কোভিড সংক্রমণে কতটা প্রভাব মস্তিষ্কে? ছবি: শাটারস্টক
ব্রেন স্ট্রোক আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বালুরঘাটের ৫৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তি। মৃত্যুর আগে লালারসের নমুনায় দেখা যায়, আগেই কোভিড পজিটিভ ছিলেন তিনি।
অসম্ভব মাথা ব্যথা করছিল, আচমকা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট ঠিক ছিল। কিন্তু করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ এল রিপোর্ট।
শরীর একেবারের সুস্থ, কিন্তু দু’দিন কোনও গন্ধ পাচ্ছিলেন না কোভিড যোদ্ধা এক চিকিৎসক। পরীক্ষা করতেই ফল আসে পজিটিভ।
কারও ক্ষেত্রে করোনার সঙ্গে দোসর হয়েছে গুলেনবারি সিনড্রোম। হাত-পা অবশ হয়ে আসা, জ্বর— জিবি সিনড্রোম বা গুলেনবারি ধরা পড়েছে শহরেরই এক বেসরকারি হাসপাতালে। কোভিডের উপসর্গ হিসেবে শ্বাসকষ্টকে ধরে নেওয়া হয়েছিল প্রথম দিকে। আক্রান্ত হচ্ছিল হার্ট ও ফুসফুস। কিন্তু কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর শুধুমাত্র ফুসফুস কিংবা হৃদযন্ত্র নয়, মস্তিষ্ক এবং অবশ্যই স্নায়ুতন্ত্র বা নার্ভাস সিস্টেমেও এর প্রভাব পড়ছে বলেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসকেরা ।
অনেক ক্ষেত্রেই স্ট্রোক নিয়ে রোগী আসছেন, দেখা যাচ্ছে তিনি করোনা আক্রান্ত। কিন্তু করোনার কারণেই স্ট্রোক, না কি স্ট্রোকের পরে সংক্রমণ, সেটা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করেন মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস।
স্নায়ুতন্ত্রে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত রায়ের মত, ৩০ থেকে ৩২ শতাংশ করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেই স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব পড়ে। সবটাই যে বিপজ্জনক এমনটা নয়।
আরও পড়ুন: কোভিডের আবহে রক্তরোগীদের বিপদ বেশি, কী কী মেনে চলবেন
কী কী হতে পারে?
• কারও ক্ষেত্রে একটানা মাথা ব্যথা বা মাথা ধরে থাকা, হয়তো বাড়িতেই সেরে গেল।
• গন্ধ পাচ্ছেন না অনেকেই, অনেকের ক্ষেত্রেই এই অনুভূতি ফিরে আসতে সময় লাগছে। বা কেউ সেরে গিয়ে কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পরও গন্ধের অনুভূতি ফিরে পাননি মাস দুই-তিন পরেও।
• কারও ক্ষেত্রে স্বাদের সমস্যা হচ্ছে
• কোভিড এনকেফালাইটিসের রোগী ২ থেকে ৩ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের কোষ থেকে কোভিড ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। কোভিড রক্তে ছড়িয়ে পড়লে যে কোনও জায়গায় যেতে পারে, তাই প্রভাব পড়ছে মস্তিষ্কেও।
এই প্রসঙ্গে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অংশু সেন বলেন, সরাসরি মস্তিষ্কে সংক্রমণ হতে পারে বা প্যারা ইনফেকশন কমপ্লিকেশন হতে পারে। তবে শুধু সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেমেও প্রভাব পড়তে পারে কোভিড-এর জন্য।
আরও পড়ুন: স্পুটনিকে জব্দ কোভিড ১৯? কী বলছেন চিকিৎসকরা
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে হানা দিলে
• স্ট্রোক, এনকেফালাইটিস (সংক্রমণ থেকে প্রদাহ), এপিলেপ্সি বা মৃগীর উপসর্গ, নেক্রোটাইজিক হেমারহেজিক স্ট্রোক (রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া, পরবর্তীতে স্ট্রোক)
• মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরানো, গন্ধ-স্বাদের সমস্যা, গা হাত পা ব্যথা
• র্যাবডোমায়োলাইসিস (পেশীর ভাঙন)
পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেমে
• জি বি সিনড্রোম (ভাইরাস সংক্রমণ থেকে পরবর্তী পক্ষাঘাত)
• হাইপারটেনশন-ডায়াবিটিস বা ফুসফুসের সমস্যা থাকলে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এগুলো বেশি দেখতে পাওয়া যায়, এমনই জানান অংশবাবু।
কোভিড-১৯ ভাইরাস মস্তিষ্কে যায় কী ভাবে?
অংশুবাবুর কথায়, হেমাটোজেনাস স্পেস বা রক্ত এবং অলফ্যাক্টরি স্পেস (নাকের মধ্য) দিয়ে চলে যেতে পারে ভাইরাস। শরীরে অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম নামের কিছু রিসেপটর রয়েছে, এগুলি মস্তিষ্কের এন্ডোথেলিয়াল কোষে থাকে। সেখানে ভাইরাস সংযুক্ত হয়ে যায়। কোমাও হতে পারে এর থেকে।
আরও পড়ুন: কোভিডের মরসুমে উচ্চরক্তচাপ বশে রাখতে না পারলে বিপদ, নিয়ন্ত্রণ কী ভাবে, জেনে রাখুন
এর ফলে কী হয়
• কোয়াগুলোপ্যাথি হতে পারে অর্থাৎ রক্ত জমাট বেঁধে ইসকিমিক স্ট্রোক হতে পারে।
আচমকা মাথা ঘুরে যে ব্যক্তি রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলেন, চিকিৎসক ডি-ডাইমার রিপোর্ট দেখার পরই আরটিপিসিআর করতে দিলেন। করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এল, দক্ষিণ কলকাতার এক রোগীর ক্ষেত্রে এমন হয়েছে। কেন? ডি-ডাইমার কী?
• কারও ক্ষেত্রে ভাসকুলার এন্ডোথেলিয়াল ডিজফাংশন (রক্তবাহে রক্ত চলাচল সংক্রান্ত সমস্যা) হচ্ছে করোনার ফলে। সে ক্ষেত্রে এন্ডোথেলিয়াল কোষ কাজ করছে না, শরীরে ‘ইনক্রিজড ডি-ডাইমার’ তৈরি হচ্ছে, রক্ত চলাচলে সমস্যা হচ্ছে, তাই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন, এমনই জানান অংশুবাবু।
রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি মাপার একটি একক ডি-ডাইমার নামে একটি প্রোটিন। স্বাস্থ্যবান রোগীর রক্তে এটার যে মান হয়, তার থেকে কয়েকশ বা কয়েক হাজার গুণ বেড়ে যায় করোনার রোগীর ক্ষেত্রে। তাই এই পরীক্ষার কথা বলছেন চিকিৎসকরা।
আর কী হতে পারে?
শরীরের রোগ প্রতিরোধের যে সিস্টেম অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেম ডিজঅর্ডার (অ্যান্টি ফসফোলিপিড অ্যান্টিবডির উপস্থিতিতে) হয় কোনও রোগীর ক্ষেত্রে।
শরীরের নিজস্ব কোষকেই ভুল করে আক্রমণ করে এমন অ্যান্টিবডিও (লুপাস অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট) কোনও কোনও করোনা আক্রান্ত স্ট্রোকের রোগীর শরীরে তৈরি হয়েছে। ফলে রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এর থেকে স্ট্রোক হতে পারে। মস্তিষ্কে একটা মারাত্মক প্রভাব পড়ছে এর ফলে।
কোভিড সেরে গেলেও পরবর্তীতে পক্ষাঘাতও হতে পারে কোনও কোনও ক্ষেত্রে। হাসপাতালে সময়ে না এলে চিকিৎসা শুরু হতেও দেরি হচ্ছে। ৩ থেকে ৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে (গোল্ডেন ট্রিটমেন্ট আওয়ার) ক্ষতি হতে পারে। তাই আতঙ্ক না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন তিনি।
অংশবাবুর কথায়, ‘’খুব মাথা ব্যথা, আচমকা স্ট্রোক, কোনও কো-মর্বিডিটি নেই, ডায়াবিটিস-হাইপারটেনশন-ওবেসিটি নেই, বয়স একেবারেই অল্প, এমন করোনা আক্রান্ত রোগীও দেখেছি লকডাউনে। এক জনের বয়স ২৫, অনেকেরই বয়স ৪০-এর নীচে। রুটিন চেক-আপের সময় ধরা পড়েছে কোভিড। কারও ক্ষেত্রে শুরুতে স্ট্রোক ছিল, রুটিন চেক-আপে কোভিড এসেছে। কেউ নিউমোনিয়া নিয়ে এসেছেন, করোনা রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে, হাসপাতালে ৭-১০ দিন পর স্ট্রোক হয়েছে, এমনও হয়েছে। অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রেও তাই একইরকম সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।‘’
করোনা আবহে সামান্য মাথা ব্যথাতেও অবহেলা নয়। ফাইল ছবি।
মস্তিষ্কের দুটি দিকেই কি প্রভাব ফেলে কোভিড?
হ্যাঁ, দুটি দিকেই প্রভাব ফেলছে। মস্তিষ্কের শিরা ও ধমনীর ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে এই ভাইরাস। এ থেকে রক্তবাহ সংকোচন হলে রক্ত চলাচলে সমস্যা হচ্ছে, অক্সিজেনের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। সে জন্য দ্রুত প্রভাব পড়ছে মস্তিষ্কে। কোভিডের সঙ্গে স্ট্রোকে তাই প্যারালাইসিসের পরিমাণও অনেক বেশি। তাই কোনওরকম সমস্যা হলে করোনা আবহে প্রথমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলছেন তিনি।
কোভিড আবহে তা হলে কি স্ট্রোক বেড়ে গিয়েছে
জয়ন্তবাবু কোভিড আবহে স্ট্রোক প্রসঙ্গে বলেন, ''সারা দেশ জুড়ে ১৩টি প্রতিষ্ঠিত সেন্টারে এই নিয়ে একটা সমীক্ষা হয়েছে। সেই তথ্যের সঙ্গে আমেরিকার স্ট্রোক তথ্যের তুলনা করা হয়েছে। ‘আনালস অব দ্য নিউ ইয়র্ক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’- এ প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্রে দেখা গিয়েছে, আমাদের দেশে স্ট্রোক সেন্টারে স্ট্রোক নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর পরিমাণ কমে গিয়েছে কোভিড আবহে। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৬১.২২ শতাংশ কমে গিয়েছে স্ট্রোক কেসের সংখ্যা।''
স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী আসছেন কি?
মাসে ১০০ জন স্ট্রোকের রোগী দেখেছেন কোভিড আবহের আগে, এখন সেটা ৫০-এর নীচে জানান জয়ন্তবাবু। আমেরিকার ক্ষেত্রেও স্ট্রোক অ্যাডমিশন-এর পরিমাণ কমেছে। আমাদের কাছে হাসপাতালে রোগী শুধুমাত্র ছোট কোনও স্ট্রোক নিয়ে এসেছেন, এই সংখ্যাটা কিন্তু খুব কমে গিয়েছে। মূলত বড় ধরনের অর্থাৎ মেজর স্ট্রোক এবং কম বিপজ্জনক বা মাইনর স্ট্রোক নিয়ে রোগী আসতেন। তবে এই আবহে একটা কারণ হতে পারে যে মাইনর স্ট্রোকের রোগীদের চিকিৎসা বাড়িতে করছেন কেউ কেউ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে। কিন্তু বড় ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে প্যারালাইসিস হতে পারে কিংবা আচমকাই জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া। এ জাতীয় রোগীকে হাসপাতালে তো আসতেই হবে। সেই সংখ্যাটা খানিকটা হলেও কমে গিয়েছে। তবে এই সংক্রান্ত আরও গবেষণার প্রয়োজন।
তাই আতঙ্ক নয়, আবার অবহেলাও নয়। সব মিলিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy