আর কত দিন চলবে এই যুদ্ধ? ভাইরাসটা কি সত্যিই পৃথিবী থেকে কোনও দিন যাবে না? প্রতিনিয়ত তাকে ফাঁকি দেওয়ার ফিকির খুঁজেই বাঁচতে হবে? লকডাউনেও তো এখন অনেক ছাড়। মানুষ বেরোচ্ছেন, অন্যের সংস্পর্শে আসছেন। এতে যে রোগ বাড়তে পারে, সন্দেহ নেই। অনেকে যেমন এই আশঙ্কায় মুষড়ে পড়ছেন, অনেকে তেমন এতেই খুঁজে নিচ্ছেন আত্মবিশ্বাস। তাঁদের ধারণা, আমজনতার মধ্যে রোগটা ছড়িয়ে পড়লে হার্ড ইমিউনিটি (Herd Immunity) বা গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা তৈরি হবে। তাতেই ভাইরাসের প্রকোপ কমবে। অন্যরা বলছেন, এ তো খাল কেটে কুমির আনা! বিপদ বাড়বে। হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে এমনই নানা সংশয় ও প্রশ্নের উত্তর দিলেন চিকিৎসকরা।
গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা কী
মহামারি বা অতিমারির ক্ষেত্রে যখন দেশের একটা বিরাট অংশ (করোনার ক্ষেত্রে ৭০%) এই রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন এই রোগটা আর মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে না। তখন বলা যায়, গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘যখন জনসংখ্যার বিরাট অংশ কোনও নির্দিষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে বা টিকা গ্রহণের মাধ্যমে নিজ দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করে নেয়, তখন বাকিরা পরোক্ষ ভাবে সেই রোগ থেকে নিরাপদ হয়ে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি নতুন কাউকে সংক্রমিত করতে না পারার ফলে সংক্রমণ-শৃঙ্খল ভেঙে যায়। পরিবেশে রোগটির দ্রুত ছড়ানো বন্ধ হয় বা ধীরে ছড়ায়। তবে গোষ্ঠী প্রতিরোধ সকল সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। যেমন টিটেনাস সংক্রামক হলেও, এর ক্ষেত্রে গোষ্ঠী সুরক্ষা কথাটি খাটে না। কারণ, এটি পরিবেশ থেকে ছড়ায়। এ ক্ষেত্রে বারে বারে টিকার প্রয়োজন হয়। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় এমন রোগে আগে গোষ্ঠী সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যেমন, পোলিয়ো, স্মল পক্স, হাম ইত্যাদি। ১৯৬০ সালে হামের টিকাকরণের মাধ্যমে প্রথম গোষ্ঠী সুরক্ষার কথা ভাবা হয়েছিল।’’
গোষ্ঠী অনাক্রম্যতার শক্তি
১৯৭৭ সালে সোমালিয়ায় শেষ বার স্মল পক্স রোগীর খোঁজ মিলেছিল। মনে করা হয়, মাস ভ্যাকসিনেশনের পর গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা অস্ত্রেই পৃথিবী থেকে এই ভয়ানক রোগটি দূর হয়েছে। ডা. মণ্ডল জানালেন, ইতিমধ্যেই যে সব রোগের গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা আছে, সদ্যোজাত শিশুর সেই সব রোগ আর হবে না। কারণ, তার চার পাশের সকলেই তো ইমিউনড। আবার যাঁদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের বিশেষ কিছু ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হয় না। পরিবেশে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ থাকলে তাঁরাও পরোক্ষ ভাবে নিরাপদ। গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা পদ্ধতিতে গোটা সমাজকে বাঁচানো যায়। তাই কোনও কারণে কেউ টিকা না পেলেও, গোটা সমাজ তখন একই সঙ্গে সুরক্ষিত থাকবে। দেখা গিয়েছে, ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগটি প্রবীণদের মধ্যে বেশ তীব্র ভাবে হয়। ভ্যাকসিন দিলেও আশানুরূপ অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। এ ক্ষেত্রে শিশুদের উপর প্রযুক্ত টিকা গোষ্ঠী সুরক্ষার মাধ্যমে বড়দের বাঁচায়।
করোনাভাইরাস ও গোষ্ঠীসুরক্ষা
ডা. মণ্ডল বললেন, ‘‘গোষ্ঠী সংক্রমণ রোধ করতে, অর্থাৎ গোষ্ঠী সুরক্ষা অর্জন করতে গেলে যত শতাংশ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে হবে, তাকে ‘হার্ড ইমিউনিটি থ্রেসহোল্ড’ (এইচআইটি) বলে। বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে এই মান ৪০%-৯৫%। কোভিডের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৭০%। ভারতের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ৭০% মানে প্রায় ৯৭.৫ কোটি মানুষ। করোনার টিকা এখনও আসেনি। এই অবস্থায় ভ্যাকসিন ছাড়া হার্ড ইমিউনিটি চাইলে, এ দেশে ৯৭.৫ কোটি মানুষকে করোনায় ভুগে সুস্থ হতে হবে! সে তো ভয়ঙ্কর প্রস্তাব!’’
তা ছাড়া এইচআইটি-তে পৌঁছলে সংক্রমণের হার তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে কমতে শুরু করে, তবে শূন্যে নেমে আসে না। তাই গোষ্ঠী সুরক্ষা অর্জন করলেও শিশু এবং কম প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন রোগীর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। নবজাতকদের টিকা, বিশেষ রোগীদের ‘বুস্টার’ টিকা দিতে হবে। নতুন ‘কেস’ মিললে ‘রিং’ টিকাকরণ প্রয়োজন হবে।
চেস্ট ফিজ়িশিয়ান ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বললেন, ‘‘লকডাউন না করে, হার্ড ইমিউনিটিকে লক্ষ্য করলে দাবানলের মতো রোগটা ছড়াত। তখন ক’মাসেই সত্যিই ৯৭ কোটি মানুষের অসুখটা হত। লকডাউনের কারণে সংক্রমণটা কিছুটা ধীরে ছড়াল, মৃত্যুহারও অপেক্ষাকৃত কম। যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সময় পাওয়া গেল। হাসপাতাল, স্বাস্থ্য পরিষেবা সাজানোর, চিকিৎসা ও প্রতিরক্ষার সরঞ্জামের ব্যবস্থাও করা গেল।’’
হার্ড ইমিউনিটি-র তত্ত্বে তাই শিয়রে সংক্রান্তি। যদি ৯৬-৯৭ কোটি মানুষের করোনা হয়, তবে প্রায় দশ কোটি মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। পাঁচ কোটি মানুষকে আইসিইউ, ভেন্টিলেশনের পরিষেবা দিতে হবে। এত লোককে হাসপাতালে জায়গাই দেওয়া যাবে না। আবার কোভিডের মৃত্যুহার অনুযায়ী ওই সংক্রমিতদের মধ্যে তিন কোটি মানুষের মৃত্যুর জোরালো সম্ভাবনা। ডা. মণ্ডল মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘বর্তমানে কোভিডের মৃত্যু হার সাধারণ ফ্লু-র তুলনায় ১০ গুণ। বয়স্ক, কো-মর্বিড রোগীর ক্ষেত্রে চরম পরিণতি দেখা যাচ্ছে।’’ ফলে, এ দেশে করোনার সমাধানে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভাবলে বিরাট মূল্য দিতে হবে।
হার্ড ইমিউনিটির কথা তবে উঠছে কেন?
ভ্যাকসিন নেই, তাই হার্ড ইমিউনিটি-র বদলে লকডাউনকেই হাতিয়ার করছে নানা দেশ। যদিও পৃথিবী জুড়ে খুব কম দেশই ‘সার্বিক’ লকডাউনের রাস্তায় গিয়েছে। অনেকেই আবার সুইডেনের উদাহরণ দিচ্ছেন। অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও এই দেশটি কিছু হিসেবনিকেশ করে হার্ড ইমিউনিটির ঝুঁকি নিয়েছে। এখনও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি। কিছু ছোট, কম জনঘনত্বের দেশে হয়তো বিপদ কম। তবে এই ভাইরাস নানা ‘টাইপ’-এর। ভাইরাসের প্রকৃতি, দেশটির জলবায়ু-ভূপ্রাকৃতিক কারণ, লোকসংখ্যা ও ঘনত্ব, বয়স্কদের হার, এমন অনেক বিষয়ের উপর রোগের প্রকোপ নির্ভর করে। অপরিকল্পিত ভাবে হার্ড ইমিউনিটি-র কথা ভাবতে গিয়ে সাঙ্ঘাতিক বিপদে পড়েছে আমেরিকা, ইটালি, ইংল্যান্ড। শেষে লকডাউনই করতে হয়েছে দেশগুলোকে।
চাই গোষ্ঠী সচেতনতা
গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা না-ই বা হল, গোষ্ঠী সচেতনতার উপর আস্থা রাখতে হবে। সতর্কতাবিধি মানতে হবে, ইমিউনিটির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যে কোনও ভাইরাস জিনের মিউটেশনে ওস্তাদ। তার কাঠামোও বারবার পরিবর্তিত হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য বিভিন্ন দেশে আলাদা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। কোভিড-১৯’এর টিকা বার করতে বিজ্ঞানীরা লড়ছেন। তাই আশায় বুক বাঁধব, ভাইরাস নয়, লড়াইটা জিতবে মানুষই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy