প্লাস্টিক থেকে দূরে থাকুন।
কিছু দিন আগের ঘটনা। একটি অন্তঃসত্ত্বা তিমির মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে ইটালির উপকূলে। তিমির পেট থেকে পাওয়া গিয়েছে ২২ কিলোগ্রাম প্লাস্টিক। তবে এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রত্যেক দিনই সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাচ্ছে এই প্লাস্টিক দূষণে। জলের বাসিন্দাদের প্রাণ যদি সংকটাপন্ন হয়, তা হলে মানুষই বা কত দিন এই বিপদসীমার বাইরে থাকবে?
প্লাস্টিক-নির্ভর হয়ে পড়ছেন?
অফিসের ক্লান্তি কাটাতে রাস্তার চায়ের দোকানে প্লাস্টিকের গ্লাসে আসে চা। রেস্তরাঁয় অর্ডার করলে খাবার আসে প্লাস্টিকের কনটেনারে, সঙ্গে প্লাস্টিকের চামচ। এমনকি বাচ্চার দুধের বোতলেও প্লাস্টিক। দুধের প্যাকেট, কেক, বিস্কিটের প্যাকেট থেকে শুরু করে ঘরে জল খাওয়ার বোতলও তো প্লাস্টিকেরই। ওষুধের প্যাকেজিংয়েও ব্যবহার করা হয় প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিকের কিছুটা অংশ কি চলে যাচ্ছে না আমাদের শরীরে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, প্লাস্টিক বর্জন করা হলেও তার শেষ হবে কী ভাবে? কারণ পুকুরে, নদীতে প্লাস্টিক ফেললে সেখানকার প্রাণীদের জীবনও যে সংশয়ে।
ক্ষতি হচ্ছে কী ভাবে?
মাছ, পাখি সব প্রাণীই এই প্লাস্টিক দূষণের শিকার। মানুষ যদি নিজের দিকেও তাকায়, তা হলে বুঝতে পারবে এর ক্ষতিকর প্রভাব কতটা। একটি আন্তর্জাতিক জার্নাল অনুসারে, প্লাস্টিক পরিবেশের অনেক বিষাক্ত কেমিক্যাল টেনে নিতে পারে। তার পরে সেই প্লাস্টিক যদি কোনও মাছের পেটে চলে যায়, তা হলে তার শরীরে সেই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থও প্রবেশ করে। পরে সেই মাছ খাওয়ার সময়ে আমাদের শরীরেও ঢুকে যায় সেই বিষ। ক্যানসারের মতো প্রাণঘাতী অসুখ থেকে শুরু করে জন্মগত ত্রুটি, মধুমেহ, গর্ভাবস্থায় জটিলতা, রোগপ্রতিরোধ শক্তি হ্রাস, হৃদ্রোগ, যকৃতের অসুখও ডেকে আনতে পারে এই প্লাস্টিক।
প্রথমে প্লাস্টিক চিনতে হবে
ঘনত্ব অনুযায়ী প্লাস্টিকের অনেক ভাগ হয়। সেই ভাগটা আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
পলিয়েথালিন টেরেপথ্যালেট (PETE): সোডার বোতল, ওষুধের জার, চিরুনি, প্লাস্টিকের দড়ি এই ভাগে পড়ে। এই ধরনের প্লাস্টিক রিসাইক্ল করে কার্পেট, জ্যাকেট, জুতো, লাগেজ ব্যাগ বানানো যায়।
হাই ডেনসিটি পলিয়েথালিন (HDPE): এর মধ্যে দুধের জাগ, শ্যাম্পুর বোতল, খেলনা ইত্যাদি জিনিস পড়ে। রিসাইক্ল সম্ভব। লাম্বার ফেন্সিং ইত্যাদি ধরনের কাজে ব্যবহার করা যায়।
পলিভিনাইল ক্লোরাইড (PVC): প্লাম্বিং পাইপ, জানালার ফ্রেম, সিউয়েজ পাইপ পিভিসির আওতায় পড়ে। এদের রিসাইক্ল সম্ভব হলেও পদ্ধতি জটিল।
লো ডেনসিটি পলিয়েথালিন (LDPE): স্যান্ডউইচ ব্যাগ, সস ও মধুর বোতল, স্কুইজ় বোতল, ফ্রোজ়েন ফুডের ব্যাগ ইত্যাদি। এর রিসাইকল পদ্ধতিও বেশ জটিল।
পলিপ্রপেলিন (PP): প্লাস্টিক ডায়পার, বিভিন্ন রকম টিফিন বক্স, মার্জারিনের টাব ইত্যাদি। রিসাইক্ল সম্ভব নয়।
পলিস্টাইরিন বা স্টাইরোফোম (PS): খাবারের বক্স, প্যাকিং ফোম, প্লাস্টিক কাটলারি। এদেরও রিসাইক্ল সম্ভব নয়।
সাধারণত এই সাত রকম প্লাস্টিকই দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগে।
এ ছাড়াও পলিকার্বোনেট, অ্যাক্রিলিক, ফাইবার গ্লাস, নাইলনও প্লাস্টিকের মধ্যেই পড়ে। বিপিএ প্রডাক্টও রিসাইক্ল করা যায় না। উচ্চ তাপমাত্রায় একমাত্র নষ্ট হয়। এই ধরনের প্লাস্টিক ভাঙে না। ফলে কনটেনারে বিপিএ মুক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার করাই ভাল।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
প্লাস্টিকের বিকল্প
নিজেদের সচেতন হওয়া জরুরি। তার সঙ্গেই কিছু প্লাস্টিকের বিকল্পেও নজর রাখতে হবে। অনুষ্ঠানে প্লাস্টিক বা থার্মোকলের পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন কলা বা শাল পাতার থালা। বেঁচে থাকবে নস্ট্যালজিয়া। বাঁচবে শরীরও। প্লাস্টিকের বোতল সরিয়ে কাচ, স্টিল বা তামার বোতল কিনতে পারেন। ছোটবেলায় অনেকের বাড়িতে স্টিলের জাগ ও গ্লাসের ব্যবহার হত। বার করে নিতে পারেন সে সব। বাচ্চার দুধের বোতল কেনার সময়ে অবশ্যই দেখে নেবেন তা বিপিএ ফ্রি কি না। ব্যয়সাপেক্ষ হলেও বিপিএ ফ্রি দুধের বোতল কিনুন এবং ছ’মাস বাদে বাদে পালটে ফেলাও জরুরি। সিলিকন নিপ্লওয়ালা স্টিলের ফিডিং বোতলও কিনতে পারেন। বাইরে না বেরোলে বাচ্চাকে ডায়পার না পরানোই ভাল। রেস্তরাঁ থেকে খাবার আনার প্লাস্টিক কনটেনার পত্রপাঠ বিদায় করুন। সেগুলো বাড়িতে জমিয়ে তাতে খাবার রাখবেন না। সেই কনটেনারে খাবার গরমও করবেন না। বাজার-দোকানে যাওয়ার সময়ে বাড়ি থেকে কাপড় বা পাটের ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে যান। এমনকি পোশাকের শপিংয়ে গেলেও সঙ্গে রাখুন ব্যাগ। স্ট্র ব্যবহার না করে চুমুক দিয়ে পান করা যায়। আবার আইসক্রিম খাওয়ার সময়ে ওয়েফার কোনে আইসক্রিম নিলে বর্জ্য বলে কিছু থাকে না। অথবা কাঠের চামচ ব্যবহার করা যায়। কাঠের চিরুনি ব্যবহার করতে পােরন। ফ্রিজে প্লাস্টিকের জায়গায় স্টিলের আইস ট্রে ও পপসিক্ল বার রাখতে পারেন। বিউটি প্রডাক্টও বেশির ভাগই প্লাস্টিক কনটেনারে পাওয়া যায়। তার জায়গায় বেছে নিতে পারেন টিন বা কাচের কনটেনারের বিউটি প্রডাক্ট। এতে খরচটা বাড়তে পারে, কিন্তু সমস্যা কমবে।
পুনর্ব্যবহার
প্রত্যেক দিন প্রতি শহরে যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তা শক্তি উৎপাদনে কাজে লাগানো যেতে পারে। ওয়েস্ট টু এনার্জি (ডব্লিউটিই) প্ল্যান্টে এই ধরনের বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদন করা যায়। তবে ডব্লিউটিই প্ল্যান্টে বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনে বাধাও রয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত মাল্টিপ্ল ট্র্যাশ বা মিশ্রিত বর্জ্যই ডিসপোজ় করা হয়। রান্নাঘরের আনাজের খোসা বা খাবার জাতীয় বর্জ্য পচনশীল। ফলে এই মিশ্রিত বর্জ্য ব্যবহার করতে না পারায় এমন অনেক ওয়েস্ট টু এনার্জি প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অতএব প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত বর্জ্যের ধরন অনুযায়ী তা আলাদা করা। প্লাস্টিকের জন্য আলাদা ডাস্টবিন থাকলে এবং মিউনিসিপ্যালিটির নিয়ম অনুসারে তা ডিসপোজ় করা হলে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কলকাতাবাসীদের জন্য
কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি থেকেও এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আপাতত কলকাতার ২০টি ওয়ার্ডে তা প্রযোজ্য। এই ওয়ার্ডের প্রত্যেকটি বাড়িতে সাদা ও সবুজ রঙের দু’টি ডাস্টবিন দেওয়া হয়েছে। যাতে ফেলা যাবে নন-বায়োডিগ্রেডেব্ল ও বায়োডিগ্রেডেব্ল ওয়েস্ট। তা হলে বর্জ্যের পৃথকীকরণটা প্রাথমিক ভাবে বাড়িতেই হয়ে যাবে। পরিকল্পনা মাফিক এগোলে খুব শীঘ্রই কলকাতার বাকি ওয়ার্ডেও এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়াও ৫০ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিক অবৈধ। সুতরাং বাজারে সেই ধরনের প্লাস্টিক আপনিও রিফিউজ় করতে পারেন।
ছোট ছোট পদক্ষেপেই এগিয়ে যেতে হবে। যােত প্লাস্টিকহীন পৃথিবীতে মুক্ত ভাবে বেঁচে থাকতে পারি আপনি, আমি ও আমাদের পরিবার। তাই প্লাস্টিক কতটা ব্যবহার করবেন, তা ভাবার পালা এ বার...
মডেল: ডিম্পল, ত্বরিতা, ঐশিকী; মেকআপ: সৈকত নন্দী; হেয়ার: স্বরূপ দাস;
ছবি: অমিত দাস; লোকেশন: লাহা বাড়ি; পোশাক: ওয়েস্টসাইড, ক্যামাক স্ট্রিট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy