Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
COVID19

প্রতিষেধক বিষয়ে কিছু জরুরি কথা

অনেকেই প্রতিষেধক নেওয়ার বিষয়ে দোলাচলে। প্রতিষেধক সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার।

শান্তনু ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১ ০৫:০৪
Share: Save:

প্রশ্ন: প্রতিষেধক নিতে কিছু মানুষের মধ্যে জড়তা রয়েছে। সেটা কেন?

উত্তর: প্রথমত, বেশির ভাগ মানুষই ভাবেন, প্রতিষেধক মানে তা বাচ্চাদের। বয়স্কদের প্রতিষেধক দেওয়ার বিষয়ে অনেকেই ততটা পরিচিত নন। দ্বিতীয়ত, অনেকেই ভাবছেন জীবনের এতগুলি বছর পার করে দিলাম, হঠাৎ এখন ইঞ্জেকশন কেন নেব? আবার নিলে তো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। তার থেকে যে ক’টা দিন বাঁচব, এ ভাবেই চলে যাবে। তৃতীয়ত, অনেকে এটাও ভাবছেন আমার এত দিন করোনা হয়নি। কিন্তু এটা তো করোনার প্রতিষেধক, তা হলে কি কোভিড আক্রান্ত হতে পারি? আবার এ-ও ভাবছেন সুগার, রক্তচাপের যে সমস্যা রয়েছে প্রতিষেধক নেওয়ার পরে সেটা আরও বেড়ে যাবে না তো! এই সমস্ত ভ্রান্ত ধারণাই জড়তা তৈরি করছে।

প্রশ্ন: এই দ্বিধা কাটানোর উপায় কী?

উত্তর: নিজের আগ্রহে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে প্রতিষেধক বিষয়ে জেনে নেওয়া যায়। প্রতিষেধক কী, কেন নেওয়া প্রয়োজন এই সমস্ত বিষয়ে এখন বাংলা ভাষাতেও জানা যাচ্ছে। সরকারি তরফে যে প্রচার চালানো হচ্ছে, সেগুলি মনোযোগ দিয়ে শুনে মান্যতা দিলে জড়তা থেকে সহজেই বেরিয়ে আসা সম্ভব। প্রথমে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিষেধক নিয়েছেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, নিজের অতি পরিচিত চিকিৎসকও প্রতিষেধক নিয়েছেন ও ভাল রয়েছেন।

প্রশ্ন: কোভিশিল্ড কোভ্যাক্সিন— কোনটি নেওয়া ভাল?

উত্তর: দুটি প্রতিষেধক একই রকমের। তবে ভিন্ন পদ্ধতিতে তৈরি। প্রতিষেধক হল, যে রোগের জন্য দেওয়া হচ্ছে সেই রোগের খুব অল্প পরিমাণে নিষ্ক্রিয় প্রোটিন শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া। যাতে শরীরে ইমিউনিটি তৈরি হয় এবং পরবর্তী সময়ে ওই রোগের জীবাণু দেহে প্রবেশ করলে তাকে দ্রুত সরিয়ে দিতে পারে। এই প্রোটিন শরীরে প্রবেশ করানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিষেধক বেরিয়েছে। সারা বিশ্বে করোনার ১৩ রকমের প্রতিষেধক চলছে। ভারতে চলছে—কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন। যে ভাবে ইনফ্লুয়েঞ্জা, হুপিং কাশি, পোলিয়ো-সহ বিভিন্ন প্রতিষেধক তৈরি করা হয়েছিল সেই পদ্ধতিতেই কোভ্যাক্সিনও তৈরি হয়েছে। এই প্রতিষেধকের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করোনা ভাইরাসের অল্প একটু অংশ মানবশরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে শরীরে প্রোটিন গেল, কিন্তু ভাইরাসটি ঢুকল না। কোভিশিল্ডের ক্ষেত্রে সর্দিকাশির অ্যাডিনো ভাইরাস, যেটি শিম্পাঞ্জির শরীরে রয়েছে, সেটিকে নিষ্ক্রিয় করে তার গায়ে কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে খারাপ প্রোটিন (স্পাইক প্রোটিন)-কে লাগানো হচ্ছে। সেটিকে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এতে অ্যাডিনো ভাইরাসটি কোনও কাজ করছে না। কিন্তু স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি যেমন ভাবে কাজ করার, করছে। দু’টি প্রতিষেধক তৈরির পদ্ধতি আলাদা হলেও তার মাধ্যমে শরীরে প্রতিরোধ বৃদ্ধির কাজটা একই ভাবে হচ্ছে। তাই দুটোর মধ্যে কোনটা ভাল, সেটা বলার জায়গা নেই।

প্রশ্ন: কোন কোন কোমর্বিডিটি থাকলে প্রতিষেধক নেওয়া যায়?

উত্তর: এত দিন যে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, তাতে সমস্ত শারীরিক সমস্যাতেই (কোমর্বিডিটি) এই প্রতিষেধক নেওয়া যায়। তবে কয়েকটি ক্ষেত্রে একটু সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যেমন, প্রতিষেধক নেওয়ার সময়ে যদি কেউ বেশি রকম অসুস্থ থাকেন, তার জন্য যদি ওষুধ চলতে থাকে, তা হলে সেই সময়ে প্রতিষেধক না নেওয়া ভাল। কারণ, তা হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। যাঁদের রোগ প্রতিরোধ তৈরির ক্ষমতা কমে গিয়েছে, তাঁদের প্রতিষেধক দেওয়া যাবে না, তা নয়। এঁদের ক্ষেত্রে ইমিউনিটি তৈরি হতেও পারে, আবার নাও পারে।
এ ছাড়াও কিডনি এবং হার্টের রোগীদের প্রতিষেধক দিতে কিন্তু কোনও বাধা নেই।

প্রশ্ন: কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিষেধক নিতে বারণ করা হচ্ছে?

উত্তর: ১৮ বছরের কম, বেশি রকমের অসুস্থ, অন্তঃসত্ত্বা, বাচ্চাকে স্তন্যপান করাচ্ছেন এবং হিমোফিলিয়া, আক্রান্ত, আবার যাঁরা রক্ত পাতলা রাখার জন্য ওষুধ খান, তাঁদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলা হচ্ছে কিংবা বারণ করা হচ্ছে। আবার কারও যদি মারাত্মক রকমের অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়ার পূর্ব ইতিহাস থাকে, সে ক্ষেত্রেও বারণ করা হচ্ছে।

প্রশ্ন: প্রতিষেধক নেওয়ার পরে অনেকেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, সেটা কতটা ভয়ের?

উত্তর: এখনও পর্যন্ত প্রতিষেধক দেওয়ার পরে যা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে, তা খুবই কম। ১০০ জনের মধ্যে ১ জনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেলে, তাকে আমরা স্বাভাবিক বলেই ধরি। দেশে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫ কোটি লোককে প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে প্রতি ১ হাজারে ৩ জনের একটু জ্বর, গা-হাত-পা ব্যথা কিংবা বুক ধড়ফড়, ইঞ্জেকশনের জায়গা ফুলে যাওয়া,এ সব হয়েছে। সেটাকে চিকিৎসার পরিভাষায় একেবারে খুব মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলে ধরা হয়। বঙ্গে প্রতি ১ হাজারে ১-২ জনের এমন মৃদু সমস্যা হচ্ছে। দু’টি প্রতিষেধকের ক্ষেত্রেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার খুব কম। তাই ভয়ের কিছু নেই।

প্রশ্ন: করোনার প্রতিষেধক কি প্রতি বছর নিতে হবে?

উত্তর: এটা এখনও গবেষণার স্তরে রয়েছে। প্রতিষেধকের বিষয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা এখনও চলছে। আগে একটি প্রতিষেধক তৈরি করতে ৮-১০ বছর সময় লাগত। সেখানে ৬ মাসে করোনার প্রতিষেধক তৈরি করা হয়েছে। এখন দেখা হচ্ছে, প্রতিষেধক দেওয়ার পরে অ্যান্টিবডি কত দিন শরীরে থাকছে। যদি দেখা যায়, কিছু দিন বাদে পুরোটাই চলে যাচ্ছে, কিন্তু করোনা ভাইরাস সমাজে রয়ে গিয়েছে, তখন হয়তো প্রতি বছর প্রতিষেধক নেওয়ার কথা উঠবে। কিন্তু গবেষণা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত কিছু বলা সম্ভব নয়। যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক প্রতি বছর নিতে হয়।

প্রশ্ন: প্রবীণরা ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক নেওয়ার কত দিন পরে করোনার প্রতিষেধক নিতে পারেন?

উত্তর: অন্তত দু’ সপ্তাহ পরে। কারণ, তত দিনে ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিষেধকটিরও কার্যকারিতা তৈরি হয়ে যায়। তার পরে অন্যটি নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন: প্রতিষেধক নেওয়ার কত দিন পরে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। সেটা বোঝার কি কোনও উপায় রয়েছে?

উত্তর: এ বিষয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে কয়েক জনকে বেছে নিয়ে পরীক্ষাটি চালানো হচ্ছে। প্রথম ডোজ় নেওয়ার আগে অ্যান্টিবডি কী ছিল, নেওয়ার পরে কতটা বাড়ল। দ্বিতীয় ডোজ়ের পরে তা কতটা বাড়ল। আগামী দিনে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।

প্রশ্ন: প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও কি করোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে?

উত্তর: প্রতিষেধক নেওয়া মানেই আর করোনা আক্রান্ত হবেন না, কোথাও বলা হয়নি। প্রতিষেধক নেওয়ার অর্থ, শরীরে করোনা ভাইরাসটি গিয়ে ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, লিভার, মস্তিষ্কে যাতে ক্ষতি করতে না পারে। প্রতিষেধক নেওয়ার পরে করোনা রোগীর হাঁচি-কাশির সামনে গেলে, তা আর এক জনের নাকে-মুখ-গলায় আসতেই পারে। তার কয়েক দিন বাদে লালারসের নমুনা পরীক্ষা করলে ওই ব্যক্তির পজ়িটিভ আসবে। প্রতিষেধক নেওয়া থাকলে ভাইরাসটি নাক- গলাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, শরীরের অন্যত্র গিয়ে আক্রমণ করতে পারবে না। তাই প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও মাস্ক পরা, হাতশুদ্ধি করা, দূরত্ব বিধি মেনে চলতে বলা হচ্ছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Corona COVID19 COVID19 Vaccine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy