কোনও ‘ট্রম্যাটিক’ পরিস্থিতিতে যে কোনও ব্যক্তিরই ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ভয় মানুষের মধ্যে ক্ষণিকের পরিবর্তন আনে ওই ভীতিজনক পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করতে কিংবা সেটাকে এড়াতে। এই প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় ‘ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স’। কোনও ট্রমা-র পরে প্রায় প্রত্যেক মানুষই নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া অনুভব করেন, যা কিছু দিন পরে কেটে যায়। ভুলে না গেলেও, ওই ঘটনা থেকে উদ্ভূত আতঙ্কটা থাকে না। কিন্তু যাঁদের সেটা থাকে, তাঁদের মধ্যে যে সব মানুষের এই আতঙ্ক চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় এবং তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যাঘাত ঘটাতে শুরু করে, তাঁদের ক্ষেত্রে পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার (পিটিএসডি) হওয়ার সম্ভাবনা খেয়াল রাখতে হবে। কোনও ভীতিজনক পরিস্থিতি না থাকলেও, আপাত দৃষ্টিতে সাধারণ ‘ট্রিগার’-এও (কোনও কথা, জায়গা, ব্যক্তি, ছবি ইত্যাদি) পিটিএসডি-র শিকার ব্যক্তিরা স্ট্রেসড হয়ে পড়েন বা ভয় পেয়ে যান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোনও গুরুতর দুর্ঘটনা, সন্ত্রাসবাদী হামলা, যুদ্ধ, যৌন নির্যাতনের মতো বিভিন্ন কারণে হতে পারে এই সমস্যা। অনেক সময়ে প্রিয়জনের আকস্মিক বিয়োগের কারণেও লোকে পিটিএসডি-তে ভুগতে পারেন। তা ছাড়া কোভিডকালেও অনেকে এই সমস্যায় ভুগেছেন। বাড়িতে প্রিয়জনকে শ্বাসকষ্টে ভুগতে দেখছেন, হাসপাতালে নিয়ে গেলে বেড পাওয়া যাচ্ছে না, চিকিৎসার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হচ্ছে, সাহায্যের জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন পরিস্থিতিতে অনেককে পিটিএসডি-তে ভুগতে দেখা গিয়েছে বলে জানালেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম।
অপ্রীতিকর ঘটনার বহু দিন পরেও পিটিএসডির শিকার ব্যক্তিরা নানা ধরনের দুর্ভাবনায় ভুগতে থাকেন। দুঃস্বপ্নের মাধ্যমে ওই ঘটনাটি তাঁদের মনে ফিরে আসে। মাঝেমধ্যেই তাঁদের দুঃখ পেতে, রেগে যেতে কিংবা ভয় পেতে দেখা যায়। সাধারণ মানুষ হয়তো ওই ব্যক্তির এমন আচরণের কারণ না-ও জানতে পারেন। ফলে তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন ওই ব্যক্তি এমন আচরণ করছেন। ডা. রামের মতে, “বৈবাহিক ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই মেয়েরা নিঃশব্দে কষ্টভোগ করেন। এই ট্রমা থেকে তাঁদের পিটিএসডি হতে পারে। পিটিএসডি-র শিকার ব্যক্তিরা কাছের মানুষগুলির থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। জোরে আওয়াজে কিংবা হঠাৎ করে গায়ে হাত দেওয়ার মতো সামান্য ঘটনাতেও তাঁদের তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখা যায়।” এই আচরণের নেপথ্যে যে ওই অপ্রীতিকর ঘটনার আতঙ্ক বা ‘ট্রমা’ রয়েছে, সেটা তখন আমাদের আঁচ করতে হবে বলে মত ডা. রামের।
পিটিএসডি-র লক্ষণ
মূলত চার ধরনের লক্ষণ দেখা যায় পিটিএসডি-র ক্ষেত্রে, যা ওই সমস্যার মাত্রার সঙ্গে কম বেশি হতে পারে। কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার প্রভাব সকলের উপরেই পড়ে। এক মাসের মধ্যে সেটা সাধারণত কেটে যায়। কিন্তু কারও যদি এই ধরনের লক্ষণগুলি এক মাসের বেশি সময় ধরে হতে থাকে এবং সেগুলি তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করে, তা হলে ধরে নেওয়া হয় যে সে ব্যক্তি হয়তো পিটিএসডি-তে ভুগছেন।
এক, রিএক্সপিরিয়েন্সিং সিম্পটম। বারে বারে ওই ঘটনার কথা মনে ফিরে আসে। মনে হয় যেন চোখের সামনেই ঘটনাটি ঘটছে। আর তা হলেই হাত পা ঘামতে থাকে, মুখ শুকিয়ে যায়, হৃদ্স্পন্দন বেড়ে যায়। কোনও শব্দ, কথা, বস্তু বা পরিস্থিতি, যা ওই ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত, তা ওই ব্যক্তির মধ্যে এই লক্ষণ চাগিয়ে দিতে পারে। যেমন, যিনি পাহাড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, তিনি হয়তো কোনও ছবিতে পাহাড়ি রাস্তায় তীব্র গতিতে গাড়ি চলা দেখে আতঙ্কিত হতে পারেন।
দুই, অ্যাভয়েডেন্স সিম্পটম। যে জিনিসগুলি অপ্রীতিকর ঘটনাটির কথা মনে করিয়ে দিতে পারে, তা কোনও ভাবে ব্যক্তির সামনে চলে এলে এই লক্ষণ দেখা যায়। তার ফলে সেই সব জিনিস থেকে যেনতেনপ্রকারেণ দূরে থাকার চেষ্টা করেন তিনি। যেমন, কারও যদি গুরুতর পথ দুর্ঘটনা হয়ে থাকে, তা হলে তিনি হয়তো গাড়ি চালাতে জানলেও আর গাড়ি চালাতে চান না কিংবা তাতে উঠতেও ভয় পেতে থাকেন।
তিন, অ্যরাউজ়াল অ্যান্ড রিঅ্যাক্টিভিটি সিম্পটম। “এই লক্ষণ সাধারণত ধারাবাহিক ভাবে হতে পারে। এ েক্ষত্রে ব্যক্তিরা হঠাৎ হঠাৎ চমকে যান, সন্ত্রস্ত থাকেন, ঘুমের অসুবিধে হয়, আকস্মিক রাগে ফেটে পড়েন। এর ফলে ওই ব্যক্তির শুতে, খেতে, মনঃসংযোগ করতে কিংবা সাধারণ কাজকর্মে অসুবিধে হয়” বলে জানালেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবারতি আচার্য।
চার, কগনিশন অ্যান্ড মুড সিম্পটম। এই লক্ষণে মানুষ ওই অপ্রীতিকর ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি মনে রাখতে পারেন না। বরং বলা যেতে পারে, ওই ট্রমার যন্ত্রণা থেকে নিজেকে বাঁচাতে, তাঁরা সেগুলি মনে রাখতে চান না। অন্য দিকে, নিজের প্রতি এরা ভ্রান্ত ও নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে শুরু করেন। মনে করেন, তাঁর জীবনে কিছুই ভাল হবে না, তিনি-ই খারাপ। নিজেকে সব সময় দোষারোপ করতে থাকেন। যেমন, ‘কেন আমি লোকটার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেলাম, যার ফলে আমাকে নির্যাতিত হতে হল’ কিংবা ‘জোরে গাড়ি চালালাম বলেই দুর্ঘটনাটি ঘটল’। এই মনোভাবের ফলে কোনও আনন্দের পরিস্থিতিতেও তিনি আনন্দিত হওয়ার বদলে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন, সেখান থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া নিজের ভাল লাগার জিনিস বা কাজের প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
শিশু বা কিশোরদের ক্ষেত্রে
শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদেরও এই সব পরিস্থিতিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, যদিও কিছু কিছু লক্ষণ একেবারেই বড়দের মতো হয় না। বিশেষ করে ছ’বছরের নীচের শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যেমন, যে শিশুটির হয়তো টয়লেট ট্রেনিং হয়ে গিয়েছিল, সে রাতে বিছানা ভিজিয়ে ফেলতে শুরু করল। কেউ হয়তো কথা বলাই বন্ধ করে দিল। অনেক সময়ে শিশুরা খেলা কিংবা আঁকার মাধ্যমে তাদের ভয়ের ভাবনাগুলি ফুটিয়ে তোলে। আবার কোনও কোনও শিশু এক জন অভিভাবক বা কাছের মানুষকে ভীষণ ভাবে আঁকড়ে ধরে। ১৩-১৪ বছরের কিশোর কিশোরীরা যদিও অনেকটা বড়দের মতোই আচরণ করে। অনেকে খুব উদ্ধত, ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। ঘটনাটি রোধ না করতে পারার জন্য কেউ কেউ অনুশোচনায় ভুগতে থাকে। কেউ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে বা চায় প্রতিশোধ। যেমন, কোনও ব্যক্তি হয়তো কোনও কিশোরীকে যৌন নির্যাতন করেছে। কিন্তু তার কোনও সাজা হয়নি। তা হলে ওই কিশোরীর ওই ব্যক্তির প্রতি তীব্র আক্রোশ কিংবা তাকে হত্যা করার চিন্তা মাথায় আসতে পারে, এমনটাই অভিমত দেবারতি আচার্যর।
চিকিৎসা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং কাউন্সিলররা কার্যকর পদ্ধতির মাধ্যমে সমস্যা নিরাময় করে থাকেন। মূলত সাইকোথেরাপি এবং মেডিকেশনের মাধ্যমে এটা করা হয়ে থাকে। একে বলা হয় কম্বাইন্ড থেরাপি। এই পদ্ধতিতে রোগী সাধারণত তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে।
সাইকোথেরাপির ক্ষেত্রে সাধারণত কগনিটিভ বিহেভিয়র থেরাপি (সিবিটি) করা হয়। বিশেষজ্ঞের সঙ্গে ‘টক সেশন’-এ বসেন রোগীরা। কথা বলার মাধ্যমে এই সমস্যা নিরাময় করা হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর ‘কগনিটিভ রিস্ট্রাকচারিং’ করা হয়। অর্থাৎ রোগীর যে চিন্তাভাবনাগুলি অবিন্যস্ত হয়ে গিয়েছে সেগুলিকে যুক্তি দিয়ে গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সিলররা। থেরাপির পাশাপাশি রোগীদের ওষুধও দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে মূলত অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট কিংবা অ্যান্টি-অ্যাংজ়াইটি-র ওষুধ খেতে হয়। ডা. রাম জানালেন, সিবিটি ছাড়া ট্রমা ইনফর্মড থেরাপিও করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রোগীর প্রতিক্রিয়াগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে, তাঁর অভিজ্ঞতাকে ছোট না করে ওই ‘ট্রমা’ প্রকোপ থেকে আস্তে আস্তে তাঁকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেহেতু প্রত্যেক মানুষ আলাদা, তাই পিটিএসডি প্রত্যেককে ভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে সকলের ক্ষেত্রে চিকিৎসাও এক রকম হয় না। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেবারতি আচার্যর মতে, যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হবে, তত তাড়াতাড়ি সেই ব্যক্তির সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy