প্যালারাম বাঁড়ুজ্জে-র মোট কৃতিত্ব দু’টি। এক, সে টেনিদার সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছে। দুই, পটোল দিয়ে শিঙি মাছের ঝোলকে জগদ্বিখ্যাত করেছে। বছরে ছ’মাস সে ম্যালেরিয়ায় ভুগত আর বাটি বাটি সাবু খেত। দু’পা দৌড়লেই তার পালাজ্বরের পিলে চমকে উঠত। তাই শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, ট্যালটেলে ঝোলই ভরসা। দুঃখের কথা, চিংড়ি, ইলিশ, বাসন্তী পোলাও নিয়ে বাঙালির যত উল্লাস, তার সিকিভাগও পায় না এই শিঙি-মাগুরের ঝোল, কাঁচকলা আর সাবুর দানা। অথচ এই সব উপকারী পথ্য পেটরোগা, সর্দিজ্বরে রুগ্ণ বাঙালিকে যুগে যুগে রাজ্যের রোগব্যাধি থেকে আড়াল করেছে। ভোজনশিল্পে তারা উপেক্ষিত হলেও, রান্নাঘরে ফাঁকি দেওয়ার জো নেই। অসুখবিসুখে ওষুধ তো খাবেনই। সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এগুলিও চেখে দেখতে পারেন। আর তার সঙ্গে একবার সেই পুরনো সময়কে ফিরে দেখতে ক্ষতি কী?
বাঘের মুখে
সুজলা শ্যামলা বঙ্গভূমি দেখতে বড় সুন্দরী, কিন্তু তাকে সইতে পারা সহজ নয়। একুশ শতকে যেমন লাইফস্টাইল ডিজ়িজ়, সে কালে তেমন আকস্মিক ভাবে প্রাণ কেড়ে নিত ওলাওঠা, কালাজ্বর, সান্নিপাতিক, যক্ষ্মা, হাম, বসন্ত। চিকিৎসাশাস্ত্রে তখন সব রোগের জন্য জুতসই অস্ত্র ছিল না। ইনফ্লুয়েঞ্জাও দিন দুয়েকেই যমালয়ে পৌঁছে দিত। উইলিয়াম স্টিফেন অ্যাটকিনসনের কবিতায় আছে, কলকাতার দিনগুলো প্রগাঢ় উত্তাপে জ্বলত। ইউরোপীয় চিকিৎসা ও পথ্য পদ্ধতি এ দেশে কাজে দিত না। যেমন, এই পদ্ধতিতে আমাশয় রোগীর গায়ের জোর বাড়ানো হয়। তাই রোগীকে পোলাও, কালিয়া, মুরগির কাবাব, চিকেন ব্রথ, পাকা ফল দেওয়া হত। সঙ্গে ওষুধ ও ব্র্যান্ডি। যদি কোনও মতে রোগী রাতটা পেরোত, তবে সকালে ক্যাস্টর অয়েল খাওয়ানো হত। ফলাফল বিচারে দু’টি তথ্যের উল্লেখ করা যায়। ক্যাপ্টেন আলেকজ়ান্ডার হ্যামিলটন জানিয়েছেন, ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ১২০০ ইংরেজ ছিল। কিন্তু পরের জানুয়ারির মধ্যে অন্তত ৪৬০ জনের ভবলীলা সাঙ্গ হয়। সতর্কবাণী প্রচারিত হয়েছিল, গরমের মধ্যে প্রচুর মদ্য-মাংস খাবেন না।
ইউরোপিয়ানরা যদি আচরণে, খাদ্য, পানীয়, পথ্য প্রকরণে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের উপযোগী জীবনযাত্রা মানতেন, তবে হয়তো এত প্রাণহানি হত না। বেশির ভাগ রোগেরই টিকা ছিল না। সময়মতো ডাক্তার-ওষুধের বালাই ছিল না। তাই বঙ্গসন্তানরা স্বাস্থ্যকর খাবার আর পথ্য খেয়ে এ সব বিপদ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। চিঁড়ের মণ্ড, লেবু-ছানা, মুড়ি-বাতাসা, ডাবের জলেই থাকত প্রতিরোধের বর্ম। এ সব পথ্যে যে আরোগ্যপথ নিশ্চিত, তা নয়। কিন্তু রোগের বাড়াবাড়িটা কিছুটা হলেও ঠেকানো যেত।
বাঙালির তুমি ভাত-ডাল
তাপজনিত অসুখ থেকে রেহাই পেতে আর শরীরের জোর ধরে রাখতে বাঙালির আস্থা ছিল ঝরঝরে ভাতে। তা খেয়েই স্বাস্থ্যসম্পদের শ্রীবৃদ্ধি হত। তবে খেতেন পেট ভরে, পেট ঠেসে নয়। কারণ, ভাতের পরিমাণ বেশি হলেই ডায়াবিটিসের শঙ্কা। পেঁয়াজ, লঙ্কা বা শুধু নুন দিয়ে সে ভাত খেয়ে শ্রমজীবী মানুষ রোদ-জলের সঙ্গে যুঝবার শক্তি খুঁজে নিতেন। ‘বনে পাহাড়ে’-তে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বড় বড় মেটে হাড়িতে ভাত সিদ্ধ হয়েছে... ওই নিটোল স্বাস্থ্য শুধু এই উপাদানহীন ভাত খেয়ে।’ আর যে কোনও অসুখে ধনী-গরিব সকলেরই গতি সহজপাচ্য গলা ভাত। ‘‘ভাত যত ফোটানো হবে, তার উপাদান, গ্লুকোজ় চেন ভেঙে ছোট হয়ে যায়। তাই সহজপাচ্য হয়,’’ বুঝিয়ে বললেন শিশু চিকিৎসক ডা. অপূর্ব ঘোষ।
ডিসপেপসিয়া, উদরাময়, পেট ফাঁপার সঙ্গে বাঙালির জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন। তখন পথ্য চিরাচরিত চিঁড়ে সিদ্ধ। শরীরের জলের ভারসাম্য রাখতে নুন চিনির জল, ডাবের শরবত। অবস্থার উন্নতি হলে ভাত, আলু সিদ্ধ, টক দই। খই বা চিঁড়ের মণ্ড মাখা জিভে তা অমৃতবৎ। রোগের প্রকোপ কমলে দেহে বল ফেরাতে লাগত প্রোটিন। তখন থাকত মসুর ডালের জল, মৌরলা মাছের পাতলা ঝোল। কলেরা-আন্ত্রিকের ভরসা গোলমরিচের সঙ্গে কাঁজি (পান্তাভাতের টোকো জল)।
কাঁচকলার পায়েস
অজীর্ণ অম্বলের জন্য মহিলারা বয়াম ভরে বেলের মোরব্বা, জারকলেবুর আচার তৈরি করতেন। হুপিং কাশির জন্য ছিল আদা-লেবু বাটার উপাদেয় মিশ্রণ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব আমাশয় আর বায়ুবৃদ্ধি রোগে ভুগতেন। কবিরাজদের পরামর্শ মতো ছিলিমের ভিতর ধানের চাল ও মৌরি দিয়ে তামাক খেতেন। দুপুরে ভাতের পাতে খেতেন ডুমুর দিয়ে কাঁচকলার ঝোল। গলার অসুখ ধরা পড়লে তাঁকে আরও নরম খাবার দিতে হত। সুজি আর পায়েস খেতেন ঠাকুর। পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’-তে আছে, দার্জিলিঙে গিয়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর স্ত্রী বিধুমুখীর হিল ডায়েরিয়া হয়। এক মাস ধরে ডাক্তার তাঁকে কাঁচকলা আর ভাতে ভাত পথ্য করিয়েছিলেন। সেরে উঠে বিধুমুখী ডাক্তারকে নিমন্ত্রণ করলেন। ডাক্তার এসে দেখলেন রান্নার পদ অনেক। কিন্তু শুক্তো থেকে পায়েস— সব কাঁচকলার। খেয়ে বললেন, কাঁচকলা দিয়ে এত সুখাদ্য হতে পারে, ধারণাই ছিল না!
জ্বরাসুরের প্রেয়সী
বেশির ভাগ রোগের সূচনাতেই জ্বর আসে। তাতে হজমশক্তি খোয়া যায়। তখন ডাক পড়ত জল বার্লি বা দুধ বার্লির। জীবনে সে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যে রবীন্দ্র-শরৎ সাহিত্যে এই পথ্য রীতিমতো চরিত্র। অসুস্থ নায়কের জন্য প্রেয়সী বার্লি, সাবুর খিচুড়ি তৈরি করছে, স্বহস্তে খাইয়ে দিচ্ছে কি না, তার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের তাপ-নিরুত্তাপও মাপা যেত। বার্লি বা যবের এমন রাজপাটের কারণ কী? তখন ধারণা ছিল কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খেলে দ্রুত কাজ হয়। কারণ এটি পাকস্থলী এড়িয়ে সরাসরি অন্ত্রে পৌঁছয়, সেখানেই এটি হজম হয়। ‘‘বার্লি খাঁটি স্টার্চ। মাছ-মাংস মূলত পাকস্থলীতে পরিপাক হয়। স্টমাক যদি ভারী খাবারে বোঝাই থাকে, তবে তার দরজা খুলবে না। ওষুধ-সিরাপ খেলেও কষ্ট বাড়বে। তাই পাকস্থলীর বদলে পরের ধাপে, অন্ত্রে গিয়ে হজম হয়, এমন খাবারের চল ছিল,’’ বললেন জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল।
আরোগ্যের পথে
প্রাণরক্ষার পর, ‘চাঙ্গায়নী সুধা’ হিসেবে ‘শস্যপূর্ণ ওষধি বহুল’ খাবার দেওয়া হত। রক্ত বাড়াতে দেওয়া হত বেদানা, গুড়ের মতো মিষ্টি পেয়ারা। আলু, পেঁপে, গাজর, গোটা পেঁয়াজ দিয়ে সুস্বাদু মুরগির লেগ-জুস, আনাজের উপাদেয় সুপ, ডিম স্টু থাকত। মধুমেহ, কিডনির রোগে আলু, বিশেষ আনাজ বা দানাদার ফল বাদ দিয়ে পথ্য তৈরি হত। খেজুরের রস, আমলকী বা জলপাই ভাতে, পোস্ত বাটা, ক্ষারণি (এক রকম হজমি) ভাত, ছানার নাড়ু খাওয়ানো হত। স্বাদ ফেরাতে ওল বা কচুর ভর্তা দেওয়াও হত। এতে নাকি প্লীহা আর কফ সারে। মুখশুদ্ধি থাকত আমআদা বাটা, খল-হামানদিস্তায় গুঁড়ো করা লবঙ্গ-দারচিনির মিক্সচার। কৃমিরোগে নরম দানার পটোল পোড়া খাওয়ানো হত। স্নায়ুদৌর্বল্য, যকৃতের অসুখ, পিত্তরোগের জন্য যত্ন করে মাখা হত মিষ্টি মিষ্টি পেঁয়াজ পোড়া।
অর্থাৎ রোগে পড়লেই প্রচুর অ্যাটেনশন! চাই নিশ্চিন্ত ঘুম, বিকেলে পাউরুটি আর পেঁপে গাজর সিদ্ধ দিয়ে দেশি মুরগির স্টু। আহা! অসুখেও সুখ কম নয়। তারই তো একটা নাম পথ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy