Advertisement
E-Paper

শিশুদের মধ্যে বাত বাড়ছে, আরও নানা রোগ হচ্ছে তার থেকে! চিনে নেওয়া যায় কয়েকটি লক্ষণ থেকে

জ্বর, সারা গায়ে র‌্যাশ দিয়ে শুরু। তার পরেই হয়তো ধরা পড়ল যে, ইমিউন ডিজ়অর্ডারে ভুগছে শিশু। দেখা দিতে পারে কাওয়াসাকির মতো অসুখও। শিশুদের বাত অন্য বহু রোগ নিয়ে আসে। এ বিষয়ে সচেতনতাও কম। রোগনির্ণয় থেকে প্রতিরোধ— নানা বিষয়ে পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকেরা।

How to diagnose Juvenile idiopathic arthritis and what are the treatment options

ব্যথা মানেই বাত নয়, কী এই জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৭
Share
Save

· ঘন ঘন জ্বর আসত শিশুটির। বয়স তখন ৮-৯ মাস। সারা শরীরে র‍্যাশ, হাত ও পায়ের পাতা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। গুজরাতের বাসিন্দা শিশুটির বাবা-মা তাকে দিল্লিতে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা করে ধরা পড়ে, কাওয়াসাকি রোগে আক্রান্ত সেই শিশু। পরে সেখান থেকে কলকাতায় নিয়ে আসার পরে অভিজ্ঞ অস্থিরোগ চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, শিশুটি জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিসে (জিআইএ) আক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ, ওই বয়সেই বাতের ব্যথা গ্রাস করতে শুরু করেছে তাকে।

· সাত বছরের মেয়ে। পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে যায়। পরীক্ষা করে দেখা যায়, সমস্যা কেবল পেটের নয়, শিশুটির রক্তচাপও বেড়ে গিয়েছে। সে মায়োসাইটিস নামে পেশির প্রদাহজনিত অসুখে আক্রান্ত। পরবর্তী কালে শিশুটির আর্থ্রাইটিস ধরা পড়ে। এখন সে চিকিৎসারত।

· কোভিড পর্ব চলাকালীন সিউড়ি জেলা হাসপাতালের ঘটনা। আট থেকে নয় বছরের কয়েক জন ছেলেমেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। বেশির ভাগই কোভিডে আক্রান্ত। পরীক্ষা করে ধরা পড়ে, তারা অনেকেই অটোইমিউন স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডারে ভুগছে। পরে ধরা পড়ে, আরএইচ ফ্যাক্টর পজ়িটিভ। অর্থাৎ, তারা আর্থ্রাইটিসের শিকার।

একটা সময়ে মনে করা হত, বাত বা আর্থ্রাইটিস কেবল প্রাপ্তবয়স্কদেরই হয়। কিন্তু, তা নয়। বাতজনিত অসুখে ভোগে শিশুরাও। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের বাত আর শিশুদের বাতের মধ্যে অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে।

শিশুদের থেকে বাতের বিষয়টি বেশ জটিল। অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, বা হাত-পায়ে যন্ত্রণা মানেই বাত নয়। শিশুদের বৃদ্ধির সময়ে হাড়ের বৃদ্ধির ব্যথা বা ‘গ্রোথ পেন’ খুব ভোগায়। তার সঙ্গে আর্থ্রাইটিসকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বলা ভাল, শিশুদের বাত কিন্তু বিরল রোগের মধ্যেই পড়ে। সারানোর পদ্ধতিও সহজ নয়। এই নিয়ে বিশদ জানিয়েছেন রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।

নিজের শরীরই যখন শত্রু

১৬ বছরের নীচে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের যে আর্থ্রাইটিস হয়, তাকে ‘জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস’ বলা হয়। আগে বলা হত ‘জুভেনাইল রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস’। ‘ইডিওপ্যাথিক’ কথাটির মানে হল ‘অজানা’। শিশুদের বাত কেন হয়, তার সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি। মূলত এটি এক প্রকার অটোইমিউন ডিজ়অর্ডার। সহজ করে বললেন, যখন নিজের শরীরই শত্রু হয়ে যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধী কোষগুলি (ইমিউন কোষ) অন্যান্য সুস্থ কোষের উপর হামলা চালাতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ইমিউন সিস্টেম কিছু অ্যান্টিবডি (প্রোটিন) তৈরি করে, যা দেহের সুস্থ কোষগুলিকে নষ্ট করতে থাকে। তখন প্রদাহ বাড়ে এবং পেশিতে ও অস্থিসন্ধিতে যন্ত্রণা শুরু হয়।

গাঁটে গাঁটে ব্যথা ভোগায় ছোটদেরও।

গাঁটে গাঁটে ব্যথা ভোগায় ছোটদেরও। ফাইল চিত্র।

এটা হল কারণ, আর রোগের প্রকাশটা হয় অন্য ভাবে। আচমকাই জ্বর, গায়ে ব্যথা, আর তার পরেই ধরা পড়ে আর্থ্রাইটিস। অনেকের আবার কাওয়াসাকি রোগও হয়, আর তা থেকেই আর্থ্রাইটিসের সূত্রপাত হয়। এমনটাই জানিয়েছেন ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেল্‌থের শিশুরোগ চিকিৎসক প্রিয়ঙ্কর পাল। তিনি বলেন, “ভ্যাস্কুলাইটিস বা কাওয়াসাকি দিয়ে শুরুটা হয় অনেক শিশুর। এই অসুখের শুরুতে ১০২ ডিগ্রি বা তারও বেশি জ্বর হয়। তিন দিন বা তারও বেশি সময় ধরে জ্বর চলতে থাকে। ঠোঁট ও চোখ লাল হয়ে যায়। শরীরের গ্রন্থিগুলি ফুলে ওঠে। মাল্টিপল সিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম দেখা দেয়। যার থেকে শরীরের নানা অঙ্গের ক্ষতি হতে থাকে। হার্টের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মায়োকার্ডাইটিস হতে পারে এবং এর থেকে পরবর্তী কালে আর্থ্রাইটিসও হয়।”

আরও একটি অসুখ হয়, যার নাম ‘সিস্টেমিক লুপাস এরিথেম্যাটোসাস’ (এসএলই)। এটিও অটোইমিউন ডিজ়অর্ডার। শরীরে অস্বাভাবিক প্রোটিন তৈরি হয়, যা সুস্থ কোষগুলির ক্ষতি করতে থাকে। এই এসএলই রোগটিও কিন্তু জুভেনাইল আর্থ্রাইটিসের অন্যতম কারণ। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, শিশুদের বাত আরও নানা রোগের সংমিশ্রণে ঘটে। আর তা নির্ণয় করা এবং সারানোও খুব কঠিন।

বাতের কারণ যখন ব্যাক্টেরিয়া

জুভেনাইল আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে সাইনোভিয়াল তরলের ক্ষরণ বেশি হতে থাকে। শরীরের প্রতিটি অস্থিসন্ধি বা জয়েন্টে আছে এই সাইনোভিয়াল ফ্লুইড। এর কাজ হল অস্থিসন্ধির প্রধান উপাদান কার্টিলেজের পুষ্টি জোগানো। এই তরলের ক্ষরণে যখন তারতম্য হয়, তখন অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ শুরু হয়। সাইনোভিয়াল ফ্লুইডের তারতম্য নানা কারণে হতে পারে, যার মধ্যে একটি কারণ হল ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ। এই ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন অস্থিরোগ চিকিৎসক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস নামে এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া অস্থিসন্ধিতে সংক্রমণ ঘটায়। এর থেকে ‘সেপটিক আর্থ্রাইটিস’ হতে পারে। অস্থিসন্ধি লাল হয়ে ফুলে ওঠে। তখন উঠতে, বসতে, হাঁটাচলা করতে সমস্যা হয়। হাত-পায়ে যন্ত্রণা হতে থাকে।”

বাতের লক্ষণগুলি ঠিক কী রকম?

আর্থ্রাইটিসের অনেক ধরন আছে এবং তাদের উপসর্গগুলিও আলাদা, যেমন—

অলিগোআর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে হাঁটু, কনুই, পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা হয়। এই বিষয়ে সিউড়ি জেলা হাসপাতালের অস্থিরোগ চিকিৎসক সুব্রত গড়াই বলেন, “শরীরে সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, ফলে সারা শরীরে ব্যথা হতে থাকে। চোখে তীব্র প্রদাহ হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ধরনের আর্থ্রাইটিসই বেশি দেখা যায়।”

কী কী লক্ষণ দেখে সতর্ক হবেন বাবা-মায়েরা?

কী কী লক্ষণ দেখে সতর্ক হবেন বাবা-মায়েরা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

পলিআর্থ্রাইটিস আরও এক রকমের বাত, যাতে চোয়াল ও গালে ব্যথা হয়। তখন খাবার চিবোতে, গিলতে সমস্যা হতে পারে। ছেলেদের থেকে মেয়েদের এই রোগ বেশি হয়।

বাতের ব্যথার পাশাপাশি ত্বকে আঁশের মতো র‍্যাশ বা সোরিয়াসিস দেখা দেয়। অস্থিসন্ধিতে দগদগে ঘা হতে পারে, চামড়া উঠতে শুরু করে। একে বলে সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস।

আরও একটি প্রকার হল স্পন্ডিলোআর্থ্রোপ্যাথি (এসপিএ)। এই ধরনের বাতে শিরদাঁড়া, নিতম্ব, টেন্ডন ও লিগামেন্ট যেখানে হাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, সেখানে ব্যথা হতে থাকে। সাত বছরের পর থেকে এই ধরনের বাতের ব্যথা হতে পারে।

১০ থেকে ২০ শতাংশ শিশুর সিস্টেমিক আর্থ্রাইটিস হতে দেখা যায়। সারা শরীরেই ব্যথা হয়। হাত, পা, কনুইতে বেশি যন্ত্রণা হয়। ঘন ঘন জ্বর আসতে থাকে। হার্ট, লিভার, কিডনিরও ক্ষতি হতে পারে।

বাতই হচ্ছে কি না, তা বোঝার উপায় কী?

রক্তের কিছু পরীক্ষা আছে যাতে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস ধরা পড়ে। যেমন—

১) ‘এরিথ্রোসাইট সেডিমেন্টেশন রেট’ (ইএসআর) এবং ‘সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন টেস্ট’।

২) ‘অ্যান্টিনিউক্লিয়ার অ্যান্টিবডি টেস্ট’-এ যে কোনও রকম আর্থ্রাইটিসের পরীক্ষা করা হয়।

শিশুদের আর্থ্রাইটিস বিরল রোগ, ইমিউন ডিজ়অর্ডার থেকে সূত্রপাত হয়।

শিশুদের আর্থ্রাইটিস বিরল রোগ, ইমিউন ডিজ়অর্ডার থেকে সূত্রপাত হয়। —ফাইল চিত্র।

৩) স্পন্ডিলোআর্থ্রোপ্যাথি হয়েছে কি না জানতে ‘এইচএলএ-বি২৭ টাইপিং জিন টেস্ট’ করা হয়।

৪) ‘রিউম্যাটয়েড ফ্যাক্টর টেস্ট’ করালেও অনেক সময় ধরা পড়ে শিশুদের বাত হচ্ছে কি না।

৫) কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) টেস্ট করিয়ে নিতে বলেন চিকিৎসকেরা। এতেও রোগ হচ্ছে কি না, তা প্রাথমিক ভাবে বোঝা সম্ভব।

চিকিৎসা কী?

আর্থ্রাইটিস সারানো খুব জটিল ব্যাপার। তবে ব্যথা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু ওষুধ ও ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। শিশুদের স্টেরয়েড ছাড়াই ওষুধ দেন চিকিৎসকেরা। প্রচণ্ড প্রদাহ বা চলাফেরায় সমস্যা হলে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়।

ফিটনেস প্রশিক্ষক অনুপ আচার্যের কথায়, ঠান্ডা ও গরম সেঁক দিলেও ব্যথা কমে অনেক সময়ে। তা ছাড়া, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফিজ়িয়োথেরাপিও করানো হয়।

শিশু যদি একই ভঙ্গিতে দীর্ঘ সময়ে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে, তা হলে ব্যথা বাড়তে পারে। তাই সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাতে টানা ৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি। ব্যথা বাড়লে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

পুষ্টিকর খাবার খুব জরুরি। বাইরের খাবার, ভাজাভুজি বেশি খেলেই শরীরে প্রদাহ বাড়বে। মাছ, ফল, সবুজ সব্জি, দানাশস্য ডায়েটে রাখতেই হবে। প্যাকেটজাত খাবার বা ঠান্ডা পানীয় একেবারেই বাদ দিতে হবে।

হালকা শরীরচর্চা করা যেতে পারে। এই বিষয়ে ফিটনেস প্রশিক্ষক অনুপ আচার্যের পরামর্শ, “আগেকার দিনে শিশুদের খুব ভাল করে তেল মালিশ করিয়ে রোদে শুইয়ে রাখা হত। এটা খুবই দরকার। ছোট থেকে এই তেল মালিশ সঠিক ভাবে করতে পারলে শিশুদের পেশি ও হাড়ের গঠন মজবুত হবে। এতে বাত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমবে।” আর ব্যায়ামের মধ্যে অল্প হাঁটা, সাইকেল চালানো বা সূর্য নমস্কার করানো যেতে পারে। তবে আর্থ্রাইটিস ধরা পড়লে খুব ভারী ব্যায়াম না করাই ভাল।

Juvenile Arthritis Child Health

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}