Advertisement
E-Paper

অতিরিক্ত ক্লান্তি রোগের উপসর্গ নয় তো?

ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম-এ হারিয়ে যেতে পারে বাঁচার আনন্দ

ছবি: দেবর্ষি সরকার।

ছবি: দেবর্ষি সরকার।

ঊর্মি নাথ 

শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ০৮:০১
Share
Save

ব্যাধি নয়, ব্যাধির উপসর্গ নাজেহাল করে দিতে পারে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। ডাক্তারি ভাষায় এর নাম ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম, সংক্ষেপে সিএফএস। সমস্যাটি নিয়ে এখন বিশ্ব জুড়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। বিশেষ করে অতিমারি পর্বের পরে সিএফএস-এর সমস্যা বেড়েছে।

সিএফএস আসলে কী?

শরীর ক্রমশ তার তরতাজা ভাব হারিয়ে ফেলে। সারাদিন মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি, ঘুমঘুম ভাব। চলাফেরায় জানান দেয় শরীরে নানা জায়গায় যন্ত্রণা। মন ডুবে যায় অবসাদে। অনেকেই মনে করেন এ সব বুঝি জটিল কোনও রোগের লক্ষণ। কিন্তু মেডিক্যাল টেস্টে কোনও রোগই ধরা পড়ে না। এই প্রসঙ্গে জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. অরুণাংশু তালুকদার বললেন, ‘‘সিএফএস নির্দিষ্ট কোনও রোগ নয়, বেশ কয়েকটি রোগের উপসর্গের সমষ্টি। এই জন্য সিএফএস নির্ণয় করা সময়সাপেক্ষ বিষয়। কী কারণে এটি হয়, তা এখনও নিশ্চিত করে বলা না গেলেও আন্দাজ করা যায়।’’ রিউমাটোলজিস্ট ডা. অভ্রজিৎ রায়ের কথায়, ‘‘এটা নিয়ে গবেষণা চলছে। সমস্যাটি ক্রনিক তাই দীর্ঘ সময় ধরে ভুগতে হয়। এই সমস্যা শয্যাশায়ী পর্যন্ত করে দিতে পারে, ফলে বাড়ি-অফিস সর্বত্র কাজকর্ম ব্যাহত হয়। দেখা গিয়েছে, যাঁরা লং কোভিড সিনড্রোমে ভুগেছেন বা কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন, তাঁদের অনেকের মধ্যেই এই উপসর্গগুলো থেকে গিয়েছে।’’

সিএফএস-কে চিহ্নিত করে যে উপসর্গগুলি

চিকিৎসকদের মতে প্রধানত তিনটি উপসর্গ বেশ জোরালো। সেগুলি হল— ফ্যাটিগ বা ক্লান্তি, অল্প কাজ করে প্রবল পরিশ্রান্ত মনে হওয়া। জয়েন্টে ব্যথা, বিশেষ করে শারীরচর্চা করার পরে। এবং পর্যাপ্ত ঘুমের পরেও তরতাজা না হওয়া। এ ছাড়া মানসিক সমস্যা, যেমন স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মনঃসংযোগে ঘাটতি, হাতের লেখা খারাপ হয়ে যাওয়া, চড়া আলো বা অতিরিক্ত শব্দ অসহনীয় মনে হওয়া, মাথা যন্ত্রণা, বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াতে বা দাঁড়ানো অবস্থা থেকে বসার সময়ে মাথা ঘোরা, গা গোলানো, বমি ভাব, খাবার পরে ব্লোটিং ইত্যাদি সমস্যাও হতে পারে।

‘‘এগুলো ভাইরাল ফিভার, ভিটামিন ডি-র অভাব, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির উপসর্গ। তাই মুশকিল হয়ে পড়ে সিএফএস চিহ্নিত করা। বিভিন্ন পরীক্ষা করে দেখা হয় এই ধরনের অসুখ হয়েছে কি না। কোনও রোগ না থাকলে ছ’মাসের বেশি সময় ধরে একটি বা একাধিক উপসর্গ থাকলে চিকিৎসক ধরে নেন সিএফএস। বলতে পারেন অনেকটা ডায়াগনসিস বাই এক্সক্লুশন,’’ বললেন ডা. তালুকদার। এই সমস্যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনও বয়সেই হতে পারে। প্রধান উপসর্গগুলোর মধ্যে যন্ত্রণা অন্যতম, যা সবচেয়ে বেশি মানুষকে কাবু করে দেয়। এই প্রসঙ্গে ডা. রায় বললেন, ‘‘যন্ত্রণার উপসর্গে মনে হতে পারে হয়তো বাত, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিয়োপোরেসিস হয়েছে। রিউমাটয়েড হলে জয়েন্ট ফুলে যাবে, লাল হয়ে উঠবে, ত্বকে র‌্যাশ বেরোতে পারে। তাই দুটোর মধ্যে পার্থক্য করাটা জরুরি। আবার দুটো একসঙ্গেও হতে পারে। সিএফএস হলে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট স্বাভাবিক আসবে, কিন্তু রিউমাটয়েড হলে আসবে না। পাশাপাশি লং কোভিড সিনড্রোমের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’’

সুস্থ হওয়ার পথ

এই সমস্যা চিহ্নিত করতে যেমন সময় লাগে, তেমন সেরে উঠতেও সময় লাগে। ‘‘সিএফএস হলে শরীরের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। জোর করে শরীরকে বেশি খাটালে মুশকিল। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ক্ষমতাকে বাড়াতে হবে। ব্যথা হলে এবং তার কারণ পাওয়া না গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মাসাজ, ফিজ়িয়োথেরাপি, যোগব্যায়াম ইত্যাদি করতে হবে। অন্যান্য সমস্যা যেমন, ভুলে যাওয়ার সমস্যা হলে লিখে রাখা অভ্যেস করতে হবে, প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ডায়েটের সাহায্যে তা বাড়ানো যেতে পারে। পেটের সমস্যায় প্রসেসড ফুড, ভাজা খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। রাতে কম ঘুম হলে ঘুমের পরিবেশ তৈরি করে নিন, যেমন আরামদায়ক নাইটল্যাম্প জ্বেলে, পরিচ্ছন্ন করে বিছানা পেতে বা স্ক্রিনটাইম কমিয়ে। সিএফএস-এ প্রথমে ওষুধ দেওয়া হয় না। কিন্তু যদি দেখা যায় ওষুধ ছাড়া কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, তখন উপসর্গ দেখে ওষুধ দেওয়া হয়,’’ বললেন ডা. রায়।

রোগ নেই অথচ শরীরও ভাল নেই। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় মনের। আক্রান্ত মানুষটি ভাবতে থাকেন তিনি অক্ষম হয়ে যাচ্ছেন। অবসাদে ডুবে যান অনেকেই। এর জন্য চিকিৎসকেরা মনে করেন, শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট, বিহেভিয়ার থেরাপি, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট জরুরি। এ ব্যাপারে মনোবিদ ডা. জলি লাহা বললেন, ‘‘সিএফএস-এর প্রভাব শারীরিক কিন্তু সোর্সটা সাইকোলজিক্যাল। তাই যিনি এই সমস্যার মধ্যে পড়েছেন প্রথমে তাঁর ব্যক্তিত্বের অ্যাসেসমেন্ট দরকার। অনেকেই সারাক্ষণ নেগেটিভ চিন্তা করেন। মনের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। চেহারা, শারীরিক ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। এর কারণ খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে ছোট থেকেই তাঁকে ভারী কাজ করতে দেওয়া হয়নি বা তাঁর সামনে অভিভাবকেরা বলেছেন ‘ওকে বেশি কাজ দিও না, ও পারবে না’। এর ফলে অনেকেই অল্পেই বলে ‘আমি চাপ নিতে পারি না’। কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চান না বা ভীষণ রিঅ্যাক্ট করে ফেলেন। এ সব ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং বিশেষ ভাবে প্রয়োজন।’’

সিএফএস প্রাণঘাতী নয়, কিন্তু এর ফলে কর্মক্ষমতা, উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন একজন প্রাণবন্ত মানুষ। তাই সুস্থ হতে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে। প্রয়োজনে যেতে হবে মনোবিদের কাছে, বাড়াতে হবে আত্মবিশ্বাস। মেডিক্যাল টেস্টে সে ভাবে কোনও অসুখ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে, বিষয়টি এড়িয়ে গেলে চলবে না। বিশেষ করে যাঁরা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের সতর্ক থাকতে হবে।

মডেল: মোনালিসা পাহাড়ি শতপথী, তৃণা বৈদ্য

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tiredness Healthy life

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}