হঠাৎ করেই একদিন অসম্ভব পেটের যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করেন মৌসুমী। যন্ত্রণার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে মৌসুমীর হাত-পা সব ঠান্ডা হয়ে আসছিল। বমিও হচ্ছিল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে যাবতীয় পরীক্ষা করা হয়। জানা যায়, কোনও সাধারণ কারণে এই পেটে ব্যথা হয়নি। অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসে ভুগছেন মৌসুমী।
প্যানক্রিয়াটাইটিস কী?
প্যানক্রিয়াস একটি গ্রিক শব্দ। যার অর্থ ‘অল ফ্লেশ’। প্যানক্রিয়াস শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বাংলায় যার নাম অগ্ন্যাশয়।
প্যানক্রিয়াসের কাজ হল দু’টি। পাচক রস বা এনজ়াইম তৈরি করা। যা আমাদের খাবার হজম করতে সাহায্য করে। শর্করা, আমিষ এবং স্নেহ... তিন ধরনের খাবার হজমেই সাহায্য করে অগ্ন্যাশয়ে তৈরি হওয়া এই উৎসেচক। প্যানক্রিয়াসের সঙ্গে আবার কিছু ডাক্টের মাধ্যমে ইনটেস্টাইন বা অন্ত্রের সংযোগ থাকে। যেগুলি দিয়ে প্যানক্রিয়াসে তৈরি পাচক রস অন্ত্রে পৌঁছয়। তার পরেই খাবার হজমের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একে এক্সোক্রিন প্যানক্রিয়াস বলে। প্যানক্রিয়াসের আর একটি কাজ হল ইনসুলিন বা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন তৈরি করা। একে এন্ডোক্রিন প্যানক্রিয়াস বলে।
সাধারণত পাচক রস বা এনজ়াইমস তৈরি হওয়ার পরে তা প্যানক্রিয়াসে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে। অন্ত্রে পৌঁছনোর পরেই সেগুলি সক্রিয় হয়। এবং খাবার হজমের ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু কোনও কারণে যদি প্যানক্রিয়াসে থাকা অবস্থাতেই এনজ়াইমগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন তা প্যানক্রিয়াস গ্ল্যান্ডকেই হজম করতে শুরু করে। হজম করার এই প্রক্রিয়ার ফলে ইনফ্ল্যামেটরি মিডিয়েটর বেরোয়। যা ইনফ্ল্যামেশন বা প্রদাহে সাহায্য করে। অগ্ন্যাশয়ের এই প্রদাহকেই প্যানক্রিয়াটাইটিস বলে।
রকমফের
প্যানক্রিয়াসে প্রদাহ দু’ধরনের হতে পারে। একটি হল হঠাৎ প্রদাহ বা অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস। দ্বিতীয়টি হল ধীরগতির প্রদাহ বা ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস।
রোগের কারণ
বিভিন্ন কারণেই অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয় পিত্তনালির পাথর এবং অতিরিক্ত মদ্যপান। সাধারণত পিত্তনালির পাথরের কারণে মহিলাদের মধ্যে অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে মদ্যপানের কারণে।
এ ছাড়াও দেহে লিপিড বা ক্যালশিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেলে এই রোগ হতে পারে। এমনকি অগ্ন্যাশয়ে কোনও ভাবে আঘাত লাগলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়াও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বা স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের থেকে, ভাইরাল ইনফেকশন থেকে এবং কিছু কিছু অস্ত্রোপচারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও এই রোগ হতে পারে বলে চিকিৎসকেরা মনে করেন। জিনগত কারণে বা অজানা কোনও কারণেও অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে মদ্যপান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এ ছাড়াও কোনও কারণে প্যানক্রিয়াসের ডাক্টগুলি ব্লকড থাকলে পাচক রস অন্ত্রে পৌঁছয় না। সে ক্ষেত্রেও ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা।
লক্ষণ
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে পেটে তীব্র যন্ত্রণা হয়। পেটের উপর থেকে শুরু হওয়া এই যন্ত্রণা ক্রমশ গোটা পেট-সহ পিঠের শিরদাঁড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বুকের দিকেও এই ব্যথা উঠতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আবার তীব্র ব্যথার সঙ্গে বমিও হয়ে থাকে। গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিস্টরা বলেন, প্যানক্রিয়াটাইটিসের মতো সিভিয়র পেন খুব কম অসুখেই হয়। প্যানক্রিয়াটাইটিস ছাড়া অন্ত্রে রক্তের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে, সেটি মৃত হয়ে পড়লেও এ রকম মারাত্মক যন্ত্রণা হয়ে থাকে।
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিসের ক্ষেত্রে ঘনঘন পেটে ব্যথা হয়। খাবার হজম হয় না, ওজন কমতে থাকে। ডায়াবিটিস হতে পারে। অন্ত্রে পাচক রস পৌঁছয় না বলে, প্রোটিন বা ফ্যাটজাতীয় খাবার খেলেই পেটের সমস্যা শুরু হয়। বারবার স্টুল হতে থাকে।
জটিলতা
প্যানক্রিয়াটাইটিস থেকে অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন— অগ্ন্যাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে যে পাচক রস থাকে, তা জমে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
প্যানক্রিয়াটাইটিসে সিস্টেম অফ ইনফ্ল্যামেটারি রেসপন্স সিনড্রোম (SIRS) হতে পারে। যার ফলে গোটা শরীরে যে ব্লাড ভেসেল বা রক্তনালি রয়েছে, সেগুলি রক্ত বা ফ্লুয়িড ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে রক্তনালিগুলি লিক করতে শুরু করে। ফ্লুয়িড লিক করে টিসুতে জমলে রোগীর শক তৈরি হয়। এই শক থেকেই প্রাথমিক অবস্থায় প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। আসলে অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসের তিনটি ভাগ রয়েছে। মাইল্ড, মডারেট এবং সিভিয়র। ৯০ শতাংশ রোগীই মাইল্ড বা মডারেটের আওতায় পড়েন। ১০ শতাংশ রোগীর সিভিয়র প্যানক্রিয়াটাইটিস হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রেই প্রাণনাশের আশঙ্কা বেশি।
রক্তনালি থেকে রক্ত এবং ফ্লুয়িড বেরিয়ে যাওয়ায় গোটা শরীরে সার্কুলেশনের জন্য রক্তের অভাব দেখা দেয়। সেই সঙ্গে এসআইআরএস হলে শরীরের প্রধান পাঁচটি অঙ্গ, যেমন— হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, লিভার, ব্রেন ধীরে ধীরে বিকল হতে পারে।
• ডায়াবিটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
• পিত্তনালি সরু হয়ে যায়। ফলে জন্ডিস হওয়ার ভয়ও থেকে যায়।
• ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস অনেক দিন থাকলে, প্যানক্রিয়াসে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
রক্তে অ্যামাইলেজ় এবং লাইপেজ় এনজ়াইম পরীক্ষা করে সাধারণত এই রোগ ধরা হয়। মূত্রে অ্যামাইলেজ়ের পরিমাণও দেখা যেতে পারে। এ ছাড়াও রক্তের সার্বিক পরীক্ষা (সিবিসি), রক্তে সুগারের মাত্রা, ক্যালশিয়ামের মাত্রা, ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা, লিভার এনজ়াইমের মাত্রা (এএলটি, এএসটি) এ সব দেখেই রোগ এবং রোগের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করা হয়। আল্ট্রাসোনোগ্রাম এবং সিটি স্ক্যান করেও অগ্ন্যাশয়ের গাঠনিক অবস্থা বোঝা হয়।
চিকিৎসা
অগ্ন্যাশয়ে হঠাৎ প্রদাহ একটি জরুরি অবস্থা। যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করতে হয়। মনে রাখতে হবে, আইসিইউ-এর ব্যবস্থা রয়েছে, এমন হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করা ভাল। কারণ এ সময়ে হঠাৎই রোগীর বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হতে শুরু করে, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আইসিইউ বা সিসিইউ জরুরি। পিত্তে পাথরের জন্য এই রোগ হলে অস্ত্রোপচার বাধ্যতামূলক। তবে প্যানক্রিয়াটাইটিস সারিয়ে নিয়ে তবেই অস্ত্রোপচার করতে হবে।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস পুরোপুরি সেরে যেতে পারে। চিকিৎসকেরা অবশ্য বলেন, কেউ যদি বারবার অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিসে আক্রান্ত হন, তখন প্যানক্রিয়াস ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। সে ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই অনেক বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
ক্রনিকের ক্ষেত্রে শুধু উপসর্গের চিকিৎসা হয়। ঠিক মতো হজম না হলে, সে ক্ষেত্রে এনজ়াইম সাপ্লিমেন্ট দিতে হয়। ব্যথা হলে, ব্যথার ওষুধ দিতে হয়। অনেকের আবার দেখা যায়, পাচক রস পুরোটাই প্যানক্রিয়াসে থেকে যাচ্ছে। অন্ত্রে পৌঁছতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে এন্ডোস্কোপি বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাইপাস করা হয়, যাতে পাচক রস অন্ত্রে পৌঁছতে পারে।
অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস হলে ঘাবড়াবেন না। বরং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠাও সম্ভব। আর ক্রনিকের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
সাবধানতা
ক্রনিক প্যানক্রিয়াটাইটিস হলে চর্বিজাতীয় খাবার যেমন ডিম, দুধ, রেড মিট এড়িয়ে চলতে হবে। তেল জাতীয় খাবার বা ভাজাভুজিও চলবে না। ধূমপান এবং মদ্যপানও বন্ধ করতে হবে।
নিঃসন্দেহে প্যানক্রিয়াটাইটিস জটিল একটি রোগ। তবে ঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে এবং কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে এই রোগ সেরে যেতে পারে।
মডেল: প্রিয়া চৌধুরী
ছবি: জয়দীপ মণ্ডল
মেকআপ: সুমন গঙ্গোপাধ্যায়
লোকেশন: হোটেল পেঙ্গুইন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy