ওষুধ খেতে হবে চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়েই। ছবি: পিটিআই
কোভিড নিয়ে সবাই যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের (আইসিএমআর) ন্যাশনাল টাস্ক ফোর্সের তরফ থেকে জানানো হল, সপ্তাহে একটা করে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা এইচসিকিউ খেলেই আর ছুঁতে পারবে না নভেল করোনা।
ভাল কথা। কিন্তু কারা খাবেন? আইসিএমআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল বলরাম ভার্গব জানালেন, ‘‘যাঁরা সরাসরি করোনা রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন, কিন্তু এখনও রোগের উপসর্গ দেখা দেয়নি, তাঁরা খাবেন। যেমন, করোনা রোগীর চিকিৎসা করছেন এমন ডাক্তার, নার্স, অন্যান্য সেবাকর্মী। এবং কেয়ার গিভার, অর্থাৎ, হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীর সেবা করছেন যিনি। তবে তাঁদের বয়স হতে হবে ১৫-র বেশি, হার্টের সমস্যা থাকলে চলবে না। খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’’
খবর কানে আসামাত্র শুরু হয়ে গেল ওষুধের কালোবাজারি। সরকারি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে মানুষ মুড়িমুড়কির মতো হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেতে শুরু করলেন। এখনও খাচ্ছেন। আর ও দিকে, আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের অধিকর্তা অ্যান্টনি ফৌচি এক সাক্ষাৎকারে জানালেন, ‘‘কোভিড-১৯ ঠেকাতে কাজে লাগে জানা গেলেও যত ক্ষণ না নিয়ন্ত্রিত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হচ্ছে, নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না এই ওষুধ কতটা কার্যকর। কাজেই এ ভাবে এই ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়।’’
আরও পড়ুন: যাতায়াত গণপরিবহণে, ভিড় রাস্তাতে, কী করবেন কী করবেন না
একই মত বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্তর। তিনি বলছেন, ‘‘ওষুধ কতটা কাজ করবে তা আমরা জানি না। বহু ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়ার পরেও রোগ হয়। তার উপর হাজারে বা ১০ হাজারে এক জনের কার্ডিয়াক অ্যারিদমিয়া নামে হৃদরোগের আশঙ্কা থাকে। বেশ কিছু অসুখবিসুখ থাকলে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বড় ক্ষতি হতে পারে। ওষুধের নিজস্ব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। তা ছাড়া, অনেকে ওষুধের খবর পেয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, নিয়ম মানার আর দরকার নেই। ফলে ওষুধ যদি রোগ ঠেকাতে না পারে, যার আশঙ্কা খুবই বেশি, অনিয়মে রোগ হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যাবে। তখন কী করবেন?’’
কাজেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল, আতঙ্কের বশবর্তী হয়ে শুধু শুধু ওষুধ খাবেন না। নিয়ম মানুন, ঘরে থাকুন। ডাক্তারের পরামর্শমতো চলুন। তাতেই সুস্থ থাকবেন।
আরও পড়ুন:স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি নেই মানেই কি করোনা, কী বলছেন চিকিৎসকরা
এরই মাঝে কানে আসতে লাগল সম্পূর্ণ উল্টো খবর। জানা গেল, যে সব গবেষণার উপর ভিত্তি করে ভাবা হয়েছিল এইচসিকিউ তুলনাহীন, সে সবই ত্রুটিপূর্ণ। অর্থাৎ, এইচসিকিউ খেলে ভালর চেয়ে মন্দ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী জানালেন, ‘‘কবে ভাইরাস ঢুকবে সেই ভয়ে মাসের পর মাস ওষুধ খেয়ে যাওয়া খুব বিপজ্জনক প্রবণতা, বিশেষ করে যে ওষুধের কোভিড ঠেকানোর বা মারার ক্ষমতাই নেই, উল্টে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে অনেক। রোগ হলে যখন শরীরে প্রদাহ হয়, তখন এর কিছু ভূমিকা আছে অবশ্যই। তবে ওই জ্বর-গলাব্যথা কমানো পর্যন্ত, তার বেশি কিছু নয়।’’
আরও পড়ুন: রাতে জেগে, দিনে ঘুম? কোভিড আবহে কতটা ক্ষতি করছেন জানেন
তা হলে কোন ভিত্তিতে এত উথালপাথাল
বিশেষজ্ঞদের মতে, এইচসিকিউ নিয়ে যতটুকু গবেষণা হয়েছে, তা সবই প্রাথমিক পর্যায়ের। কোনও বিজ্ঞানী কিছু তথ্য পেয়েছেন, তার ভিত্তিতে গবেষণাপত্র লিখে বিজ্ঞানপত্রিকায় পাঠানোমাত্র তা খবর হয়ে বেরিয়ে এসেছে। প্রবন্ধ ছাপা হওয়ার আগে যে পিয়ার রিভিউ হওয়ার কথা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা হয়নি। কোনও রাসায়নিককে ওষুধের তকমা দেওয়ার আগে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করে যে সমস্ত লম্বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তর পার হতে হয়, তা কিছুই হয়নি। কখনও আবার বৈজ্ঞানিক পরিভাষার ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে।
ওষুধের নিজস্ব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, প্রয়োজন আরও গবেষণার। ফাইল ছবি
কী রকম কী হয়েছে, তার কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: ক্যানসার ঠেকাতে সঙ্গে থাকুক বিশেষ এই ফল-সব্জি
গবেষণাগার বনাম মানব শরীর
ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে কয়েক জন চিনা বৈজ্ঞানিক জার্নাল অব সেল রিসার্চের সম্পাদককে চিঠি লিখে জানান, রেসমেডিভির ও ক্লোরোকুইন (এইচসিকিউ-এর সমগোত্রীয় ওষুধ) করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল, এই গবেষণার পুরোটাই হয়েছে গবেষণাগারে, মানব শরীরে প্রয়োগ করে তার কার্যকারিতা দেখা হয়নি। এর আগেও এইচসিকিউ নিয়ে এ রকম কাজ হয়েছে। আরও অনেক ভাইরাসের বিরুদ্ধে তার কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। তার মধ্যে সার্স ভাইরাসও আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত মানব শরীরে তার ভূমিকার কথা জানা যায়নি।
বিতর্কিত ফরাসি গবেষণা
বিজ্ঞানীরা জানান, এইচসিকিউ ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন দিয়ে কোভিড রোগীর চিকিৎসা করে তাঁরা দেখেছেন, খুব দ্রুত ভাইরাল লোড কমছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ওষুধ দেওয়ায় কত জন রোগীর উপসর্গ কমেছে, কত জনের বেড়েছে, কত জন মারা গিয়েছেন, সে সব তথ্য না দিয়ে তাঁরা শুধু শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কতটা কমেছে, তা জানিয়েছিলেন। আসল ঘটনা হল, এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করার পর ৫ জন রোগীর মধ্যে ৪ জনের অবস্থাই খারাপ হয়ে যায়। ৩ জনকে আইসিইউ-তে পাঠাতে হয়। এক জন মারা যান। আর এক জনের শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমে। তার ভিত্তিতেই তাঁরা বলেন, এইচসিকিউ খেলে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমে ও রোগী সেরে যান।
চাইনিজ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল
এপ্রিলের গোড়ায় ৬২ জন মৃদু কোভিড রোগীর উপর সমীক্ষা চালিয়ে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন চিনা বিজ্ঞানীরা। তাতে জানানো হয়, যাঁদের এইচসিকিউ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে, তাঁদের জ্বর-সর্দি-কাশি কমেছে অনেক তাড়াতাড়ি। কিন্তু সমস্যা হল, এত কম রোগীর উপর পরীক্ষা করে বাস্তব পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব নয়। ট্রায়ালে কোনও জটিল রোগীও ছিলেন না। তার উপর গবেষকরা নিজেরাই বলেছেন, সঠিক চিত্র পেতে গেলে আরও বড় মাপের স্টাডি করা দরকার।
ব্রাজিলীয় গবেষণায় এইচসিকিউ বাতিল
ব্রাজিলের গবেষকদের দাবি, এইচসিকিউ খুব জরুরি ওষুধ। তবে যেহেতু এর বেশ ভাল রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, অ্যারিদমিয়া নামের এক হৃদরোগে কেউ মারাও যেতে পারেন। সে জন্য খুব প্রয়োজন না হলে এই ওষুধ খাওয়া ঠিক নয়। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ছাড়া তো একেবারেই নয়। সমস্যা হল, এই গবেষণায় দু’টি বিভিন্ন মাত্রায় এইচসিকিউ দিয়ে রোগীর ভালমন্দের বিচার করেছিলেন গবেষকরা। ওষুধ না দিলে কী হয়, তা তাঁরা দেখেননি। তা ছাড়া এই গবেষণাপত্রের বিচার-বিশ্লেষণও করেনি বিশেষজ্ঞ কমিটি।
পুরনো তথ্যের বিশ্লেষণ, আমেরিকায়
৩৬৮ জন পুরনো কোভিড রোগীর নথি বিশ্লেষণ করেন মার্কিন গবেষকরা। তার মধ্যে এক দল রোগী পেয়েছিলেন এইচসিকিউ, এক দল এইচসিকিউ ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও এক দলের চিকিৎসা হয়েছিল অন্য ওষুধ দিয়ে। তাতে দেখা যায়, প্রথম দু-দল রোগীর ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন ও মৃত্যুহার কমেনি। এমনকি, যাঁরা শুধু এইচসিকিউ পেয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই মারা গিয়েছেন। তবে এই গবেষণায় শুধু পুরুষ রোগীদের কথাই ছিল। তার উপর যাঁরা এইচসিকিউ পেয়েছিলেন, তাঁদের অবস্থা এতটাই জটিল ছিল যে তাঁরা জটিলতার জন্য মারা গিয়েছেন না এইচসিকিউ-এর জন্য, তা পরিষ্কার নয়। তা ছাড়া এই গবেষণাপত্রের বিচার-বিশ্লেষণও বিশেষজ্ঞ কমিটির দ্বারা হয়নি।
হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে বিতর্ক চলছেই। ফাইল ছবি।
শেষ কথা
গত ২১ এপ্রিল ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের তত্ত্বাবধানে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। তারা কোভিড চিকিৎসার যে গাইডলাইন প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়, এখনও পর্যন্ত যতটুকু গবেষণা হয়েছে, তার ভিত্তিতে এইচসিকিউ ভাল না মন্দ তা বলা সম্ভব নয়। তবে যেহেতু হৃদরোগের আশঙ্কা আছে, তাই রুটিনমাফিক না দেওয়াই ভাল।
সর্বশেষ খবর হল, কোভিডের চিকিৎসায় ও রোগ প্রতিরোধ এইচসিকিউ খেতে নিষেধ করেছে এফডিএ। তাদের মত, এতে রোগের বিশেষ উপকার কিছু হচ্ছে না। অতএব, আপনার এইচসিকিউ লাগবে কি লাগবে না, তা চিকিৎসকের বিচারবুদ্ধির উপরই ছেড়ে দেওয়া ভাল।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy