প্রতীকী ছবি।
বছর ছাব্বিশের শান্তনু। পেশায় চিত্রগ্রাহক। খদ্দেরদের সঙ্গে মিটিং রয়েছে আগামী কিছু কাজ নিয়ে। তাই সকাল সকাল সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু কোনও অফিস নয়, মিটিং করতে শান্তনু হাজির হল হিন্দুস্তান পার্কের এক বিখ্যাত কাফেতে। দরজা ঠেলে ঢুকেই তাঁর দেখা হল স্কুলের বান্ধবী লীনার সঙ্গে। লীনা একটি কোণের টেবিল জুড়ে সাজিয়ে বসেছে নিজের ল্যাপটপ-ডায়েরি-পেন। কন্টেন্ট রাইটার লীনার এখন রোজের অফিস এই কাফেই। ঠিক বেলা ১১টায় সে এক কাপ মোকা নিয়ে বসে পড়ে। বিকেল ৩টে অবধি তাঁর লেখালিখির কাজ চলে। মাঝে টুকটাক খাওয়া আর সঙ্গে অন্তত চার কাপ মোকা।
শান্তনু-লীনারা একা নয়। শহরের কমবয়সিদের এখন কাফেগুলিতে নিত্য আনাগোনা। যত না আড্ডা দিতে, তার চেয়েও বেশি কাজের জন্য। অতিমারিতে সেই অভ্যাস আরও বেড়েছে। বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে কাজ করতে আর কত দিন ভাল লাগে? তাই লকডাউনের কড়াকড়ি একটু শিথিল হলেই তাঁরা ছুটছেন বিভিন্ন কাফেতে।
গত পাঁচ-সাত বছরের কলকাতায় কাফের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। দিল্লি-বেঙ্গালুরুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলকাতায় কাফেগুলিও নানা রং, নানা কায়দায় গজিয়ে উঠেছে। কোনওটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তকমা মারা। সেখানে ঢুকে নেটমাধ্যমে একটি ‘চেক ইন’ দেওয়া মানেই বন্ধুমহলে তাঁর কদর বেড়ে যাওয়া। আবার কোনও কাফে নেহাতই ছোটখাটো। অন্তর্মুখী তরুণ-তরুণীদের জন্য সেটাই শ্রেষ্ঠ কর্মক্ষেত্র। কিছু কাফে আবার দারুণ রঙিন। খুব যত্ন নিয়ে সাজানো। কাফের মেনুতেও রয়েছে দেশ-বিদেশের নানা রকম খাবার। সেখানে এক দিকে যেমন চলে কাজের মিটিং, তেমনই অন্য দিকে চলে জমিয়ে আড্ডা।
গ্রাফিক ডিজাইনার অর্ণব ১০-৫টার বাঁধা চাকরি অনেক দিন আগেই ছে়ড়ে দিয়েছেন। বাড়ি কসবায়। অতিমারির অনেক আগে থেকেই তিনি নিয়মিত খদ্দের ছিলেন গোলপার্কের একটি ছোট্ট কাফের। বাড়ি থেকে এতটা দূর রোজ বাসে করে গিয়ে কাজ করেন কেন তিনি? ‘‘আমার পরিবারে অনেক সদস্য। যখন চাকরি ছেড়ে নিজের মতো কাজ করা শুরু করলাম, তখন কিছু দিন বাড়ি থেকেই সব করতাম। কাজের মাঝে অনেক বার উঠতে হত। বাড়ির নানা লোকের নানা কথা শুনতে হত। যেহেতু আমার মাথার উপর কোনও বস্ নেই, তাই নিজে নিয়ম মেনে কাজ না করলে, নিজেরই ক্ষতি বেশি হচ্ছিল। কাফেতে গিয়ে কাজ করা শুরু করে দেখলাম, সেখানে অনেক নিরিবিলি পরিবেশ। অনেক কম সময়ে বেশি কাজ শেষ করে ফেলতে পারছিলাম,’’ বললেন অর্ণব।
শুধু খেতে বা কাজ করতেই কি সকলে কাফেতে যান? তা কেন? কত নতুন সম্পর্ক শুরুর কেন্দ্রবিন্দু এই জায়গাগুলিই। লেকের ধারে বা ভিক্টোরিয়ার মাঠ ছেড়ে প্রেমিক-প্রেমিকারা অনেক দিন আগেই কাফে পৌঁছে গিয়েছেন। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ঝগড়া-আলোচনা-ভালবাসার ঝড় ওঠে কাফেগুলিতেই। প্রেম-ভালবাসার সংজ্ঞা যত বদলেছে এই শহরে, তাঁর সাক্ষী থেকে গিয়েছে বিভিন্ন কাফে। সুবর্ণা এবং দীতি নিজেদের কথা মন খুলে কোনও দিন বলতে পারেননি কলেজ ক্যান্টিনে। কিন্তু গল্ফ গ্রিনের ছোট্ট কাফেতে তাঁরা দু’জনকে খুঁজে পেয়েছিলেন। মনের কথা বলতে বলতে এক দিন একসঙ্গে থাকার সিদ্ধন্তও সেই কাফেতে বসেই। সুবর্ণা-দীতির মতো অনেক জুটিরই বেড়াতে যাওয়ার প্রিয় গন্তব্য শহরের বিভিন্ন কাফে। মৈনাক এবং তাঁর সঙ্গী দেবার্ক মাঝেমাঝেই পার্ক স্ট্রিটের একটি কাফেতে বসে জলখাবার সারেন। মৈনাক বললেন, ‘‘কোনও বড় রেস্তরাঁয় দু’টি ছেলে খেতে গেলে এখনও অনেকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু ছোটখাট কাফেগুলিতে কেউ ঘুরেও তাকায় না। যে ধরনের মানুষ এই জায়গাগুলিতে খেতে আসেন, তাঁরা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি সহনশীল। সমাজের সব রকম মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে। তাই আমরাও যখন ডেটে যাই, তখন কোনও কাফেই বেছে নিই।’’
তবে সম্পর্কের যেমন সংজ্ঞা বদলেছে, তেমনই ‘কফি ডেট’-এরও। অ্যাপের মাধ্যমে হয়তো নতুন কারও সঙ্গে আলাপ। মুঠোফোনের পরদায় ভেসে উঠল দু’টি শব্দ— ‘কফি ডেট?’ তখন আমন্ত্রণটি শুধুই কফি খাওয়ার, নাকি আরও বেশি কিছু, তা আপনাকেই বুঝে নিতে হবে। কারণ ডেটিং অ্যাপের আমলে কোনও ‘কফি ডেট’ই শুধু কফি খাওয়ায় সীমিত থাকে না। কমবয়সিরা ভালই জানেন, এই দু’টি শব্দ আদপে কীসের আমন্ত্রণ। কাফেতে বসে কফি শেষ করে সেই ডেট যে শোয়ার ঘর পর্যন্ত গড়াবে, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয় তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। কালে কালে এ ভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেছে এই শহরের কাফেগুলিও।
শুধু কফি খেতে অবশ্যই কোনও দিনই কাফের প্রয়োজন ছিল না। আড্ডা-বন্ধুত্ব-প্রেম পেরিয়ে আরও যে নতুন নতুন অনুভূতি তৈরি হচ্ছে এই কাফেগুলিতে, সেটাই এখন চর্চার বিষয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy