে, তার ফলে ডিএনএ-র মধ্যে নানা রকম ‘গিঁট’ পড়ে যায়। ডিএনএ-গুলিকে গিঁটমুক্ত করার জন্য টোপোআইসোমারেজ দু’টি অপরিহার্য। টোপোআইসোমারেজ দু’টি ঠিকঠাক কাজ কাজ না করলে, ডিএনএ-র চেহারা অস্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন কোষটি মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে। ক্যানসার জাতীয় কোষগুলির জন্য এটি মৃত্যু, কিন্তু রোগীর পক্ষে তা উপকারী। ছাত্রী ইন্দ্রাণী কর, সহ-গবেষক হেমন্ত মজুমদারের সঙ্গে লেখা একটি গবেষণাপত্রে রাজাগোপাল দেখিয়েছেন, পরীক্ষিত সাতটি গাছের নির্যাসই কমবেশি টোপোআইসোমারেজ ওয়ানকে বাধা দিলেও, যে পাঁচটি গাছই ইতিমধ্যে ক্যানসার সারায়, সেগুলি সর্বাধিক বাধা দেয়। টোপোআইসোমারেজ টু-কেও বাধা দেয়, তবে খানিকটা কম পরিমাণে।
হরীতকী এবং আমলকি—ছবি:শাটারস্টক
খয়ের, আমলকি, বহেড়া, হরীতকী, বিলিতি আমড়ার অ্যান্টি ক্যানসার বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত ও খ্যাত। অন্য দিকে, অনন্তমূল আর কুলত্থকলাই অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট হলেও, তাদের ক্যানসার সারানোর ক্ষমতা তেমন পরিষ্কার নয়। ২০১৬ সালে প্রকাশিত ইন্দ্রাণী কর ও রাজাগোপালের গবেষণাপত্র থেকে এই বিভাজন পরিষ্কার। কারণ ওখানে এই নির্যাসগুলির এমন একটা ক্ষমতার কথা প্রথম প্রমাণিত হয়েছিল যা অ্যালোপ্যাথিতে ব্যবহৃত কেমোথেরাপিতে দেখা যায়নি। ওখানে দেখানো হয়েছে, ওই নির্যাসগুলি এক রকম অনুঘটকের কাজ করে, যার ফলে জৈব কোষের অভ্যন্তরে যে ডি-অক্সিনিউক্লিওসাইড ও ডি-অক্সিনিউক্লিওটাইডগুলি আছে, সেগুলির পরিমাণ ধ্বংসের ফলে অনেকটাই কমে যায়, বিশেষ করে পিরিমিডিন শ্রেণির ‘সি’ ও ‘টি’। এই ধ্বংসটি প্রধানত হাইড্রক্সিল র্যাডিকালের বিক্রিয়ায় ঘটে থাকে, যা কোষের অভ্যন্তরীণ একটি চলমান বিক্রিয়া। যে ডি-অক্সিনিউক্লিওটাইডগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হল, সেগুলি ব্যবহার করেই তো নতুন ডিএনএ-র নির্মাণ হত। কাজেই, নির্যাসগুলির প্রভাবে ডিএনএ-র নির্মাণ স্তিমিত হল। অন্য দিকে আবার দেখা যাচ্ছে, নির্যাসগুলি পূর্বে নির্মিত ডিএনএ-কে রক্ষা করে, হাইড্রক্সিল র্যাডিকালের প্রভাব থেকে। কাজেই যে কোষগুলি বিভাজন করছে না, তারা রক্ষা পায়।
আমলকি, হরীতকী, বহেড়া, এই তিনটি ফল বহু দিন ধরেই প্রচলিত ত্রিফলা নামে। শারীরিক বহু সমস্যাতেই ত্রিফলার ব্যবহার বহু দিন ধরেই সুবিদিত। তবে খয়ের হিসেবে পানের দোকানে আমরা সরচরাচর যা পাই, সেটা তরলীকৃত। খাঁটি খয়ের দুর্মূল্য, কেজিপ্রতি ১৫০০ টাকার মতো।
খয়ের ও বিলিতি আমড়া—ছবি:শাটারস্টক
এই সব উপাদান দিয়ে তৈরি ওষুধ যে ক্যানসারে কার্যকরী, তার প্রমাণ পেয়েছেন রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায় নিজে। তাঁর মা ক্যানসার আক্রান্ত ছিলেন। রাজাগোপালের দাবি, তাঁর বন্ধুর তৈরি ওষুধে উপকৃত হয়েছিলেন তাঁর মা। কিন্তু নানা জটিলতায় এই ওষুধের কোনও পেটেন্ট নেওয়া হয়নি। তার প্রয়োগ সীমাবদ্ধ আছে গবেষকদের পরিচিত বৃত্তের মধ্যেই। আক্ষেপের গলায় রাজাগোপাল বলেন, ‘‘আমাদের দেশের গবেষকরা এই দেশীয় গাছগাছড়ার গুণাগুণকে গুরুত্ব দেন না। এই উপাদানগুলিকে নিয়ে গবেষণা আরও বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ হোক। বিশেষত করোনা ভাইরাসের এই সঙ্কটসময়ে।’’
ফরাসি ভাষায় ‘নুভেল’ শব্দের অর্থ নতুন। ‘করোনা’ শব্দের অর্থ সূর্যের ছটা। অর্থাৎ, সূর্যের নতুন ছটা। অনুবীক্ষণের নীচে জীবাণুর রূপ দেখে এই নামকরণই করেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু বিশ্বব্যাপী এই আক্রমণকে কী ভাবে প্রতিরোধ করতে পারে ভারতীয় উদ্ভিদ? বায়োকেমিস্ট রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের কথায়: ‘‘করোনাভাইরাসকে আটকাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে এই ভেষজগুলি। যে কোনও জীবাণু তার জিনগত বৈশিষ্ট্য বহন করে ডিএনএ অথবা আরএনএ রূপে। করোনা হল আরএনএ ভাইরাস। ফলে এর মিউটেশনের হার অত্যন্ত বেশি।’’
কুলত্থ কলাই—ছবি:শাটারস্টক
সেক্ষেত্রে করোনার বিস্তার হ্রাসে রোধ করতে হবে এর আরএনএ সিন্থেথিস। এই কাজে এই উদ্ভিদগুলির ভেষজ উপাদান কার্যকর হবে বলেই রাজাগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের ধারণা। কারণ ক্যানসারের ক্ষেত্রে যেমন ডিএনএ-র উপাদানগুলি ভেষজ নির্যাসগুলির প্রভাবে ধ্বংস হয়েছিল, করোনার ক্ষেত্রেও আরএনএ-র নির্মাণে যে উপাদানগুলি জরুরি, যেমন নিউক্লিওসাইড ও নিউক্লিওটাইডগুলি, ফেনটন বিক্রিয়ার প্রভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, এটা ধরে নিতে পারি। কারণ ডিএনএ এবং আরএনএ-র উপাদানগুলি রাসায়নিক দিক থেকে প্রায় সমতুল্য। কাজেই নির্যাসগুলির প্রভাবে আরএনএ তৈরি স্তিমিত হবে। তাঁর আশা, এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আগ্রহী হলে আখেরে উপকৃত হবে বিশ্ববাসী। গবেষণাগার থেকে ওষুধ তৈরি এক দীর্ঘ পথ। তার আগে করোনাত্রাসের আবহে এই ভেষজ উপাদানগুলি বিশেষ উপকারী বলে তিনি মনে করেন। তাই প্রতিরোধ ক্ষমতা মজবুত করতে তাঁর পরামর্শ, নিয়মিত আমলকি, হরীতকী, বহেরা, খয়ের, বিলিতি আমড়া খাওয়ার। বিলিতি আমড়া মরসুমি ফল। খুব বেশি দিন ধরে পাওয়া যায় না। পরিবর্তে, খাওয়া যেতে পারে বেদানা বা ডালিম। কারণ অন্যান্য ভেষজগুলির মতো এতেও পলিফিনলিক অণুর প্রাচুর্য ও অ্যান্টি ক্যানসার গুণ পাওয়া গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ডায়াবিটিসে ভুগছেন? করোনা থেকে বাঁচতে কী করবেন?
ডিএনএ তৈরিতে ওই পাঁচটি ভেষজ বাধা দেয় জানার পরেও রাজাগোপাল কৌতূহলী হয়েছিলেন প্রোটিন তৈরির কাজে এগুলির কোনও প্রভাব আছে কি না, তা জানার জন্য। যেহেতু ভারতে এটি সঠিক ভাবে মাপার পারদর্শিতার অভাব, জাপানের এহিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়েটা এনডোকে বহেড়া, আমলকি, খয়ের ও বিলিতি আমড়া থেকে প্রস্তুত নির্যাসগুলি পাঠিয়েছিলেন রাজাগোপালবাবু। জাপান থেকে পরীক্ষা করে, তাঁর ফলাফলও পাঠিয়ে দিয়েছেন এনডো। তাতে দেখা যাচ্ছে, বহেড়া ও খয়ের ২০০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি মিলিলিটার থাকলে, প্রোটিন তৈরির হার সাধারণের তুলনায় ১৮% ও ২১% হয়ে গিয়েছে। যদিও হরীতকীর নির্যাস পরিমাণে অল্প থাকায় এনডোকে পাঠানো যায়নি, বহেড়ার যৌগগুলির সঙ্গে হরীতকীর বিশাল সাদৃশ্য থাকায় অনুমেয় যে, হরীতকীর ক্ষেত্রেও একই ফল মিলবে।
আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণের সময় কোন কোন ফল বেশি খাবেন
প্রকৃতির কোনও উপাদানকেই অবহেলা করা উচিত নয়। বিশ্বাস করেন এই বিজ্ঞানী। কথায় কথায় হেসে বলেন, ‘‘আমি কিন্তু বায়োলজির কিছুই জানতাম না। প্রথমে ভালবাসার জায়গা ছিল কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্স। ইউসিএলএ-তে পিএইচডি স্তরে পৌঁছে আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয় বায়োকেমিস্ট্রি। বলতে পারেন, এই বিষয়ের পুরোটাই আমি নিজেই নিজেকে শিখিয়েছি। সেল্ফ টট যাকে বলে! তবে ফেন্টন রিঅ্যাকশন নিয়ে আমার গবেষণার সূচনা অবশ্য হয়েছিল বার্কলেতে, পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে।’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy