বছর তিরিশের শ্রীদীপা এক দিন খেয়াল করলেন তাঁর বাহুসন্ধির অংশটা ফুলে উঠেছে। তখন তাঁর অফিসে খুব চাপ চলছে, তায় মেয়ের পরীক্ষা, বরের টুর। ডাক্তার দেখানোর সময় পেলেন মাস দেড়েক পর! তখনই সার্জারি করাতে হল। বায়োপসিতে ক্যানসার ধরা পড়ল। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান ছকে দিয়ে ডাক্তারবাবু বললেন, প্রচুর নিয়মকানুন মানতে হবে। আগে এলে এত সমস্যাই হত না।
স্নানের সময় পঁয়ষট্টি বছর বয়সি বীথিদেবীর মনে হল, স্তনে একটা শক্ত দলা মতো ঠেকছে। সে দিনই সন্ধেয় মেয়ের সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গেলেন। সাত-আট মাস ধরে কেমোথেরাপি চলল। তার পর গত তিন বছর ধরে কিন্তু একেবারে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন বীথিদেবী।
কাজেই, স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে কোন বয়সে অসুখ ধরা পড়ছে, সেটা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ হল কত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু হচ্ছে। সিনিয়র ব্রেস্ট সার্জন তাপ্তি সেনের আশ্বাস, ‘‘অন্যান্য বেশ কিছু ক্যানসারের চেয়ে ব্রেস্ট ক্যানসারে ১০-১৫ বছর বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিশ্ব জুড়ে সাধারণত তিরিশ থেকে ষাট বছর বয়সি মহিলাদের এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। তবে এশিয়ায় তিরিশ বছরের মহিলাদেরও এই রোগ হচ্ছে। তাই একটু সন্দেহ হলেই বিন্দুমাত্র দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তা হলে রোগ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়বে না।’’ এই অসুখের রোগলক্ষণ, রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা পদ্ধতি বিশদে বুঝিয়ে দিলেন তিনি।
কী ভাবে চিনবেন
• স্তনে ব্যথাহীন শক্ত টিউমর হতে পারে। ব্যথা নেই বলে ডাক্তারকে দেখাতে দেরি করবেন না। তবে স্তনে টিউমর মানেই কিন্তু ক্যানসার নয়। ৮৫% ব্রেস্ট টিউমর ম্যালিগন্যান্ট হয় না। তবুও ব্যথা হোক বা না হোক, স্তনে কোনও শক্ত ভাব দেখা দিলে তখনই চিকিৎসকের কাছে যান।
• স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত পড়াও একটি লক্ষণ। তবে এই লক্ষণ থাকলেও ৮০% ক্ষেত্রে ক্যানসার হয় না। সংক্রমণ বা বিনাইন টিউমরের জন্যও এমন হতে পারে। স্তনবৃন্ত ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে, ব্যথা নেই— সে ক্ষেত্রেও ক্যানসার হতে পারে।
• অ্যাডভান্সড ক্যানসারের ক্ষেত্রে স্তনের চামড়া শক্ত হয়ে কমলালেবুর চোকলার মতো হয়ে যায়। ব্যথা কম থাকে।
• ব্রেস্টে ক্যানসার হলেও তার লক্ষণ বাহুমূলেও ফুটে উঠতে পারে। তাই এই অংশে বড় বড় গ্ল্যান্ড ফুলে উঠলেও সাবধান হন।
কাদের হতে পারে?
যে কোনও বয়সে, যে কোনও মহিলার স্তন ক্যানসার হতে পারে। আমাদের দেশে ৯১% ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের কোনও পারিবারিক ইতিহাস থাকে না। তবে যাঁদের পরিবারে আগে এই রোগ হয়েছে, সেখানে অনেক সময়ে একটা ‘ক্লাস্টার’ দেখা যায়। অর্থাৎ যাঁর এই অসুখ হয়েছিল তাঁর দিদি-বোনের মধ্যে বা দু’-এক প্রজন্ম পরের বংশধরদের মধ্যে আবার রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা যেতেই পারে। তাই এমন পরিবারের মানুষকে একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে। কিন্তু তাই বলে, যাঁদের বাড়িতে আগে এই রোগ ছিল না, তাঁরা খুব নিশ্চিন্ত থাকবেন এমনটা একেবারেই নয়। প্রত্যেককেই খুব সাবধান হতে হবে।
কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যেস মানলে, ফুসফুস পাকস্থলী বা মুখের ক্যানসার অনেক সময়ই প্রতিরোধ সম্ভব। ব্যক্তিগত অঙ্গ সুরক্ষিত রাখলে জরায়ুমুখের ক্যানসারের সম্ভাবনা কমে। কিন্তু চিকিৎসকেরা লক্ষ করেছেন যে, স্তন ক্যানসার খুব দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে। অথচ কেন এমন হচ্ছে, তার কারণ জানা সম্ভব হচ্ছে না। রোগের কারণ স্পষ্ট নয় বলেই এ রোগকে আটকানোর উপায়ও জানা নেই।
তবে আতঙ্কিত হবেন না। খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়লে, এ রোগকে দমিয়ে রাখা যায়। এমনকি আর্লি ডায়াগনসিস-এ অনেক সময়ে স্তন বাদও দিতে হয় না। স্তনের আকৃতিরও পরিবর্তন হয় না। চিকিৎসার খরচও কমে।
রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা
প্রতি মাসে ঋতুচক্রের পাঁচ-ছ’দিন বাদে স্নানের সময়ে হাত দিয়ে নিজের স্তন পরীক্ষা করার অভ্যেস রাখুন। নিয়মিত এই পরীক্ষা কিন্তু বিপদের আভাস অনেক আগেই দিয়ে দেয়। স্তন বা বাহুমূলে কোনও রোগলক্ষণ অনুভব করলে, তখনই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বয়স তিরিশ পেরোলে প্রত্যেক মহিলারই ক্লিনিকাল চেকআপ করানো উচিত। চল্লিশ বছর বয়সের পরে রুটিন ম্যামোগ্রাফি করা যেতে পারে।
অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন বা টার্গেটেড থেরাপি-র (খুব ছোট টিউমর ধরে চিকিৎসা) মাধ্যমে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসা হয়। অল্টারনেটিভ মেডিসিনে কিন্তু ক্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব নয়। এক বার ক্যানসার মুক্ত হলেও পরে অসুখ ফিরতে পারে। তাই রুটিন চেকআপ অত্যাবশ্যক।
অপারেশনের পর সাধারণত দু’দিনেই ছুটি হয়ে যায়। স্তন বাদ গেলেও শারীরিক সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রাখার অনেক উপায় আছে।
কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যতে স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা আছে কি না জানা যায়। তবে ব্যাপার হল যে, এই পরীক্ষায় যে ধরনের স্তন ক্যানসারের সম্ভাবনা ধরা পড়ে, সেই ধরনের ক্যানসার সাধারণত আমাদের দেশে হয় না।
ক্যানসারকে নয়, ভয় অজ্ঞানতাকে
ভারতে প্রায় ৮০% ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের রোগী অ্যাডভান্সড স্টেজে চিকিৎসকের কাছে আসেন। তার কারণ রোগটি নিয়ে কিছু ভুল ধারণা। ব্যথা থাকে না বলে অনেকে রোগটি অবহেলা করেন। কেউ আবার বায়োপসির নাম শুনলে পিছিয়ে যান। আবার অনেক সময়ে পরিবারের মেয়েটির স্বাস্থ্যের প্রতি অমনোযোগিতা, অযত্ন এই অবহেলার কারণ হয়। কেউ খরচ বা স্তন বাদ যাওয়ার ভয়ে ডাক্তার দেখান না। অথচ সময়মতো ভাল স্পেশ্যালিটি ক্লিনিক-এ দেখালে এই ক্যানসারের চিকিৎসা খুবই ফলপ্রসূ হয়। মানুষ বছরের পর বছর বাঁচেন। ব্রেস্ট ক্যানসার চিকিৎসার পর বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে এমন উদাহরণও প্রচুর।
স্তন ক্যানসারের ডায়াগনসিস খুব সরল। নিজে নিজেই তা করা যায়। অসুখ ধরা পড়লে তার খুব কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতিও রয়েছে। তাই আপনি সতর্ক ও প্রস্তুত থাকলে স্তন ক্যানসার আপনার ক্ষতি করতে পারবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy