বদলে যাচ্ছে কলকাতার শীতের সাজ। ছবি: ইনস্টাগ্রাম
সামান্য ঠান্ডা পড়তেই আলমারি থেকে শাল-কম্বল বার করে ফেলে বাঙালি। সবার আগে বেরিয়ে আসে মাঙ্কি টুপি। আর সেই শাল-টুপির আড়ালে লুকিয়ে পড়ে সাজ-কায়দা। কিন্তু বাকি দেশ জুড়ে বাঙালির প্রচলিত ছবি কি সত্যিই বাস্তব? না কি এ-ও বাঙালির ‘আসলেমি’ বা ‘ভাতঘুম ছাড়া চলে না’-র মতো দাগিয়ে দেওয়ার বিষয়?
শহর জু়ড়ে এখন শীতের মরসুম। দু’পা হেঁটে দেখলে বা মেট্রোয় চাপলেই বুঝতে পারবেন কলকাতা এখন আসলে কতটা কেতাদুরস্ত। বাঙালি মোটেই শুধু কাশ্মীরে শাল আর দার্জিলিঙের টুপি-মাফলারে আটকে নেই। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারাও আলমারি ভরিয়েছে নিত্য নতুন হাল ফ্যাশনের পোশাক-আশাকে। তাঁদের গায়েও উঠেছে নানা রঙের ট্রেঞ্চ কোট, পা ঢেকেছে রকমারি বুটজুতোয়। তবে ভাববেন না, শুধু ‘ফ্লুরিজ’-এ বসা লরেটো-জেভিয়ার্সের কমবয়সি পড়ুয়াদের কথাই এখানে বলা হচ্ছে। ফ্যাশন মানচিত্রে তাঁরা যে অনেকটা জায়গা জুড়ে বসে আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কোয়েস্ট কিংবা সাউথ সিটি মলের দোকানগুলির বিক্রি বাড়িয়ে তাঁরাই কলকাতার আলিয়া ভট্ট বা রণবীর সিংহ হয়ে ওঠেন। ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটলেই বোঝা যায় কলকাতার ফ্যাশন প্রভাবীরা দিল্লি বা মুম্বইয়ের প্রভাবীদের চেয়ে খুব একটি পিছিয়ে নেই। বরং অনেকেই দেশের সাম্প্রতিকতম সাজের ধরনগুলির সঙ্গে বাঙালিয়ানার মিশেল সুনিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলছেন তাঁদের রোজকার সাজে। কিন্তু এখানে শুধু ফ্যাশনের সেই ধ্বজাধারীদের কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে সাধারণ গৃহবধূর যিনি ফেসবুক লাইভ থেকে কাঁথার কাজ করা ওভারকোট কিনছেন, কথা হচ্ছে ব্যাঙ্কে কর্মরতা কিংবা সরকারি স্কুলের শিক্ষিকার, যাঁরা সহজেই ‘অ্যামাজন’ কিংবা ‘মিন্ত্রা’ থেকে অর্ডার করছেন ঠিক দীপিকা পা়ড়ুকোনের মতো টুপি বা কার্ডিগান। কথা হচ্ছে বারাসাত কিংবা সোনারপুরের কিশোর-কিশোরীর, যাঁরা খিদিরপুর বাজার খুঁজে খুঁজে ঠিক তাঁদের পছন্দের তারকার মতো নকল ব্র্যান্ডের স্নিকার্স এবং জাম্পার জোগাড় করে ফেলেন।
রোজ যদি কলকাতার রাস্তা দিয়ে হাঁটেন বা বাস-ট্রামে যাতায়াত করেন, তা হলে এমন অনেক দৃশ্য দেখেই চমকে যেতে পারেন। ক্যাটরিনা যখন লক্ষ লক্ষ টাকা মূল্যের সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের তৈরি শাড়ি পরে ভিকি কৌশলের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়ছেন, ঠিক তার পরদিনই হয়তো মেট্রোয় এক বজবজের তরুণী অবিকল এক ধরনের শাড়ি পরে সেজেগুজে স্মার্টফোনের পরদায় ভিক্যাটের বিয়ের ছবি দেখছেন। তার পরনের শাড়ি আর ক্যাটরিনার শাড়ির মূল্য এবং মান— দুইয়েই আকাশ-পাতাল তফাত। কিন্তু তাঁর শাড়ির ধরনও একই। কম দামি সিন্থেটিক স্যাটিন কাপড়ের শাড়ি, তার উপর একটি সস্তার নেটের আবরণ। সঙ্গে ওই স্যাটিন কাপড়েরই কাটা থ্রিডি ফুলের গোছা গোটা শাড়ি জুড়ে শোভা পাচ্ছে। ক্যাটরিনার হাল্কা গোলাপি ফরাসি টুলে শাড়ির ভাবনাতেই কিন্তু এই শাড়িও তৈরি। বজবজের তরুণী তাঁর সাধ্যের মধ্যে শাড়ি কিনেছেন, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য সেই ক্যাটরিনাই হয়ে ওঠা। মাঙ্কি-টুপি ছা়ড়া আর কিছুই চেনে না— এমন বদনামে যে জাতি ডুবে রয়েছে, তাদের জন্য এ-ই বা কম কী!
পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক সম্পদের কতটা ‘ট্রিক্ল ডাইন এফেক্ট’ হয়, তা বলা মুশকিল। কিন্তু সাজের ক্ষেত্রে তা হয় অন্য ভাবে। ঝলমলে দুনিয়ার মার্জার সরণিতে বা বলিউ়ডের রুপোলি পর্দার যে সাজ চোখে পড়ে, নেটমাধ্যমের সাহায্যে সেই ছবি পৌঁছে যায় দেশের সব কারিগরদের কাছেই। হাতে বোনা ‘কুঁতিয়োর’ পোশাকের ভাবনা কারখানা ঘুরে হাজির হয় হাতিবাগান বা গড়িয়াহাটের ফুটপাথ পর্যন্ত। আর সেই পোশাকে সেজেই তিলোত্তমা প্রতিনিয়ত হয়ে ওঠে আরও কেতাদুরস্ত, আরও নজরকাড়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy