ধরুন দার্জিলিং বা উটি ঘুরতে যাওয়ার কথা বাড়িতে বললেন, মোবাইল খুলতেই দেখলেন হোটেল বুকিং সাইটের বিজ্ঞাপন। বিয়ে নিয়ে আলোচনা করলে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং কোথায় করতে পারেন, সেই অপশন আসছে। কিছু শিখতে চাইছেন, আপনা থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ভিডিয়ো। ইটালিয়ান, কোরিয়ান, আরবি খাবার নিয়ে কথা বললে মোবাইলে সেই রেস্তরাঁর খোঁজ... অবাক কাণ্ড না? সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী স্মার্টফোন কি আজকাল নিজে থেকেই প্রয়োজনের কথা বুঝে যাচ্ছে? মোটেই না। ব্যাপারটা হল আপনি সব সময়েই অন্যের নজরদারিতে রয়েছেন। অথচ তা বুঝতেও পারছেন না।
আড়াল থেকে
দুনিয়া জুড়ে ক্রমশ নিজের জাল বিছিয়ে দিচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। প্রশ্ন উঠছে, সেই দুনিয়ায় আমাদের তথ্য আদৌ কতটা সুরক্ষিত? অনলাইন ফ্রড, স্ক্যাম, ডিজিটাল অ্যারেস্ট... শব্দগুলোর সঙ্গে অনেকটাই পরিচিতি তৈরি হয়েছে। ওটিপি, পাসওয়ার্ড শেয়ার, টাকা ট্রান্সফার ইত্যাদি বিষয়ে সকলেই সতর্ক এখন। কিন্তু এ সবই ছিঁচকে চুরি। বড় বড় ডাকাতরা কিন্তু রয়েছে মেঘের আড়ালে। নানা কাজে পারদর্শী যে এআই, তাকে ব্যবহার করেই সাধারণ মানুষের তথ্য হাতিয়ে নিয়ে সর্বনাশেরখেলা খেলছে হ্যাকাররা। এককথায়,এআই-এর এই দুনিয়ায় এখন আমরা কমবেশি সবাই ‘হ্যাকড’।
কী হারাচ্ছেন?
এ বিষয়ে কথা বলছিলেন, ডিজিটাল ফরেন্সিক অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইনভেস্টিগেটর পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “ফোনে বলা কথা তো বটেই, সেই সঙ্গে মোবাইলের আশপাশে যে সব আলোচনা হচ্ছে, তা এআই শুনতে পায়। এমনকি মোবাইলের আশপাশে থাকলে আমাদের দেখতেও পায়। এই অডিয়ো, ভিডিয়ো সবই রেকর্ড হয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, এআই-এর কাছে গচ্ছিত থাকছে আমাদের খুঁটিনাটি তথ্য, ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দের হদিসও। তাতে সাহায্য করছে সমাজমাধ্যম, বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন। আর তার সৌজন্যেই আমাদের গোটা জীবনটা পৌঁছে যাচ্ছে তথ্য চোরদের কাছে।” ফোন ছাড়াও ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টওয়াচ বা স্মার্ট টিভি থেকেও একই সমস্যা হয়।
তথ্য চুরির উদ্দেশ্য
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়িক স্বার্থে এই তথ্য চুরি। বিক্রেতাদের কাছে তাদের টার্গেট কাস্টমারের খোঁজ পৌঁছে দেওয়াই হ্যাকারদের উদ্দেশ্য। যেমন, সন্তানসম্ভবা বা সদ্য মা হয়েছেন এমন কেউ যদি সমাজমাধ্যমে সে খবর বা ছবি পোস্ট করেন, চ্যাটে বা ফোনে কাউকে জানান, অনলাইনে বাচ্চা সংক্রান্ত কোনও তথ্য বা বাচ্চাদের জিনিস খোঁজেন... এআই মারফত তা ঠিক জানতে পেরে যাবে তথ্য চোরেরা। এ বার চাইল্ড কেয়ার প্রোডাক্ট বা হবু মা, নতুন মায়েদের জন্য যে সকল সংস্থা পণ্য জোগান দেয়, তাদের কাছে সেই প্রোফাইল পৌঁছে যাবে। ক্রেতার ব্রাউজ়ার, ফিডেও সে সব সংস্থা জায়গা করে নেবে।
ভয়ের কারণ
কিন্তু এআই-এর নজরদারির অর্থ, আপনি খাচ্ছেন, ঘুমোচ্ছেন সবটাই অন্য কেউ দেখছে। অনেকেই ওয়াশরুমে মোবাইল ব্যবহার করেন। ঘরে জামাকাপড় বদলানোর সময়ে মোবাইল বাইরে রেখে আসার কথা ক’জনই বা ভাবেন! পার্থপ্রতিম বলছেন, “সে ক্ষেত্রে হ্যাকারদের হাতে ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি, ভিডিয়ো থাকছে। এআই-এর সাহায্যে ব্যক্তির ফোন নম্বর, ব্যাঙ্ক ডিটেলস ইত্যাদি হস্তগত করা তথ্য চোরেদের কাছে কঠিন নয়। সুতরাং, আরও কতশত বিপদ হতে পারে, তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।” তা ছাড়া, ডিপফেক ছবি, ভিডিয়োর মতো সমস্যা তো রয়েছেই। এআই মারফত বানানো ভুয়ো ভিডিয়ো, ফোনকলের মাধ্যমে শিশু সন্তানকে অপহরণ করা হয়েছে জানিয়ে মুক্তিপণ চাওয়া, ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের নাম করে টাকা আত্মসাৎ করার মতো একাধিক ঘটনা এ দেশে ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে।
চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর রাস্তা
আধুনিকতা ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এআই আর হ্যাকারদের জাল কেটে বেরোনো সহজ নয়। তবে অসম্ভবও নয়। দরকার সতর্কতা ও সচেতনতা।
ক্যামেরা স্লাইডার
প্রথমেই এআই-এর দেখার রাস্তা বন্ধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মোবাইলে ক্যামেরা স্লাইডার ব্যবহার করা যায়। এখনকার অনেক স্মার্টফোনের কভারে ক্যামেরা স্লাইডার থাকে। আলাদা করে তা কিনতেও পাওয়া যায়। একইসঙ্গে বাড়ির যে সকল ডিভাইস ইন্টারনেট মারফত চলে, যেমন ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্টওয়াচ, ফিটনেস ব্যান্ড, এমনকি স্মার্ট টিভি ইত্যাদিও ঢেকে রাখুন। এআই-এর সাহায্যে ব্যবহারকারীর অজান্তে অনেক সময়েই এই ওয়েবক্যামগুলো হ্যাক করে রাখেন হ্যাকাররা।
আংশিক অনুমতি
অধিকাংশ অ্যাপই মাইক ও ক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতি চায়। এই মাইক, ক্যামেরাই তথ্য চোরদের কাজ সহজ করে দেয়। তাই মাইক, ক্যামেরা, কনট্যাক্ট লিস্ট, লোকেশন, ফোন স্টোরেজ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার সময়ে ‘অ্যালাও ওনলি হোয়েন ইউজ়িং দ্য অ্যাপ’ অপশন ব্যবহার করুন। অ্যাপ ব্যবহার হয়ে গেলে, অনুমতি বদলে দিন। যে সব অ্যাপ নিয়মিত লাগে না, তাদের হাইবারনেশনে রাখা যায়।
আলাদা ফোন নম্বর ও পাসওয়ার্ড
ব্যাঙ্ক, আধার কার্ড, গ্যাস ইত্যাদি জায়গায় আর অনলাইন শপিং, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, রেস্তরাঁয় একই ফোন নম্বর, পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। পার্থপ্রতিম বলছেন, “এতে তথ্যের নাগাল পাওয়া চোরদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়। ব্যাঙ্কের পাসওয়ার্ড দিয়ে কোনও ফুড ডেলিভারি বা ক্যাব বুকিং অ্যাপে লগ ইন না করাই নিরাপদ। প্রয়োজনে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন।”
আইনি সাহায্য
সাইবার ক্রাইম বিভাগের স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসিকিউটর বিভাস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “এআই ব্যবহারের সীমারেখা এ দেশে পুরোটা এখনও বেঁধে দেওয়া হয়নি। তবে একের তথ্য বিনা অনুমতিতে অন্যকে হস্তান্তরিত করা আইনত অপরাধ। সে ক্ষেত্রে তথ্য চুরি ও গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে ডিজিটাল পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন (ডিপিডিপি) অ্যাক্টের আওতায় অভিযুক্ত সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। সংস্থা দোষী প্রমাণিত হলে আড়াইশো কোটি টাকা অবধি ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে। গুগল, মেটা ইত্যাদি কোম্পানির নামে কিন্তু ইতিমধ্যেই বিদেশে এ ধরনের একাধিক মামলা হয়েছে।” তবে এই ডেটা বোর্ড এখনও এ দেশে কাজ শুরু করেনি।
সমস্যা হল, এআই-এর জাল পৃথিবী জুড়ে। সে ক্ষেত্রে কোথায়, কোন ডেটা ব্রোকার কার তথ্য নিয়ে কী করছে, তার হদিস পাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন। অধিকাংশ মানুষ জানেনই না তাঁরা এই প্রযুক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার। বিভাস বলছেন, “এ ক্ষেত্রে ছোট ছোট বিষয়ে আগে সতর্ক হতে হবে। কান টানলে মাথা ঠিক ধরা পড়বে। এক শহর থেকে অন্য শহরের বিমানবন্দর বা রেলস্টেশনে পৌঁছলে ক্যাব বুকিং সংস্থার ‘স্বাগত’ মেসেজ আসার অর্থ তারা আপনার গতিবিধিতে নজর রাখছে। সে ক্ষেত্রে তাদের নামে মামলা দায়ের করুন।”
মোট কথা, আগামী দিনে অপরাধীদের মূল অস্ত্র হয়ে উঠছে এআই। তবে সমাধানের যা যা উপায় রইল, তার সবই কিন্তু সাময়িক। সুরক্ষার এ জাল কেটে বেরোনো এআই হ্যাকারদের পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই বিপদে পড়লে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পুলিশ, প্রশাসনের সাহায্য নিন। সমাজমাধ্যমে কী শেয়ার করছেন, তাতে লাগাম দেওয়া জরুরি। প্রযুক্তির হাত ধরে একাধিক স্মার্ট ডিভাইস নিয়ে নিজে স্মার্ট হয়ে ওঠার আগে খেয়াল রাখুন এ সকল যন্ত্রের হাত ধরেই আপনার বাড়ি, ব্যক্তিগত তথ্য ও নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে।